সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৬৩)

সালিশির রায়

কিস্তি – ৬৮ 

 

গ্রাম ছাড়িয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে হোমের পথে। আসার সময় সাবিত্রীদির সঙ্গে পিছনে বসে এলেও ফেরার পথে সামনের সিটেই বসে অঞ্জলি। বৌদিদের মুখে কেমন যেন ইঙ্গিতপূর্ণ ফুটে ওঠে। খুব লজ্জা পাচ্ছিল অঞ্জলির । মনে হচ্ছিল কখন গাড়িটা সাবিত্রিদিদের বাড়ি ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু গ্রাম ছাড়িয়ে আসতেই উল্টো অনুভূতি হয় তার। মনটা খারাপ হয়ে যায়। কেমন সারাটাদিন সবার সঙ্গে আনন্দের মধ্যে কেটে গেল।সবথেকে বড়ো পাওনা এদিন দীর্ঘসময় আলাপনবাবুকে সে পাশে পাশে পেয়েছে। এবার ফিরে তো সেই হোমের চার দেওয়ালের মাঝে বন্দীদশা। কথাটা ভাবতেই মনটা বিষন্ন হয়ে পড়ে অঞ্জলির।
আর বোধহয় সেটা লক্ষ্য করেই গাড়ি চালাতে চালাতেই মাঝে মাঝে তার হাতে হাত রাখেন আলাপনবাবু। অঞ্জলি পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার মুখের দিকে।তার খুব ভালো লাগে আলাপনবাবুর স্পর্শ। কিন্তু কপট রাগ দেখিয়ে বলে , খুব না ? দিন দিন সাহস বেড়েই চলেছে মনে হচ্ছে ? এখন মন দিয়ে গাড়িটা চালাও তো। কিছু একটা হয়ে গেলে কি হবে ?
— কি হবে দুজনে মরে যাব এই তো ?
ওই কথা শোনার পরই হাত দিয়ে আলাপনবাবুর মুখ চেপে ধরে অঞ্জলি বলে — যত সব অলক্ষুণে কথা। চুপ করো তো তুমি।
কিন্তু আলাপনবাবুকে থামানো যায় না। তিনি বলেই চলেন — তুমি কি আমার সঙ্গে মরতে ভয় পাও? তবে অবশ্য তুমি একা মরে গেলে আমি সে আঘাত সইতে পারব না। আমি মরে গেলে তোমার ঘাড় থেকে বোঝাটা নেমে যাবে কি বলো ?
বলেই হাসতে থাকেন আলাপনবাবু। অঞ্জলি কোন কথা বলতে পারে না। তার চোখ ভিজে ওঠে।

সেটা লক্ষ্য করেই রাস্তার পাশে গাড়িটা দাঁড় করান আলাপনবাবু। জানলার বাইরে তাকিয়ে অঞ্জলি দেখে তিলপাড়া ব্যারেজের সেদিনের সেই জায়গার কাছেই গাড়িটা দাঁড়িয়েছে। দরজা খুলে আলাপনবাবু তাকে ডাকে — কই নেমে এসো।
অঞ্জলি তখন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তা দেখে আলাপনবাবু গাড়ির দরজা সামনে হাটু মুড়ে বসে আবৃত্তির ঢঙ-এ বলেন — যদি ভুল কিছু করে থাকি প্রাণ প্রিয়ে / সে ভুল ভেঙে দিও ভালোবাসা দিয়ে —-।
আর মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারে না অঞ্জলি। আবেশ ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আলাপনবাবুর মুখের দিকে। আলাপনবাবু তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। সেই হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমে আসে অঞ্জলি। তারপর হাত ধরাধরি করে তারা হেঁটে চলে সান বাঁধানো সেদিনের সেই সিঁড়িটার দিকে। তাদের পিছনে তখন ডুবে যাচ্ছে সূর্য। তার লালিমা মেখে দুজনে সিঁড়ির শেষ ধাপে গিয়ে বসে।
অঞ্জলি আলাপনবাবুর বুকে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে জলে পা ডুবিয়ে দেয়। আলাপনবাবু আলতো হাতে তার কপালের চুল সরিয়ে অপলক চেয়ে থাকেন অঞ্জলির দিকে। অঞ্জলি তার ঠোঁট দুটো তুলে ধরে।আস্তে আস্তে নেমে আসে আলাপনবাবুর ঠোঁট। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে অঞ্জলি। কথা হারিয়ে যায় দুজনের। শুধু অঞ্জলির ছন্দোবদ্ধ পদ চালনায় নেচে উঠে নদীর জল। সেই জলে ভিজে যায় দুজনে। একসময় অভিমানী গলায় অঞ্জলি বলে , তুমি তখন ওই রকম করে বললে কেন? তোমার কিছু গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচব বলো ? ঘা খেতে খেতে বাঁচার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলেছিলাম। তোমার চোখেই নতুন করে আমি বাঁচার স্বপ্ন ফিরে পেয়েছি। সেই স্বপ্ন হারিয়ে গেলে আমিও হারিয়ে যাব তুমি বোঝ না ?
— তুমি আমায় এতখানি ভালোবাস ?
অঞ্জলি কোন জবাব দেয় না। পায়ে জল নাচিয়েই চলে। আলাপনবাবু ফের জিজ্ঞাসা করেন — কই কোন উত্তর দিলে না তো ?
এবারেও কোন জবাব মেলে না। শেষে অঞ্জলিকে নাড়া দেন তিনি। নাড়া খেয়ে আলাপনবাবুর বুকে আরও ঘন হয়ে হয়ে অঞ্জলি শুধুমাত্র উঃ বলে চুপ করে যায়।
আলাপনবাবু তখন বলেন — বেশ বলবে না তো ?
এবারে অঞ্জলি আলাপনবাবুর মুখটা নিজের কাছে টেনে এনে বলে — এই কথাটা বলে দিতে হবে ? তুমি বোঝ না ? তারপর ফের তীব্র আশ্লেষে আলাপনবাবুর ঠোঁটে মিলিয়ে দেয় নিজের ঠোঁট। কেউ কোন কথা বলতে পারে না। কিন্তু অনুভবে অনেক কথার আদান প্রদান হয়ে যায়। কত পল – কত মুহুর্ত কেটে যায় টের পায় না কেউ। আলাপনবাবু একসময় বলেন , রাত্রি হলো এবার ফিরতে হবে। চলো উঠি।

 

অঞ্জলি কোন জবাব দেয় না।
আলাপনবাবু ফের তাড়া দেন, কি হলো ওঠো।
অঞ্জলি বলে, এই পরিবেশ ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।
আলাপনবাবু বলেন , ইচ্ছে করছে না বললে হবে ? হোমের মেয়েরা কি ভাববে ? তাছাড়া পড়তে বসতে হবে না ?
—- এই তোমার এক দোষ। শুধু পড়া আর পড়া।
—- বারে, পড়াটা শেষ না হলে আমাদের বিয়েটা হবে কি করে ?
এরপর আর কোন কথা চলে না অঞ্জলির। এবার সে উঠে নিজেই আলাপনবাবুর হাত ধরে এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে।গাড়িতে আসতে আসতে অঞ্জলির মনে হয় একবছর যেন কত দীর্ঘ সময়। কি করে কাটাবে সে ৩৬৫ টা দিন ? এখন যে প্রতিদিন আলাপনবাবুকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। কিন্তু তার পড়াশোনা শেষ না হলে তো আলাপনবাবুকেও সে কাছে পাবে না। তাই সে প্রতিজ্ঞা করে ,মন দিয়ে আগে পড়াশোনাটাই শেষ করবে।আলাপনবাবুর কথা ভাবতে ভাবতে সে টের পায় নি গাড়ি এসে থেমেছে হোমের গেটের সামনে।গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হতেই দেখে আলাপনবাবু তার দিকে দুষ্টুমি ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে মিটিমিটি হাসছেন। সে আলতো করে একটা চিমটি কেটে গাড়ি থেকে নেমে আসে। তাকে নামিয়ে দিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে গাড়ি নিয়ে চলে যান আলাপনবাবু।
হোমে ফিরে অঞ্জলি দেখে সবাই তার প্রতীক্ষায় রয়েছেন। সাবিত্রীদের বাড়ির কথা সবিস্তারে বলতে হয় তাদের। শুনে সবাই খুব খুশী হয়।
সবাই বলে , তোমার জন্যই সাবিত্রী আজ সুখের মুখ দেখতে পেল। না হলে হোমেই পচে মরতে হোত।
মালতি বলে , শুধু সাবিত্রীদি কেন , শ্রাবণীদিও তো আজ অঞ্জলিদির জন্যই ঘর বর সব পেয়েছে। না হলে ওকেও হয়তো আমাদের মতো এই হোমেই পচে মরতে হত।

 

অঞ্জলি লক্ষ্য করে সাবিত্রীদি আর শ্রাবণীর কথা বলতে গিয়ে অলক্ষ্যে সবার যেন দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে। ঘর বরের স্বপ্ন তো মেয়েদের চিরন্তন। তাই সবার মনেই সাবিত্রীদি কিম্বা শ্রাবণীর মতো একটু সুখের আশা থাকাটাই স্বাভাবিক। অঞ্জলি ভাবে তারপর সেও যখন আলাপনবাবুর সঙ্গে ঘর বেঁধে চলে যাবে তখন সবার মনটা আরও খারাপ হয়ে যাবে। সেটা ভেবেই অঞ্জলি মনে মনে ঠিক করেই রেখেছে সে যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে তাহলে অন্তত এই হোমের মেয়েগুলোকে সে মুলস্রোতে ফেরানো চেষ্টা করবে। সে জানে এই রকম লক্ষ লক্ষ মেয়ে সমাজের মুলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হোমের চার দেওয়ালে পচে মরছে। জীবনে বেঁচে থাকা কাকে বলে সেটাই তারা জানে না। কোন রকমে দিনগত পাপক্ষয় করে চলেছেন। সবাইকে সমাজের মুলস্রোতে ফেরানো তার একার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু এই হোমের মেয়েদের মাধ্যমেই সে একটা বার্তা দিতে চায়। যে বার্তায় আরও কিছু মানুষ নাড়া খেয়ে ওইসব হতভাগিনী মেয়েদের কথা সহানুভূতির সঙ্গে ভাবতে শুরু করবে। আর তাতে যদি একজন মেয়েও সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে পারে সেটাই বা কম কিসের ? অঞ্জলি দেখে তখনও সবাই থম মেরে রয়েছে। সে পরিবেশটা পাল্টাতে ব্যাগ থেকে সাবিত্রীদির মোবাইলটা বের করে বলে , সাবিত্রী জোর করে এটা আমাদের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। এখন আমরা সাবিত্রীদির সঙ্গে কথা বলতে পারব। প্রয়োজনে অন্য জায়গাতেও কথা বলতে পারবে। যার যখন দরকার হবে চেয়ে নেবে। তার কথা শুনে অনেকেই বলে , আমাদের আর কথা বলার মতো কেই বা আছে ? তবে সাবিত্রীদির সঙ্গে কথা বলে বাইরের জগতের খবরটা তো পাবে। অঞ্জলিও অনুভব করে সত্যিই চার দেওয়ালে বন্দী থাকতে থাকতে বাইরের জগতের প্রতি কি অপরিসীম আকাঙ্ক্ষা জমা হয়ে আছে সবার মনে। কথায় কথায় মনে পড়ে যায় , মোবাইলটার কথা তো আলাপনবাবুকে বলতেই ভুলে গিয়েছে। একদিকে ভালোই হয়েছে। আলাপনবাবুর নম্বর তো তার খাতায় লেখাই আছে। সময় সুযোগ মতো একেবারে ফোন করে চমকে দেবে তাকে। সাবিত্রীদির কাছে ফোনটা নেওয়ার জন্য আলাপনবাবু আবার রাগ করবেন না তো ? সেই দুশ্চিন্তা পেয়ে বসে তাকে।
তবে সে তো নিতে চায় নি, সাবিত্রীদিই তাকে জোর করে ধরিয়ে দিয়েছেন। সেটা বুঝিয়ে বললে আলাপনবাবু নিশ্চয় আর রাগ করে থাকতে পারবেন না। তাছাড়া তার সঙ্গে কথা বলতে আলাপনবাবুরও নিশ্চয় খুব ভালো লাগবে।

 

কিন্তু কিছুতেই তার মনের খুতখুতানি যায় না। মোবাইলটা নিয়ে আলাপনবাবুর প্রতিক্রিয়া না জানা পর্যন্ত কিছুতেই তার মনের শান্তি হয় না। তাই একটু সুযোগ পেতেই সে আলাপনবাবুর নম্বরে রিং করে। বার কয়েক রিং হওয়ার পরই আলাপনবাবুর গলা ভেসে আসে — হ্যালো–।
সে কোন কথা বলার পরিবর্তে আস্তে করে একটা চুমু ছুড়ে দেয়।
অপর প্রান্তে বিষয় ঝড়ে পড়ে — কে আপনি ?
এবারে মুখ খোলে অঞ্জলি। সে বলে , অঃ আপনাকে বুঝি ফোনে অনেকেই এই রকম চুমু খায় ?
এবারে বেশ কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারেন না। তারপর বলেন — তুমি ? ফোন কোথাই পেলে?
তখন ঘটনার কথা সব খুলে বলে অঞ্জলি। শেষে খুব মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করে — তুমি রাগ করো নি তো?
আলাপনবাবু বলেন , এখনও করি নি। তবে পড়াশোনা ফেলে ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে রাগ করব কিন্তু।
— না, না মোটেই নয়। তোমাকে না জানিয়ে মনটা কেমন করছিল বলেই ফোন করলাম। এই আমি ছাড়ছি। বলে ফোন কেটে দেয় অঞ্জলি। তার বুক থেকে যেন একটা পাষাণভার নেমে যায়। দুঃচিন্তায় কিছুতেই সে পড়াতে মন বসাতে পারত না। এবারে প্রানপাত সাধনা শুরু করে দেয় অঞ্জলি। দিনরাত এককরে পড়াশোনা শুরু করে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারলে সে কেমন করে আলাপনবাবুকে কাছে পাবে ? কেমন করেই বা হোমের মেয়েদের মুলস্রোতে ফেরাবে ? অবশ্য তার মতোই আরও কয়েকজন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করেছে। তার তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার সঙ্গে সঞ্চিতারাও তিনজন কলেজে ভর্তি হয়েছে। একাদশ শ্রেণীতেও তিনজন ভর্তি হয়েছে। বাকিরাও সমানতালে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে বছর গড়িয়ে যায়। অঞ্জলির ফাইন্যাল ইয়ারের পরীক্ষাও নির্বিঘ্নে শেষ হয়। ক্রমশ এগিয়ে আসে রেজাল্ট আউটের দিন। আর অঞ্জলির বুকের ধুকপুকানিও বাড়তে থাকে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।