T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় রাজর্ষি বর্ধন

বিপরীত

 

লেখেন। বাতিল করেন। ফের শুরু করেন নতুন করে। পছন্দ হয় না। বাতিল করতে হয়। ফের নতুন সাদা পৃষ্ঠার সামনে নিজেকে দাঁড় করান।

গত কয়েকদিন যাবৎ “শান্তি” নামক শব্দটাই যেন উধাও হয়ে গেছে চিত্রনাট্যকারের জীবন থেকে !

প্রেমের ছবি বানাবেন পরিচালক। প্রযোজক পেয়ে গেছেন। তাঁর নিজের কাকাই ছবিতে টাকা ঢালবেন। কিন্তু সবচাইতে বেশি যেটার প্রয়োজন, ছবির গল্প, সেটাই পরিচালকের হাতে নেই। সাধারণত পরিস্থিতিটা উল্টো হয়ে থাকে। হাতে গল্প থাকে কিন্তু টাকা থাকে না। এই পরিচালক টাকাপয়সার দিক দিয়ে ভাগ্যবান।

কিন্তু ছবি করতে গেলে শুধু টাকা দিয়ে তো হয় না, গল্প লাগে। অগত্যা চিত্রনাট্যকারের দ্বারস্থ হন পরিচালক-প্রযোজকদ্বয়। কাকা-ভাইপো জুটি। চিত্রনাট্যকর অতি বিখ্যাত। গোটা বাংলার তো বটেই, সারা দেশের সেরা দশজন চিত্রনাট্যকরের তালিকায় তাঁর নাম অনায়াসে ঢোকানো যায় !

সব শুনে তিনি বললেন, তাঁর হাতে প্রচুর কাজ। দু’ মাস পর দেখা করতে।

কাকা-ভাইপো দু’ মাস অপেক্ষায়ে করতে রাজি। করলেনও অপেক্ষা। ফের গেলেন চিত্রনাট্যকরের কাছে। গিয়ে একটা দুঃসংবাদ পেলেন। চিত্রনাট্যকরের প্রেমিকা তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে, এখন তাঁর কাজে মন বসছে না, তাই প্রেমের গল্প লেখা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁর বদলে তিনি হরর কমেডি জঁরের একটা লেখা লিখে দিতে পারেন।

এই শুনে কাকা-ভাইপো পড়ল মহা আতান্তরে! এই দু’ মাসে তো তাঁরা নানান জায়গায় কথা বলে রেখেছেন ছবির ব্যপারে। অভিনেতা-অভিনেত্রী ও বাকি শিল্পীদের, ক্যামেরাম্যান, টেকনিশিয়ান- সবাই জানে যে প্রেমের ছবিই হচ্ছে, এবং কাজ আরম্ভ হবে একমাসের মধ্যে। এখন চিত্রনাট্যকর বলছেন, তিনি প্রেমের গল্প লিখতে পারবেন না?

চিত্রনাট্যকর ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “দেখুন, আমি কিন্তু আপনাদের কাছ থেকে কোন অ্যাডভান্স নিইনি, তাই আমি ব্যাক আউট করলে কারোর কিন্তু কিছু বলার রাইট নেই ! আপনারা এভাবে আমায় চাপ দিতে পারেন না !”

প্রযোজক হাত জোর করে বললেন, “আপনি কিছু একটা লিখে দিন প্লিজ, নইলে আমি মারা পড়ব ! অনেক জায়গায় টাকা ঢেলে ফেলেছি !”

পরিচালক বিনয়ের সুরে বললেন, “আপনি শিল্পী মানুষ ! শিল্পীদের কল্পনা শক্তি অসীম ! আপনার বাস্তব জীবনের প্রতিফলন নিশ্চয়ই আপনার চিত্রনাট্যের গল্পের ওপর এসে পড়বে না! অন্তত আপনার পেশাদারিত্বের যা সুনাম রয়েছে, এবং আপনার যা অভিজ্ঞতা, তাতে এমনটা বলাই যায় !” এই বলে তিনি তাঁর প্রযোজক কাকার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার টাকা আমরা দ্বিগুণ করে দেবো !”

চিত্রনাট্যকর ভেবে দেখলেন, প্রস্তাব মন্দ নয়। দ্বিগুণ টাকা হাতে আসলে তাঁর মাস দেড়েকের মদের খরচা উঠে আসবে। তিনি রাজি হয়ে গেলেন।

কিন্তু চিত্রনাট্য লেখার সময় তাঁকে এক দুর্বিষহ মানসিক টানাপোড়েনের সম্মুখীন হতে হল। একদিকে সদ্যভাঙ্গা প্রেমের বিরহজ্বালা, অন্যদিকে পরিচালকের মিলনান্তক প্রেম কাহিনির চাহিদা, এই দুইয়ের মাঝে পড়ে চিত্রনাট্যকর যেন ইঁদুরের মতো ছটফট করতে লাগলেন ! তাঁর কখনো মনে হতে লাগল, ফিল্মের কাহিনী লেখাই পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন কাজ। কখনো আবার এরকম মনে হত, ম্যানেজমেন্টের লাইন ছেড়ে ফিল্ম লাইনে আসাটাই ছিল চরম মুর্খামি !

অবশেষে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, বোতল-বোতল মদ উজার করে একটা স্ক্রিপ্ট লিখে উঠতে সক্ষম হলেন। কাঁপা-কাঁপা হাতে সেটা পরিচালকের হাতে তুলে দিলেন।

স্ক্রিপ্ট পেয়ে পরিচালক-প্রযোজক দুজনেই আপ্লুত। তাদের দুজনেরই বক্তব্য, এর চাইতে ভালো প্রেমের কাহিনী হতেই পারে না! সিনেমা সুপার-ডুপার হিট হবেই !

হলও তাই ! মুক্তি পাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই সমস্ত বক্স-অফিস রেকর্ড চূর্ণ হয়ে গেলো। সবাই হইহই করে বলতে লাগল, এটাই দশ বছরে হওয়া সেরা রোমান্টিক ছবি। স্বর্ণযুগে তৈরি হওয়া কালজয়ী সব প্রেমের ছবির সাথে তুলনা হতে লাগল। রাজ্যস্তরে, জাতীয়স্তরের সব পুরস্কার উপচে পড়তে লাগল ছবির ঝুলিতে !

ছবির ফলাফলে প্রযোজক অভিভূত, পরিচালক বিস্মিত এবং চিত্রনাট্যকর যারপরনাই, বাক্রুদ্ধ !

এক বছর ঘুরতে না ঘুরতে আবার একটা ছবির কাহিনী লেখার প্রস্তাব এল চিত্রনাট্যকারের কাছে। এবারও রোমান্টিক গল্প। পরিচালক অন্য, তবে তিনি আগের ছবির প্রসঙ্গ টেনে এনে বললেন, এইবার এমন স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে, যাতে ওই ছবির সব রেকর্ড ভেঙ্গে যায় !

চিত্রনাট্যকর সহজেই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। প্রেমের গল্প লেখা তাঁর কাছে এখন জলভাত। নিজেকে স্বয়ং কালিদাসের সঙ্গে তুলনা করেন মাঝেমাঝে।

তাঁর প্রেম জীবনও যথেষ্ট সুস্থির। একজন স্টেডি বান্ধবী জুটেছে, যার সাথে তিনি লিভ-ইন করেন। এছাড়া নানান উঠতি নায়িকার সঙ্গে তাঁর অ্যাফেয়ার লেগেই রয়েছে ! তাঁর আগের ছবির সাফল্য তাঁকে অনেক কিছুই এনে দিয়েছে !

এরকম অবস্থায় একটা মিষ্টি প্রেমের গল্প লিখতে গিয়ে তিনি বারবার হোঁচট খেতে লাগলেন। তাঁর মনে হতে লাগল, তিনি প্রেমের গল্প লিখছেন ঠিকই, কিন্তু তা বড্ড বেশি বাস্তব ঘেঁষা। বাস্তব ঘেঁষা হলে কি তাকে রোমান্টিক বলা চলে?

তিনি প্রেমিকার সঙ্গে ব্রেক-আপ করলেন। একমাস পরেই তাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কার্ড পর্যন্ত ছাঁপা হয়ে গেছিল। যেই নায়িকাদের সঙ্গে তাঁর খুনসুটিমাফিক প্রেম ছিল, তাদের সঙ্গেও সম্পর্ক ত্যাগ করলেন। সম্পূর্ণ একাকি, নিঃস্ব হয়ে এবং একবুক বিরহজ্বালা ও রঙিন পানীয়কে সঙ্গী করে তিনি ছবির স্ক্রিপ্ট লিখতে শুরু করলেন।

আশানুরূপ ভাবে এ ছবি আগের সব রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলল। বহুবছর ধরে প্রেক্ষাগৃহে চলল এই ছবি। লোকে এখন আদর্শ প্রেমের ছবি বলতে এই ছবিকেই চেনে !

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।