“এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো” বিশেষ সংখ্যায় রণিত ভৌমিক

রক্তাঞ্জলি

ছোটবেলা থেকে তেমন ভূত-পিশাচে বিশ্বাসী না হলেও, বাস্তব জীবনে এমন কিছু ঘটনার সাক্ষী হয়েছি যে এখন এটা মানতে দ্বিধা নেই যে পৃথিবীতে শুভ শক্তির পাশাপাশি অশুভ শক্তিরও সমান উপস্থিতি রয়েছে। আরও স্পষ্ট করে বললে, সেবার রেলে চাকরি পাওয়া মাত্রই আমাকে শহর ছেড়ে কোচবিহারের একদম শেষ প্রান্তের একটি গ্রামে পাড়ি দিতে হয়েছিল। যদিও বা গ্রামে যাওয়াটা ছিল আমার একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত কারণ শহুরে আদপকায়দায় মানুষ হয়েছিলাম বলে, সেইভাবে কখনো গ্রামের গন্ধ গায়ে মাখার সুযোগ পাইনি। ফলে, যখন জানতে পারলাম যে পশ্চিমবঙ্গ-আসাম সীমান্ত সংলগ্ন জোড়াই স্টেশনে আমাকে স্টেশন গার্ড হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে, তখন সেই লোভ আর সামলাতে পারিনি। সুতরাং ওখানকার অধিকর্তাদের বলে স্টেশন সংলগ্ন ওই গ্রামে আমার থাকার সব ব্যবস্থা করে ফেললাম।
কিন্তু জোড়াই স্টেশন পৌঁছানোর পর, বুঝতে পারলাম যে সেই স্টেশন সংলগ্ন গ্রামটা আদতে সেখান থেকে প্রায় ১০ কিমি দূরত্বে অবস্থিত। ওই গ্রামে থাকার সিদ্ধান্তটা আমার যে কত বড় ভুল, সেটা তখন টের পেলেও আমার আর কিছু করার ছিল না। ফলে, অন্য কোনও উপায় নেই দেখে আমি গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে বাধ্য হলাম।
রামুদা আমার জন্য স্টেশনেই বসে ছিল, ওর সঙ্গে ভ্যানে যেতে যেতে গ্রামের বিষয় দু-চার কথা শুনছিলাম। ওর কথা অনুযায়ী, আজ অবধি যতজন কর্মী স্টেশন গার্ড হিসেবে এখানে এসেছে তারা প্রত্যেককেই ওই গ্রাম এবং গ্রামে যেতে গেলে যেই জঙ্গলটি পরে, তা এড়িয়ে যাওয়াটাই শ্রেয় বলে মনে করেছে। কিন্তু কেন, সেটা আমার প্রশ্ন। সুতরাং সেই বিষয় রামুদাকে জিজ্ঞেস করতেই ওর কাছ থেকে যা শুনলাম, তা যে কোনও মানুষের গায়ে শিহরণ জাগানোর পক্ষে যথেষ্ট।
গ্রামবাসীরা খুব সহজসরল হলেও, ওই জঙ্গলের মধ্যে এমন একদল আদিবাসী বসবাস করে, যারা কিনা নরমাংসভোজী। গ্রামের কোনও লোক একবার জঙ্গলে ঢুকলে আর কখনোই ফিরে আসে না। শোনা যায়, জঙ্গলের ভিতর একটি গুহা আছে এবং সেখানে তারা শয়তানকে দেবতার রূপে উপাসনা করে।
কিন্তু এতো দেবতা থাকতে আদিবাসীরা কেন শয়তানের উপাসনা করে, সেই প্রশ্নই আমার মাথায় খালি ঘুরপাক খাচ্ছিল। রামুদার থেকে এই বিষয় তেমন সঠিক কোনও তথ্য না পেলেও, গ্রামে থাকতে থাকতে এখানকার বয়োজ্যেষ্ঠদের থেকে যা জানতে পেরেছিলাম সেটা অনেকটাই তাদের অনুমান বলা যেতে পারে। হ্যাঁ! অনেক বছর আগে এই তল্লাটের জমিদার একবার জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে নাকি এক অদ্ভুত দেখতে বিগ্রহ খুঁজে পায়, যেই বিগ্রহের সঙ্গে আমাদের চেনা পরিচিত কোনও দেবতার রূপের মিল নেই। অনেকটা পৌরাণিক গল্পে পড়া রাক্ষসের মুখের মতো দেখতে বলা যেতে পারে। জমিদার সেই বিগ্রহ নিজের সঙ্গে নিয়ে গ্রামে ফেরেন। তবে, ওই বিগ্রহ গ্রামে আনার পর থেকেই গ্রামবাসীদের নানান দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়েছে। একবার তো অজানা জ্বরের কারণে গ্রামে মৃত্যুর মিছিল লেগে গিয়েছিল। ওই সময় ব্রাহ্মণদের পরামর্শ অনুযায়ী সেই বিগ্রহ জমিদার আবারও জঙ্গলে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং বলা যেতে পারে তারপর ধীরে ধীরে গ্রামের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। ওই বিগ্রহ সেই দিনের পর থেকে আজ অবধি জঙ্গলেই আছে।
সবটা জানার পরও, আমার একবিন্দুও কারোর কথায় বিশ্বাস হয়নি। সমস্তটাই আমার ঠাকুরমার ঝুলি কিংবা রুপকথার কোনও কল্পকাহিনি মনে হয়েছিল। তবে, এর পিছনে অন্য কোনও রহস্য আছে কিনা, সেই বিষয় জানার আমার একটা আগ্রহ জন্মেছিল।
সারাদিনে কেবলমাত্র হাতে গোনা কিছু ট্রেন জোড়াই স্টেশন দিয়ে যাওয়া আসা করে। সুতরাং স্টেশনে মাঝে মধ্যে একা চুপচাপ বসে থাকতে একঘেয়েমি লাগত। এদিকে, প্রতিদিন স্টেশন থেকে গ্রামে ফেরার সময়, ওই জঙ্গলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মনের মধ্যে একবার হলেও সেই রহস্যদঘাটনের বাসনা জেগে উঠত। কিন্তু একার পক্ষে সেই কাজ সম্ভবপর নয় বলে, ওই বাসনা আমার মনের মধ্যেই আবদ্ধ রয়ে যেত।
আমার ঘরটা ছিল গ্রামের পূর্ব দিকে, সেখানে জনবসতি তেমন ছিল না বললেই চলে। ওমন ফাঁকা এলাকায় থাকতে যে কারোর ভয় লাগাটাই স্বাভাবিক কিন্তু আমার নাক সিটকানোর বিষয়টা ছিল অন্য জায়গায়। হ্যাঁ! ঠিকই ধরেছেন। ঘরটা আমার একেবারেই পছন্দ ছিল না। একেই তো ছোট একচালার কাঁচা ঘর, তার ওপর আবার জানালাগুলোর দিকে তাকালে মনে হবে, জোড় করে যেন জানালা ফোটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তবে, সব মন্দের মধ্যে ভালো বলতে শুধু সামনের দিকের ওই উঠোনটা। সেখানে রয়েছে নাম না জানা এক ঝাঁক ফুলের গাছ। রাতের দিকে সেই সমস্ত ফুলের গাছ থেকে ভেসে আসা সুবাসে আমার ঘুমটা মন্দ হত না। রামুদা রোজ সকাল হলেই জোড়াই বাজার থেকে আমার জন্য রোজকার জরুরি জিনিসপত্র কিনে দিয়ে আসত।
তবে, গত তিনদিন ধরে রামুদা আর আসছে না। প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম ওর বুঝি শরীর খারাপ তাই আসতে পারছে না। কিন্তু আমার মনে সন্দেহটা জাগল, যখন লক্ষ্য করলাম তিনদিন পেরিয়ে এক সপ্তাহের উপর হতে চলল, তবু রামুদার কোনও দেখা নেই। ওই রাতে তাই ঘুমাতে যাওয়ার আগে ঠিক করলাম, পরদিন স্টেশন থেকে ফেরার পথে ওর একবার খোঁজ নিতে যাব। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার আগেই, খবরটা কানে এল।
আর খবরটা কানে আসা মাত্র, এক মুহূর্তও দেরি করিনি। রাত তখন দশটা। গ্রামের চারদিকটা একেবারে নিস্তব্ধ। আমাকে খবরটা দিতে যে এসেছিল, তাকে আমি আগে কখনো গ্রামে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। এদিকে, তাড়াহুড়োর চটে তার পরিচয় সম্মন্ধে তাকে জিজ্ঞেস করতেই আমি বেমালুম ভুলে গেলাম। আসলে ওই লোকটির কাতর গলায় রামুদার জঙ্গলে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা শুনে আমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি। রাত দশটা বাজলেও ঘড়ির দিকে না তাকিয়ে, সেই অচেনা লোকটির সঙ্গে আমি জঙ্গলের দিকে ছুটলাম।
জঙ্গলে প্রবেশ করা মাত্রই আমার গোটা শরীর কেমন যেন ভারী হয়ে গেল। চারদিকে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, জঙ্গলের বিভিন্ন দিকে চোখ ঘুরিয়েও আমি একজন আদিবাসীকেও কোথাও দেখতে পেলাম না। আমরা দু-হাতে মাকড়সার জাল আর জঙ্গলি গাছের পাতা সরাতে সরাতে শুধু এগিয়ে চলেছি। জঙ্গলের ভিতরে আলোর একটা আভা চোখে পড়ল। কিন্তু সেই আলো যতটা কাছে মনে হচ্ছিল, তার তুলনায় ঢের দূরে। প্রায় মিনিট পনেরো হাঁটার পর, আমরা এক গুহার সামনে এসে হাজির হলাম এবং সেখানে আসা মাত্রই বুঝতে পারলাম যে আমরা এতক্ষণ ধরে যেই আলোর আভা অনুসরণ করে এতদূর এলাম, সেটা আদতে ওই গুহার প্রবেশদ্বারের সামনে লাগানো একটি জ্বলন্ত মশালের আগুন।
ওই মুহূর্তে গুহার সামনে দাঁড়িয়ে আমার মনে মধ্যে সন্দেহ যেন ক্রমশ ডানা মেলছে। সুতরাং সেই সন্দেহ থেকেই আমি তাকে বলে উঠলাম,”রামুদাকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। এদিকে, আপনি বললেন সে এখানেই এসেছে”।
লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল,”গুহার ভিতর গেলে, মনের সব উত্তর খুঁজে পাবেন”।
কথাটা শোনার পর, আমি আর সময় নষ্ট না করে বাইরে রাখা মশালটা হাতে নিয়ে ‘রামুদা, রামুদা’ বলে উচ্চ স্বরে তাকে ডাকতে ডাকতে গুহার ওই এবড়োখেবড়ো পথ পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম।
ভিতরে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ল পাথরের গায়ে অচেনা ভাষায় লেখা কিছু লাইন, যেটা অনেকবার চেষ্টা করেও পড়তে ব্যর্থ হলাম। তবে, একটা ব্যাপার দেখে বেশ খটকা লাগল, গুহার ভিতরটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আসলে আমি প্রথমে ভেবেছিলাম গুহাটা বোধহয় পরিত্যক্ত কিন্তু ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের মিল পাইনি। চারপাশটা ভালো করে দেখে এটা বুঝতে পারলাম যে এখানে মানুষের আনাগোনা আছে। বিশেষ করে যখন আধা জ্বলা ধূপ আর হাড়িকাঠের সামনে মাটি খুঁড়ে রাখার বিষয়টা চোখে পড়ল। তবে, গুহার ভিতর উপস্থিত সেই পাথরের বিগ্রহ দেখে একটু থমকে গেলাম। সম্পূর্ণ এক অচেনা বিগ্রহ, যেই বিগ্রহ আমার জানা কোনও দেবতার হতে পারে বলে আমি মনে করি না। প্রায় ৫-ফুট লম্বা পুরুষ বিগ্রহ, মুখের চারদিকে লেগে রয়েছে জমে থাকা লাল রক্তের দাগ। সেই উগ্র এবং ভয়ঙ্কর দেখতে বিগ্রহটির সামনে ভক্তির চেয়ে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। গ্রামে আসার পর এইরকম বিগ্রহের কথাই তো গ্রামবাসীদের মুখে শুনেছিলাম। কিন্তু তখন বিশ্বাস না করলেও, এখন টের পাচ্ছি যে পৌরাণিক গল্পের রাক্ষসদের মতো অবিকল এক বিগ্রহ যেন আমার চোখের সামনে তখন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এবং ওনার নিকট আসার জন্য আমাকে যেন আহবান জানাছেন।
আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে বলে উঠল,”ওই যে বিগ্রহটি দেখছেন, সেটি আসলে শয়তান দেবতা। যিনি রক্তের লাল রঙ ছাড়া আর কোনও কিছুতেই প্রসন্ন হন না”।
কাঁপা গলায় বললাম,”কে আপনি? রামুদা কোথায়?”
লোকটি আমার কথার জবাব না দিয়ে জোরে হেসে উঠল। আর ওই গুহার প্রতিটা দেওয়ালে সেই হাসির প্রতিধ্বনি তখন শোনা যাচ্ছিল। একটু পরে হাসি থামার পর সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,”রামুকে দেখতে চান, একটু অপেক্ষা করুন, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি”।
কথা শেষ হতে না হতেই, চোখের সামনে এক ভয়াবহ দৃশ্য ফুটে উঠল। গুহার প্রবেশদ্বার দিয়ে কারা যেন মুহূর্তের মধ্যে ওখানে এসে উপস্থিত হল এবং মুহুর্মুহু উলু আর শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে রামুদাকে তারা অচেতন অবস্থায় এক অদ্ভুত সাজে ওখানে নিয়ে এল। রামুদার পড়নে তখন ছিল লাল ধুতি, কপালে একটা কালো তিলক কাটা আর গলায় একটা নরমুণ্ডুর মালা।
আমাকে বিস্মিত হতে দেখে লোকটি বলল,”অবাক হচ্ছেন? নরবলি ছাড়া এই পূজো তো অসম্পূর্ণ। শয়তান দেবতাকে প্রসন্ন করতে কোনও পুস্প নয়, একমাত্র প্রয়োজন মানুষের রক্ত। শয়তান দেবতাকে এখানে মানুষের রক্ত দিয়েই অঞ্জলি দেওয়া হয়। আর এটাই এই পূজোর প্রচলিত নিয়ম”।
“তার মানে রামুদাকে বলি দেওয়া হবে?” আবারও কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
উত্তরে সেই লোকটি বলল,”ধরে নিন তাই। প্রত্যেক অমাবস্যার রাতে এই বিগ্রহের সামনে কোনও না কোনও মানুষকে উৎসর্গ করতেই হয়। আসলে গ্রামবাসীরা ভাবে যে জঙ্গলে বসবাসকারী আদিবাসীরা নরমাংসভোজী কিন্তু এটা সম্পূর্ণ একটা গুজব। আদিবাসীরা কেউই নরমাংসভোজী নয়। তারা নরবলি দিতে বাধ্য কারণ প্রাচীন কাল থেকেই এই এলাকা শয়তানের অধীনে। অনেক কষ্টে এই গুহার মধ্যে শয়তানকে আবদ্ধ করে রাখা সম্ভব হলেও, মাসের এই একটা দিন তাকে মানুষের রক্তে স্নান করাতেই হয়। এই নরবলি প্রথা একবার বন্ধ করে দিলে, শয়তান ভয়ঙ্কর প্রলয় শুরু করবে এবং এই গ্রাম সমেত সবকিছু তখন ছারখার হয়ে যাবে। কেউ তার হাত থেকে রেহাই পাবে না”।
প্রত্যেকটা কথা মন দিয়ে শোনার পর তার কাছে আমি জানতে চাইলাম,”এর কি কোনও সমাধান নেই? এইভাবেই এক একটা তরতাজা প্রাণ শেষ হয়ে যাবে? যদি এরকমই চলতে থাকে, তাহলে তো একদিন গ্রামে এমনিতেই কেউ আর বেঁচে থাকবে না”।
“হা-হা-হা! এর সমাধান একটাই। যতদিন গ্রামে মানুষের বসবাস থাকবে, ততদিন শয়তান দেবতাকে রক্তাঞ্জলি দিয়ে যেতে হবে। অবশ্য আপনার মতো অনেকেই এর সমাধান খুঁজতে চেয়েছিল কিন্তু তাদের শেষ পরিণাম কি হয়েছিল, তা জানতে চাইলে আমার সঙ্গে ওদিকে চলুন”। কথা শেষ করে লোকটি আমাকে ওই বিগ্রহের ডানদিকের দেওয়াল বরাবর একেবারে কোণায় নিয়ে গিয়ে মাটিতে পুঁতে রাখা কিছু নরমুণ্ডুর দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল,”দেখুন, ভালো করে দেখুন। এই হল তাদের পরিণাম”।
নরমুণ্ডুগুলোর দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। ক্রমশ ভয় যেন আমাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরছে। কথা শেষ হওয়া মাত্রই লক্ষ্য করলাম লোকটি হাড়িকাঠের সামনে গিয়ে বাকিদের কি যেন নির্দেশ দিল এবং তারা সম্পূর্ণ অচেন অবস্থায় থাকা রামুদাকে ওই হাড়িকাঠের সামনে নিয়ে এসে দাঁড় করাল। রামুদার মাথাটা হাড়িকাঠে রাখার পর যখন সেই লোকটি আমার চোখের সামনে ওর মাথাটা ধর থেকে আলাদা করবার জন্য খাঁড়াটা হাতে তুলল, আমি চিৎকার করে উঠলাম। আর আমাকে চিৎকার করতে দেখে, ওখানে উপস্থিত বাকিরা আমাকে চেপে ধরল। শরীরের সমস্ত বল প্রয়োগ করেও, তাদের হাত থেকে আমি নিস্তার পেলাম না। সুতরাং চোখের সামনে ওই নির্মম দৃশ্য ঘটতে দেখলাম।
হাড়িকাঠ থেকে অনেকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকলেও, রামুদার দেহের রক্ত আমার জামায় ছিটকে এসে পড়েছিল। গুলিয়ে ওঠা নাড়িভুঁড়ি, হাড় কেঁপে যাওয়া অস্তিত্ব নিয়ে কোনও মতে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু রামুদার রক্তে ওই বিগ্রহকে স্নান করাতে দেখে, আমি চোখের কোণে জল নিয়েই জ্ঞান হারালাম।
জ্ঞান ফেরার পর যখন চোখ খুললাম, দেখি রামুদা ঘরের মেঝেতে বসে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাকে জীবিত দেখে আমি হকচকিয়ে গেলাম। বুঝতে পারছিলাম না যে ওই মুহূর্তে আমি স্বপ্ন দেখছি নাকি বাস্তবেই রামুদা আমার সামনে বসে। ওকে ছোঁওয়ার পর বুঝলাম, আদতে সে মারা যায়নি। কিন্তু চোখের সামনে দেখা ঘটনাটা কি নেহাতই কোনও দুঃস্বপ্ন?
এদিকে, আমার স্পষ্ট মনে আছে ওই লোকটির সঙ্গে আমি জঙ্গলে গিয়েছিলাম, যার প্রমাণ একটু পরেই রামুদার থেকে পেলাম যখন সে আমাকে জানালো যে একজন অচেনা লোক আমাকে অচেতন অবস্থায় ঘর অবধি এসে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে। রামুদাকেও এই কদিন সকালে না আসার কারণ হিসাবে বলতে শুনলাম,”আমাকে ক্ষমা করবেন বাবু, আসলে আমার পিসিমা হঠাৎ করে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তাই আপনাকে না জানিয়েই আমি শহরে চলে গিয়েছিলাম”।
কথাগুলো শোনার পর থেকেই আমার মাথার মধ্যে নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল এবং সেইসঙ্গে মাথার যন্ত্রণাটাও ধীরে ধীরে বাড়ছিল। বিছানায় শুয়ে তখন ছটফট করছিলাম। তবে, বিকেলের দিকে একটু সুস্থবোধ করায়, রামুদাকে ওর বাসায় ফিরে যেতে বললাম। সন্ধ্যে হতে তখনো কিছুটা সময় বাকি, পশ্চিম আকাশে সূর্যটা প্রায় ঢলে পড়েছে। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে উঠোনে এসে দাঁড়ালাম। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে একটা ঝড়ো হাওয়া এসে আমার মুখে লাগল। এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলগুলো চোখের সামনে থেকে সরাতে সরাতে যখন ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন সামনের দড়িতে ঝোলানো আমার জামাটা, ওই মুহূর্তে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। জামাটা হাতে নিতেই চমকে উঠলাম। গতরাতের সেই দৃশ্যগুলো আবারও আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। হ্যাঁ! ছিটকে আসা রক্তের দাগগুলো জামাটায় তখনো লেগে।
(সমাপ্তি)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।