• Uncategorized
  • 0

যমুনাবতীর গল্পে রঞ্জনা বসু

প্রবাসী

ট্রেন থেকে নেমে রহিত প্রায় আধ ঘন্টা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। চিনতে পারছেনা কিছুই। প্রায় পনের,ষোল বছর পর এল সে এই গ্ৰামে। যে চাঁপাতলা সে চিনতো__এটা সেই চাঁপা তলা নয়। সময়ের বিন্যাসে,স্মৃতির যন্ত্রনায় চাঁপাতলা তার কাছে বিলীন। বাল্যের, কৈশরের, যৌবনের স্মৃতি ভারাতুর চাঁপাতলাকে সে আর খুঁজে পাচ্ছেনা।
সামনের রাস্তাটা তাকিয়ে দেখতে দেখতে রোহিত, সিগারেটের প্যাকেটটা বার করে। একটা টোটো এসে সামনে দাঁড়ায়।
কোথায় যাবেন?
রোহিত ফিরে আসে বাস্তবে। রাস্তার উল্টোদিকের বস্ত্র বিতানের গদিতে বসে শঙ্কর লক্ষ্য করছে রোহিতকে।
কি চায় লোকটি ? কেন এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে? সাধারণত ট্রেন থেকে নেমে সকলের তাড়াহুড়ো থাকে গন্তব্যের জন্য।
নিরুত্তর দেখে টোটো চালক আবার প্রশ্ন ছোঁড়ে, আপনি যাবেন কোথায়?
চাঁপাতলা_
চাঁপাতলা? এটাই তো চাঁপাতলা।
তাই নাকি? সিগারেটে লম্বা টান দেয় রোহিত।
কেন, আপনি সাইনবোর্ড দেখেননি ? দু একজন এসে দাঁড়িয়েছে।
একজন বলল,তুই রোহিত না? মনে হল, রোহিতের গালে কেউ থাপ্পড় মারলো। আগন্তুক কে ? তার নাম জানলো কিভাবে ? তার ওপরে তুই তোকারি! কই, সে তো চিনতে পারছেনা। কলকাতার নামী কলেজে পড়াশোনা, তারপর বিদেশে আজ কত বছর হয়ে গেল। চিনতে পারার কথাও নয়।
আমি শঙ্কর রে, প্রাইমারি স্কুলে একসাথে পড়েছি।
রোহিতের মনে পড়লো।
তাহলে চিনেছিস। আমি তোকে দেখেই চিনতে পেরেছি। এই যে সহদেব কাকা, চিনতে পারলেন,সীতাংশু কাকার ছেলে রোহিত।
রোহিত পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে।
তোমার বাবা,মা কেউই আর নেই। যদি অন্য কোথাও যাবার কথা না থেকে থাকে তবে এসো,আমার বাড়িতেই চলো।
রোহিতের বাবা, মা দুজনেই গত হয়েছেন। এতদিন এই সহদেব কাকাই পাশে ছিল। শুধু তাই নয়, তার উচ্চশিক্ষার জন্য বাবার হাতে পাঁচ লাখ টাকা এই সহদেব কাকাই তুলে দিয়েছিলেন। আবাল্যের বন্ধু সীতাংশুর সাথে কথা হয়েছিল, তাদের পুত্র আর কন্যার চার হাত এক করে দিয়ে তারা বাকি জীবন তীর্থ ভ্রমণ করবেন।
রোহিতের কারণে সে কথা রাখা সম্ভব হয়নি। এক বিদেশিনীকে বিয়ে করে, সে দেশেই থেকে যায় রোহিত। যোগাযোগ কমে আসে। কিন্তু আজ রোহিত সেখানে গিয়ে উঠবে কি করে? অসম্ভব জড়তা এসে গ্ৰাস করে। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়, বুঝতে পারেনি।
উঠোনের আম গাছটায় প্রচুর আম ধরেছে। পুকুরটার কথা মনে হলো।
সহদেব বলে,বাবা, তুমি কি কোন কাজে এসেছো ?
রোহিত একটু চমকে ওঠে। বলে, হ্যাঁ, কাকাবাবু _
আপনি আমাকে সবকিছু সময় মতোই জানিয়েছিলেন, আমার পক্ষে তখন আসা সম্ভব হয়নি।
সেসব কথা থাক বাবা, যা আজ অতীত হয়ে গেছে,তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে কি লাভ ? আমাকে যদি তোমার প্রয়োজন হয়, তাহলে জানাতে সঙ্কোচ বোধ করোনা। রোহিতের খুব জানতে ইচ্ছে করে,রুমি কেমন আছে। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও তা পারলোনা। একসময় বলল, কাকাবাবু,আজ বিকেলের গাড়িতে আমি কলকাতায় ফিরে যাব। এদেশে আর হয়তো আসা হবেনা। আমার ইচ্ছে বাবা, মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই বাড়িতে একটা প্রাইমারি স্কুল গড়ে উঠুক। আমি দানপত্র করে দিতে চাই। বাকি সব দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। সহদেব একটু অবাক হল। এই ইচ্ছের কথা তো সীতাংশু অনেক আগেই জানিয়েছিল। রোহিতের সিদ্ধান্ত জেনে খুশি হলেন। বললেন, তোমার বাবার সেই ইচ্ছেই ছিলো। তুমি যখন আগ্ৰহী, কথা দিলাম এই দায়িত্ব আমি নেব। তুমি তোমার পছন্দ আমাকে জানিয়ে দিও।
রুমি দুকাপ চা নিয়ে এলো। রোহিত চেয়ে দেখে,সে একইরকম আছে। সেই রঙ,টানা টানা চোখ, ছিপছিপে গড়ন আর মাথায় লম্বা বেণী। বিয়ে হয়েছে কিনা বুঝতে পারে না। তার সিঁথিতে সিঁদুর ছিল না।
দুপুরে খেতে বসে রুমিকে সেকথা জিজ্ঞেস করায়, রুমি বলে, বিয়ে তো একবারই হয়, রোহিত দা। সে কথা কি তুমি জানো না ?
রোহিত একটু ধাক্কা খেল। সেই কবে ছেলেমানুষি করে দুটি মন বিয়ের খেলা খেলেছে, তাকেই রুমি এত মর্যাদা দিয়ে ভরিয়ে রাখে !
রোহিত লজ্জিত হয়। সেটা রুমি টের পায়। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে, তুমি এখানে স্কুল তৈরি করবে শুনে খুব আনন্দ পেলাম। মা, চলে যাওয়ার পর থেকেই ভাবছিলাম, জ্যাঠামশাইয়ের ইচ্ছেটা যদি রুপ পেত।
আমি তোমাকে কথা দিলাম, রোহিত দা _
আমরা বাপ আর বেটিতে মিলে এ কাজ সম্পূর্ণ করবই।
সেকথা শুনে, রোহিত বললো, আমাকে নিশ্চিন্ত করলে, তুমি। মনে মনে বলে, এতে পাপের ভার যদি একটু লাঘব হয়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।