।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় রক্তিম ভট্টাচার্য

খারাপ হওয়ার পুরস্কার

(১)

আজ ঘুরতে এসেছি একটা নতুন পাড়ায়। পাড়াটার নাম খারাপ পাড়া। নামেই বোঝা যাচ্ছে, পাড়াটায় ভালো কিছুই নেই। সেখানকার জল-হাওয়া খারাপ, মানুষ খারাপ, বাড়িঘর খারাপ, খাবারদাবার খারাপ। মোট কথা, সব খারাপ। তাও এসেছি কেন? এসেছি একটু স্বাদবদল করতে। আমি বড্ড ভালো মানুষ। লোকে বলল, এত ভালো মানুষ আজকের দিনে থাকা উচিৎ নয়। তাই দেখি, কিছু খারাপ নিয়ে ফিরতে পারি কিনা। সন্ধান পেলে ভিডিও-র নীচে লিঙ্ক দিয়ে দেবো, যারা যারা নিজেদের ভীষণ ভালো মানুষ মনে করেন, একটু ঘুরে আসতে পারেন।
এই বলে সেলফি ভিডিও বন্ধ করে ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে পা দিলাম পাড়ার ভেতরে। ঢোকার পর থেকে মেজাজ খিঁচড়ে গেল। জঘন্য রাস্তা, সাবধানে চললেও স্লিপ খাওয়া অনিবার্য। বারপাঁচেক গড়াগড়ি খেয়ে পাড়ার ভেতরে ঢুকতে দেখি, গাদা মানুষের জটলা। লুঙ্গি, জাঙিয়া, গামছা পরে ঘুরঘুর করছে, গুটখা চিবোচ্ছে, নখ খাচ্ছে। কেউ আমার দিকে দেখছে না একবারও। স্বাভাবিক ব্যাপার, কে আর যেচে পড়ে নিজের খারাপাবস্থা দেখাতে চায়?
খানিক এগিয়ে যেতে দেখি খুপড়ি খুপড়ি ঘরদোর, এক্কেবারে হেগেমুতে রাখা এলাকা। গরু, বাছুর, ষাঁড়, শুয়োর কী নেই!! পর্দা সরিয়ে সরিয়ে দেখলাম ঘরগুলোও অতীব নোংরা, একটি ঘরেই খাওয়া পরা রান্না সবকিছুর ব্যবস্থা। দেওয়ালের রং একেবারে চটা, ইঁট-পাঁজর, কাদামাটি দেখা যাচ্ছে। একটা ঘর একটু পরিষ্কার তার মধ্যে, আতিশয্যে পর্দা সরিয়ে দেখি রোগা প্যাংলা উলঙ্গ একটি মেয়ে একটি ততোধিক প্যাঁকাটি উলঙ্গ ছেলের গায়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। দেখামাত্র চোখ ফিরিয়ে দৌড়ে এলাম। ইসসস্, এত নোংরা জায়গাও হয়!! আগে জানলে পা মাড়ানোর কথাও ভাবতাম না। কোনো সুস্থ মানুষ এখানে থাকতে পারে?
ছবি তুলতে তুলতে আরো এগোচ্ছি। একটা লঙ্গরখানা জাতীয় কিছুতে মানুষের লাইন। কারোর হাতে ধুলোমাখা শালপাতা, কারোর হাতে তেবড়ানো বাটি, কৌটো। পাতলা পায়খানার মতো ডাল, আর কালো মোটা ভাত দিচ্ছে একটা কালো লোক। দিতে দিতে আবার বগল চুলকোচ্ছে। দেখেই আমার বমি পেয়ে গেল। কোনোমতে ছবিটা তুলে সেখান থেকেও পালিয়ে এলাম।
এলাকায় গাছপালা প্রায় নেই, সব নিয়ে গেছে কেটে কাঠের প্রয়োজনে। মাঝেমাঝে আগাছাভর্তি খানিকটা জায়গা, সেখানে কুকুর, গরু, ছাগলের পায়খানা ছেতরে পড়ে আছে। দেখলেই গা ঘিনিয়ে ওঠে। লেন্স ফিট করে চোখ বন্ধ করে ছবি তুললাম। একটা গরু খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করছে রাস্তার ওপরেই। আশেপাশে দুয়েকটা লোক দেখেও তাড়ানোর নামগন্ধ নেই। কালো কালো হাড়জিরজিরে লোক সব, ফ্যাকফ্যাক করে হাসছে আর গপ্প করছে, মাঝে একবার করে মুখে কুলকুচি করে ফ্যাচ করে পিক ফেলে গালের ভেতরটা চেটে নিচ্ছে।
নোংরা আর অশিক্ষার চরম এলাকা এই পাড়া। সত্যিই খারাপ পাড়া বটে। খারাপ তো নয়, একেবারে জঘন্যতম। একটা কিছু সংগ্রহ করার মতো নেই। আমি ভালো মানুষ। ভীষণই ভালো। ভালোত্বের জন্য শ্রেষ্ঠ ভালোমানুষের পুরস্কারও পেয়েছি বঙ্গীয় নির্মল মানবসমিতির পক্ষ থেকে। সে কিনা এখান থেকে খারাপ কিনবে? নিজেকে একটু খারাপ করা ভালো, তা বলে এইভাবে? প্রশ্নই ওঠে না। প্রদর্শনীটা পুরো মাঠে মারা গেল। ওহো, বলাই তো হয়নি, আসলে আমার এখানে আসা শুধু লোকের কথায় নয়। আসল উদ্দেশ্য হল, একটা প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করা। সেখানে বিগত একদশকের নব্য খারাপ হওয়া মানুষের অভিজ্ঞতা জানা হবে ইন্টারভিউ-এর মাধ্যমে। কী কী খারাপ শিখল, তাকে বাস্তবজীবনে কাজে লাগালো, এসব জানাতে হবে। যাতে আরো কিছু প্রচন্ড ভালো মানুষ খারাপ হওয়ার ইন্সপিরেশন পান। পৃথিবীটা বড্ড কষ্ট পাচ্ছে এত ভালো মানুষের সমারোহে, ব্যালেন্স নষ্ট হচ্ছে। তাই এত কিছু আয়োজন।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, আমি আর পার্টিসিপেট করতে পারবো না। হঠাৎ দেখি আমার ডানপাশে একটি মেয়ে, চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে একটা তাজ্জব দৃষ্টি। এত খারাপ মানুষের ভিড়ে একটা ভালো মানুষ দেখে বিহ্বল হয়ে গেছে। বয়স ওই চার-পাঁচ হবে, একটা ছোট্ট প্যান্ট, ঊরুটা চকচক করছে। একটা কাঁধকাটা ময়লা গেঞ্জি, বুকের কাছে ফুল আঁকা। দেখেই মনটা পুলকিত হয়ে উঠল। একটা চমৎকার ফন্দি মাথায় এলো। ভাবলাম, এ তো বেশ অভিনব ব্যাপার হতে পারে! সবাই খারাপ হওয়ার অভিজ্ঞতা বলবে, আর আমি বরং খারাপ মানুষের পাড়ায় কুড়িয়ে পাওয়া একটা ভালো জিনিসের কথা বলব। বিষয়টা বেশ ইন্টারেস্টিং ও অন্যরকমের হবে।
ভাবামাত্রই এগিয়ে গেলাম মেয়েটার দিকে। এখনও সেই অবাকদৃষ্টি। বেশী কথা বললাম না, গাল টিপে কোলে নিলাম‌। মেয়েটি আপত্তি করল না। আশপাশে কেউ দেখে ফেলার আগেই দৌড়ে গেলাম একটা ঝুপড়ির দিকে। কেউ নেই এদিকটায়। চটপট মেয়েটার গেঞ্জি আর প্যান্টটা খুলে ফেললাম। নিপুণ ডাঁশা শরীর। মনটা ছটফট করছে। ক্যামেরায় ছবি তুললাম কয়েকটা। তারপর ব্যাগে ঢুকিয়ে আমারও প্যান্টের চেনটা খুলে মেয়েটাকে কোলে বসিয়ে দোল খাওয়াতে লাগলাম। মেয়েটা একটুও আপত্তি করল না। আমারই কেমন অবাক লাগতে শুরু করল। আবার দারুণ অনুভূতিও হচ্ছে। বেশ আরামেই বীণা বাজাতে লাগল মেয়েটির শরীর, আর প্রাণ ভরে সে মধুরধ্বনি আস্বাদন করতে লাগলো আমার শরীর।
(২)
দু-মাস পরের এক সন্ধ্যা। ইন্ডিয়ান গুডডেভিল অডিটোরিয়াম, নিউ আলিপুর, কলকাতা। আলো ঝলমলে স্টেজে একটু আগেই প্রায় চল্লিশ জন শেয়ার করেছে তাদের অভিজ্ঞতা। ভিডিও, ছবি যা ছিল তাদের কাছে প্রোজেক্টরে দেখানো হয়েছে। সবাই ধন্য ধন্য করেছে। অংশগ্রহণকারীদের একজনকে আমার ভীষণই চেনা লাগছে, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না কোথায় দেখেছি।
অনুষ্ঠান প্রায় শেষের পথে। সঞ্চালক এবার ঘোষণা করবেন শ্রেষ্ঠ নব্য খারাপ হওয়া মানুষের নাম। পুরো অডিটোরিয়াম জুড়ে ভালো মানুষের ঢল অপেক্ষা করছে, তাদের আগামী আইডলের নাম শুনবে বলে। স্পটলাইট নিভে গেলো, থমকে দাঁড়ালো শতশত মানুষের হৃদস্পন্দন।
“ভিখু মাহাতো! আজকের বিজেতা ভিখু মাহাতো, তিনি এসেছেন খারাপ পাড়া থেকে। সবাই জোরালো করতালিতে তাঁকে অভিবাদন জানান”। সঞ্চালকের ঘোষণা শেষ হতেই চমকে উঠলাম। এ তো সেই খারাপ পাড়ার বাসিন্দা। স্পষ্ট মনে পড়ছে, এঁকে আমি দেখেছি সেই‌ ঘরটিতে। একটি উলঙ্গ মেয়ের সাথে। এই তো সেই রোগা ঢিকঢিকে চেহারা, আর লম্বা লম্বা কাঠির মতো হাত পা। এ এমন কী কাজ করল, যে শ্রেষ্ঠ সদ্য খারাপ হওয়া মানুষের পুরস্কারে ভূষিত হলো?
ততক্ষণে আলোতে ঝকঝক করছে গোটা স্টেজ, উদ্ভাসিত পুরো অডিটোরিয়াম। এরপর সঞ্চালক ভিখু মাহাতোকে তাঁর অভিজ্ঞতা শোনাতে ডাকলেন। মাইকটা অপটু হাতে ধরে খসখসে গলায় ভিখু মাহাতো বললেন, “সবাইকে নমস্কার। কমিটিকে ধন্যবাদ আমাকে এই পুরস্কারে বাছার জন্যে। খারাপ পাড়ায় কোনোদিন কেউ মিথ্যে কথা বলেনি, কোনো চুরি ডাকাতি খুন ধসসন হয়নি। আমিই পোথোম আমার বউয়ের সাথে…ইয়ে মানে… ওই একটু … ওইসব করি। তবে আমাদের বিয়ে হয়নি। আর ওর একটা আগে থেকে মদ্দ ছিল। কেউ জানতে পারেনি। সেও না। পরে জানাজানি হতে লোকে বলল, বিশাল ভুল করেছিস। বেরিয়ে যা পাড়া থেকে। ওর মরদটা আমাকে উদুম মেরে বের করে দিল। বেরিয়ে এলাম, তারপর একজনের থেকে শুনলাম এই অনুষ্ঠানের কথা। তাই ভাবলাম গিয়ে বলি। পুরস্কার পাবো ভাবিনি। সবাইকে থ্যাংকু”। হাততালিতে ভেসে গেল পুরো অডিটোরিয়াম। আমার বুকটা চিনচিন করে উঠলো। খারাপ পাড়ায় কেউ খারাপ নয়? লোকটার কথামতো, সবাই এত ভালো? অথচ সবাই খারাপ পাড়া বলে কেন? বাইরেটা দেখে? বুঝতে পারলাম না। একটা দ্বন্দ্ব কাজ করতে লাগলো। ওখানকার আরো একটা কারোর অভিজ্ঞতা পেলে ভালো হতো…
প্রশ্নগুলো মনে আওড়াতে আওড়াতেই সঞ্চালক ঘোষণা করলেন, “এবার ভিখু মাহাতোর হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হচ্ছে আমাদের কমিটির পক্ষ থেকে। স্বর্গীয় বাসুদেব আচার্য স্মৃতি পদক তুলে দিচ্ছেন বিশিষ্ট খারাপ লোক, অপূর্ব সুন্দর বংশী মহাশয়।” বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার চারপাশটা নড়ে উঠলো। আমার সামনেটা দুলছে বুঝতে পারছি কিন্তু থামাতে পারছি না। চিৎকার করার চেষ্টা করছি কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। আমি দেখতে পাচ্ছি অপূর্ব সুন্দর বংশীর পালিশ করা দুটো হাত। তুলে নিলো আমার পুরো শরীরটাকে‌। আমি কোনোভাবেই বাধা দিতে পারছি না। একটা তাণ্ডব চলছে, ভূমিকম্প হচ্ছে বুঝছি। এবার দেখছি ভিখু মাহাতোর দুটো ল্যাকপ্যাকে হাত। আমি যাবো না, কিছুতেই যাবো না। ওই নোংরা কালো কালো হাত। আমি যাবো না। তারস্বরে চ্যাঁচানোর চেষ্টা করলাম, পারলাম না। ভিখু মাহাতোর দুটো কাঠি হাত সযত্নে ধরে নিলো আমাকে। দুটো আলকাতরার মতো কালো বজ্রমুষ্টে পিষ্ট হতে থাকলাম আমি।
মাইকে ভেসে আসছে অপূর্ব সুন্দর বংশীর সুললিত কণ্ঠ, “অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, শ্রদ্ধেয় শ্রী বাসুদেব আচার্য মহাশয় আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। তিনি ছিলেন আমাদের সকলের খারাপ হওয়ার গর্ব, এক জ্বলজ্যান্ত ইন্সপিরেশন। তাঁর মতো খারাপ লোক পৃথিবীতে আর জন্মায়নি, জন্মাবেও না। এই ভিখু মাহাতোরই বাড়ি যেখানে, সেই খারাপ পাড়ায় তিনি ঐতিহাসিক খারাপ কাজটি করেছিলেন মাত্র মাসদুয়েক আগে, যার জন্য তিনি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বার্ধক্যজনিত কারণে হঠাৎ জেগে ওঠা প্রবল উত্তেজনা সংবরণ করতে না পারায় ধর্ষণকালেই তাঁর মৃত্যু হয়…”
বাকি কথাগুলো শোনা হল না‌ ভালো করে, ইচ্ছেও করল না। ভিখু মাহাতোর মুঠোতে ঘেমে উঠেছে আমার পেতলের শরীরটা। এই অপূর্বও তো খারাপ লোক, তাই সত্যিটা চেপে গেল জনসমক্ষে। নাকি জানেনা! কে জানে। সেদিনের ঘটনা আমার স্পষ্ট মনে আছে। সেদিনও ঘেমে উঠেছিল শরীরটা বড্ড, আজকের মতোই। বা, আজকের থেকে খানিকটা বেশীই। একেই আশি বছর বয়স, ওরকম কচি মেয়ে, সামলাতে পারি? কতদিনের খিদে বলুন‌ তো! কিন্তু কী বলব, হঠাৎ বাচ্চাটা কেঁদে উঠলো। আদো আদো গলায় বলল, “দাদুভাই, দাদুভাই, আমার খুব লাগছে দাদুভাই। ছাড়ো না গো আমায় দাদুভাই। তুমি আমাদের বাড়ি যাবে? তোমার আমি ছবি এঁকে দেবো। আমি খুব‌ ভালো ছবি আঁকতে পারি? দেখবে দাদুভাই?” এটা শোনার পরই আমার চোখের সামনেটা আজকের মতোই দুলে উঠেছিল। নিভেও গেছিল দুনিয়াটা আজকের স্পটলাইটের মতোই। তবে সেই আলো আর জ্বলেনি। অন্ধকার গোলকধাঁধায় শেষ আলোকবিন্দুটা মুছে যাওয়া পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছিলাম, “দাদুভাই, দাদুভাই, আমায় ছাড়ো না দাদুভাই। আমার খুব লাগছে দাদুভাই . . . আমার খুব . . . দাদুভাই. . . দাদু . . . ভা. . ই. . .”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *