T3 || ১লা বৈশাখ || বিশেষ সংখ্যায় রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথ

মানুষ ছোটবেলা থেকেই খুব সহজাত ভাবে গল্পের ভক্ত হয়ে ওঠে ৷ কথানিকা, উপকথা, লোককথা, ফার্সিগল্প, রূপকথা , কিস্সা, ইংরাজী টেল, ফেব্ল,প্যারাবেল ইত্যাদি বহু রূপে আমরা সুদূর অতীতে ছোট গল্পকে পেয়েছি ৷ অবশেষে উনিশ শতকের্ মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে আমরা স্বাক্ষী হলাম আজকের ছোট গল্পের ৷ তবে প্রাচীনকাল থেকেই কিন্তু গল্পের এই বিশেষ ধরনটির অস্তিত্ব আমরা ইতিহাসের পাতায় পাই ৷ এ এক মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, গল্প বলা এবং গল্প শোনা ৷ তাই হয়ত ইটালীয় Giesta Romanorum (1330) থেকে শুরু করে Baceaccioi Dceameron (1341-53)বাইবেল হয়ে আজ পর্যন্ত গল্প চলছে ৷ ভারতবর্ষের পুরাণ, পন্ঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ, বৌদ্ধ জাতকের গল্প, সেই একই রসে সিক্ত ৷ ফরাসি সাহিত্যের র্্যাবলে, আমেরিকার এ্যালেন পো, রাশিয়ার গোগোল, সকলেই তো ছোট গল্পের জনক নিজ নিজ দেশে ৷ তবে বিশ্ব সাহিত্যের দ্বারে ছোটগল্পের বৈদূর্যমণি যদি হয় ফ্রান্সের মোঁপাসা তবে কমল হীরের রত্নটি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷

রেনেসাঁস-উত্তরকালে, পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থার পরম বিকাশের যুগে, আধুনিক মানুষের জীবনে দেখা দেয় বহুমাত্রিক বৈচিত্র্য এবং সীমাহীন জটিলতা। আধুনিক মানবচৈতন্যের সমুদ্রবিস্তৃতি ও বিভঙ্গতা, বহুভুজ বিসঙ্গতি ও বিপর্যয়, অন্তগূঢ় বেদনা ও উজ্জ্বল আশাবাদ- এসব প্রবণতা প্রকাশের অনিবার্য মাধ্যম হিসেবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে নতুন শিল্প-আঙ্গিকরূপে ছোটগল্পের আত্মপ্রকাশ। পুঁজিবাদী সভ্যতার অভ্যন্তর সীমাবদ্ধতার চাপে, সময়ের শাসনে মানুষ যতই যান্ত্রিক হয়েছে, ছোটগল্প-সাহিত্যের বিকাশ ততই হয়েছে ঋদ্ধ। একক অনুষঙ্গের আধারেই ছোটগল্পে ফুটে উঠল পূর্ণ জীবনের ব্যঞ্জনা-পদ্মপাতার শিশিরে যেমন হেসে ওঠে প্রভাতের সম্পূর্ণ সূর্য।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ” মানুষ গল্প পোষ্য জীব ” ৷ তাঁর গল্পে বারবার সাধারণ মানুষের আত্মকথন, যন্ত্রনা, সূক্ষ্ম অনুভূতি, আনন্দবারির ছাপ প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয় ৷ তবে এই প্রেক্ষিতে কিছুটা বিস্ময়ের উদ্রেগ হয় ৷ যে রবীন্দ্রনাথ নাটকের মত বিযয় বস্তু নির্ভর শিল্পকলাকে তাঁর পরচিত সঙ্গীতের প্রয়োগে, বিষয় ভার থেকে কিছুটা প্রশমিত করেছে সেই রবীন্দ্রনাথই আবার ছোট গল্পের ক্ষেত্রে অন্তর্যামীর মত কঠিন্, কঠোর এবং উদাসীন ৷ আর তাঁর রচনার এই অকৃত্রিমতাই, তাঁর লেখাকে জীবন্ত এবং কালোত্তীর্ন করেছে ৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ” ভেবে দেখলে বুঝতে পারবে, আমি যে ছোট ছোট গল্পগুলো লিখেছি, বাঙালী সমাজের বাস্তব জীবনের ছবি তাতেই প্রথম ধরা পড়ে ৷”

সম্পর্কের টানাপড়েনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিন্যাস, সম্পর্কের জটিলতা, নির্ভরতার স্ফুরণ বারবার তাঁর ছোট গল্পের উপজীব্য বিষয় হয়ে উঠেছে ৷ তৎকালীন সমাজ ব্যাবস্হা পরতে পরতে শ্বাস নিয়েছে তাঁর ছোট গল্পের চিদাকাশে ৷ মোঁপাসা, চেকভ, গোর্কি, এলেনপোর গন্পে যে সমাজ এবং মানুষের ঐকান্তিক সম্পর্ককের বাস্তব রূপের বিশ্লেষণ এবং সৌন্দর্যের বাঙ্ময়তা রয়েছে, তার দৃষ্টান্ত সর্ব প্রথম দৃশ্যত হয় কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পে ৷

পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দর / তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয় – ছিন্নপত্রে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷ রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প লেখার সময়কালের সূচনা হয়েছিল মূলতঃ পদ্মাবিধৌত অন্ঞ্চলে জমিরারি তদারকি করার সময় ৷ এই সময়ে প্রকৃতি, নদীবক্ষ এবং মানবিক জীবন তাঁকে আচ্ছন্ন করেছিল- কথা বলে উঠেছিল অন্তরাত্মা আর জন্ম নিয়েছে একের পর এক কালোত্তীর্ণ গল্প ৷ ধীরে ধীরে বাংলাদেশের পল্লীজীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়। পল্লীজীবনের নানা বেদনা আর আনন্দ যখন তার মনকে অধিকার করে বসলো, তখন তার ভাব ও কল্পনার মধ্যে আপনাআপনি বিভিন্ন গল্প রূপ পেতে শুরু করে ।গুরুদেব বারবার বলেছেন পল্লীজীবনের হৃদয় খনন করে উঠে এসেছে তাঁর গল্পের কুশীলবেরা ৷ তাই বোধহয় তাঁর গল্প সম্পর্কে বলা হয় –
” গল্পগুচ্ছে বালকের চাপল্য এবং পৌঢ়ের জল্পনা, দারিদ্রের অশ্রু এবং ধনবানের অপব্যয়, কুমারীর অনুরাগ এবং বিধবার প্রেম সবই আছে ৷ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ দৃষ্টি কোথাও অতি নিবদ্ধ নয়….”
ত্রিশ বছর বয়সে কবিগুরু প্রথম ছোটগল্প লেখেন ৷
তাঁর প্রথম গল্প ‘ভিখারিণী’ ১৮৭৪ সালে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও ‘দেনা-পাওনা’ (১৮৯০) গল্পটিই প্রথম সার্থক ছোটগল্প। ১৮৮৪-৮৫ সময়ের মধ্যে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ঘাটের কথা’, ‘রাজপথের কথা’ ও ‘মুকুট’। গল্পগুচ্ছ, সে, তিনসঙ্গী প্রভৃতি গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের সংখ্যা ১১৯ টি ৷

বিষয়বস্ত্ত হিসেবে রবীন্দ্রনাথের গল্পে প্রেম, প্রকৃতি, মানুষ, অতিপ্রাকৃত ঘটনা, সামাজিক জীবন, নারী-পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক দিক ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। প্রেমের গল্প হিসেবে একরাত্রি, মহামায়া, সমাপ্তি, মাল্যদান, মধ্যবর্তিনী, শাস্তি, প্রায়শ্চিত্ত, দুরাশা, অধ্যাপক, নষ্টনীড়, স্ত্রীর পত্র, পাত্র ও পাত্রী, মানভঞ্জন, রবিবার, শেষকথা, ল্যাবরেটরি প্রভৃতি গল্পের নাম উল্লেখ করা যায়। প্রকৃতিবিষয়ক গল্পের মধ্যে শুভা, অতিথি, আপদ, বলাই ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব গল্পে প্রকৃতিপ্রেমিক নারী ও বালক চরিত্রগুলি, যেন প্রকৃতির সন্তান। সমাজজীবনের সম্পর্ক বৈচিত্র্য নিয়ে রচিত গল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ব্যবধান, মেঘ ও রৌদ্র, পণরক্ষা, পোস্টমাস্টার, কাবুলিওয়ালা, দিদি, হৈমন্তী, কর্মফল, দান-প্রতিদান, দেনা-পাওনা, ছুটি, পুত্রযজ্ঞ, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি। অতিপ্রাকৃত রসের স্পর্শ লেগেছে গুপ্তধন, জীবিত ও মৃত, নিশীথে, মণিহারা, ক্ষুধিত পাষাণ, মাস্টারমশাই ইত্যাদি গল্পে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম সার্থকভাবে বাংলা ছোটগল্পকে বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন।

ভাষা শৈলীর চরম উৎকর্ষতা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ছোট গল্পে ৷ বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ যে কথা কবিতায়, গানে প্রকাশ করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং যে কথা তিনি সাধারণ, সাবলীল ভাষায় বলতে পারেননি তাইই ব্যক্ত করেছেন গল্পে। তারপরও জীবনাচার, ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে না গিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন ছোটগল্পের মারাত্মক যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে তিনি নিজেই সারথী ও নিজেই অর্জুন। একটি ঘটনাকে সম্প্রসারিত করে কয়েকটি দীর্ঘ ঘটনার প্রকাশ, যে বাকময়তা, যে চলনের ভঙ্গিমা তা সত্যিকার অর্থেই সেটি বাংলা সাহিত্যের এক নতুন দরজা খুলে দিয়েছিলো।
জীবনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষের অনুভূতির সূক্ষ্ণ বিষয়গুলোকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখায় ৷ একজন সার্থক শিল্পীর মতো জীবনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষের অনুভূতির সূক্ষ্ণ বিষয়গুলোকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে শিল্পিত করেছেন। বিশেষ করে নারীর চাওয়া-পাওয়া ভালোলাগা, মন্দলাগা, তথা মনোবিশ্লেষণে তিনি একজন দক্ষ শিল্পী। তার ছোটগল্পের নারী চরিত্রগুলো আমাদের সদাজাগ্রত চিরচেনা জগতের বাসিন্দা, আমাদের একান্ত কাছের আপনজন। বাঙালি নারী সমাজের নিপীড়নের নানা চিত্র শিল্পিত রূপে প্রকাশ করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের প্রসঙ্গে ছিন্নপত্রাবলীর ১৪৯ নম্বর পত্রে লিখেছিলেন- ‘পুরোনো ইতিহাস ছিল তার হাড়গুলো বের করে; তার মাথার খুলিটা আছে, মুকুট নেই। তার উপরে খোলস মুখোশ পরিয়ে একটা পুরোপুরি মূর্তি মনের জাদুঘরে সাজিয়ে তুলতে পেরেছি তা বললে বেশি বলা হবে। ঢালচত্তির খাড়া করে একটা খসড়া মনের সামনে দাঁড় করিয়েছিলুম, সেটা আমারই খেয়ালেরই খেলনা’। (পত্র-১৪৯; ছিন্নপত্রাবলী।)
বিভিন্ন গল্পের চরিত্রের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ একসময় তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, ‘পোস্টমাস্টারটি আমার বজরায় এসে বসে থাকতো। ফটিককে দেখেছি পদ্মার ঘাটে। ছিদামদের দেখেছি আমাদের কাছারিতে’।

বিশেষ করে নারী জীবন, বাস্তবতার স্পর্শে মহিমান্বিত রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। গ্রাম্য বিধবা, গৃহবধূ, কুমারী, বাল্যবধূ, তরুণী প্রভৃতির সমাবেশ গল্পগুলো অবিসংবেদীরূপে প্রত্যক্ষধর্মী হয়ে উঠেছে। ‘দেনাপাওনা’র নিরূপমা, ‘মানভঞ্জন’র গিরিবালা, ‘মহামায়া’ গল্পের মহামায়া; ‘মাল্যদান’ গল্পের কুড়ানি; ‘সুভা’ গল্পের সুভা আমাদের সবার অতি পরিচিত নারী চরিত্র। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে প্রত্যেকটি নারী চরিত্রই স্বমহিমায় ভাস্বর। গল্পকার রবীন্দ্রনাথ তার ছোটগল্প সম্পর্কে সোনার তরী কাব্যের ‘বর্ষা যাপন’ কবিতায় বলেছেন- ‘ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা/ ছোটো ছোটো দুঃখ কথা
নিতান্তই সহজ সরল/ সহস্র বিস্মৃতি রাশি, প্রত্যাহ যেতেছে ভাসি/ তারই দু’-চারটি অশ্রুজল’।

বাংলাসাহিত্যে প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনার কৃতিত্ব যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের, অনুরূপভাবে বাংলা ছোটগল্পের সার্থক সূচনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। এই সার্থকতা এতোটাই উচ্চমানের যে, কোনো কোনো সাহিত্য বিশ্লেষক মনে করেন, শুধু ছোটগল্প সৃষ্টির জন্য রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যিক হিসেবে বিশ্বজনীন খ্যাতি ও স্বীকৃতি লাভের যোগ্যতা রাখেন। রবীন্দ্রনাথের হাতেই বাংলা গল্প হয়ে ওঠে শিল্পিত ও বহু-বর্ণশোভিত। বিষয়াংশের বৈচিত্র্যে ও আঙ্গিক-পরিচর্যার উৎকর্ষে তিনি একক সাধনায় বাংলা ছোটগল্পকে নিয়ে গেছেন শিল্পের শীর্ষচূড়ায়। বস্তুত রবীন্দ্রপ্রতিভার স্পর্শেই বাংলা ছোটগল্প বিশ্ব-ছোটগল্পের আসরে অর্জন করেছে সম্মানের আসন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।