সম্পাদিকা উবাচ

” তাদের আসার অপেক্ষায় আমি এখানে বসে আছি। আমাকে বা আমার পরিবারকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই; তারা আমার মতো মানুষের জন্য আসবে এবং আমাকে হত্যা করবে।’ তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর এভাবেই নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন আফগানিস্তানের প্রথম নারী মেয়র, খ্যাতনামা অ্যাক্টিভিস্ট ও রাজনীতিক জারিফা গাফারি। টুইটারে দেওয়া এক পোস্টে গাফারির এমন মর্মস্পর্শী অভিব্যক্তি তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক এলিফ শাফাক। বলেছেন, আফগান নারীদের কান্নার কাছে সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়।
বিবিসির প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় স্থান পাওয়া জারিফা গাফারির মতো রাজনীতিকের যদি এমন দশা হয় তাহলে কেমন আছে আফগানিস্তানের সাধারণ নারীরা?
আফগানিস্তানে তালিবানের একের পর এক শহর দখল করার সঙ্গে সঙ্গে মহিলাদের স্বাধীনতা ক্রমশই খর্ব হচ্ছে। প্রকাশ্য রাস্তায় যেমন মহিলাদের নিগ্রহের দৃশ্য ধরা পড়েছে তেমনি কান্দাহারে ইতিমধ্যে কর্মরত মহিলাদের চাকরি ছাড়ার নির্দেশ এসেছে। আজিজি ব্যাঙ্কের ৯ জন মহিলা কর্মীকে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে। তাদের জায়গায় কাজ করতে পারবে তাদেরই কোনো পুরুষ পরিজন।
ব্যাঙ্ক ম্যানেজার পদে কর্মরত মহিলারা জানিয়েছে বন্দুকধারী উগ্রপন্থীরা তাদের বাড়ি পৌঁছে দেয়, এবং জানায় আর যেন কাজে আমরা না যাই। তালিবান আসা মানেই নারীদের অধিকার ও অবস্থা চরম অবনতি হবে। এই আশঙ্কাতে বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্য চাইছে আফগান মহিলারা। ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত তালিবানরা ছিল আফগানিস্তানের ক্ষমতায় সেই সময় শুধু মহিলাদের চাকরি নয়, মেয়েদের লেখাপড়া, স্কুলে যাওয়া ও অস্ত্রোপচারের সময় আনাস্থেসিয়া না করার মতো নিদান দেয়। ফের সেই ভয়াবহ দিন আসতে চলেছে।
যদিও রাজনৈতির মঞ্চে মহিলাদের সম অধিকার দেওয়ার বিষয়ে কথা বলেছে তালিবান। কিন্তু তা যে নিছকই মুখের কথা তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত।
শরিয়া আইন যাকে আদতে বলা হয় ‘‌ইসলামিক আইন’‌। তালিবান নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে নারীরা। মেয়েরা কিসের আর অধিকার পাবে? তালিবান বলেছে, শরিয়া আইন অনুসারে আফগানিস্তানে মেয়েরা অধিকার ভোগ করবে। বলেছে, মেয়েরা কাজ করবে কিন্তু শরিয়া আইন মেনে সবকিছু।
তালিবান নিজেদের মতো করে শরিয়া আইনের ব্যাখ্যা করে। এই অধিকার কিসের অধিকার? নারীর আর অধিকার বলে কোন জিনিস থাকল না। তালিবান শাসনে শরিয়া আইন অনুসারে মেয়েদের অধিকার ভোগ করার চেহারাটা ঠিক কেমন হতে পারে; কিরকম হতে পারে সেই ভয়াবহ চেহারাটা কেমন হতে পারে সেটা দেখে নেওয়া যাক –
নারী কি বাজারে যেতে পারবে?
হ্যাঁ যেতে পারবে। জেনে রাখা প্রয়োজন, তালিবানের আগের শাসনে এ ব্যাপারে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। মেয়েরা বাজারে যেতে পারবে। কিন্তু মেয়ে যখন বাইরে বেরোবে তার সঙ্গে থাকতে হবে এক জন পুরুষকে সেটা প্রাপ্তবয়স্কই হোক বা নাবালক– অর্থাৎ লিঙ্গে যেন সে পুরুষ হয়।
ভাবতে বাধ্য হচ্ছে নারীরা।
আরো প্রশ্ন— মেয়েরা কি বন্ধুদের সাথে বাইরে বেড়াতে যেতে পারবে?
আগের শাসনে মেয়েদের কার্যত ঘরবন্দি থাকত। বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে কোন জায়গায় ঘুরতে যেতে পারত না।
পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে কোন মেয়ে কি দেখা করতে পারে? কি করতে পারে মেয়েরা?
পরিবারের সদস্য নয় ১২ বছরের ঊর্ধ্বে এমন কোনো পুরুষের সাথে মেয়েরা দেখা করতে পারে না।
শিক্ষার ব্যাপারটা কী হবে? মেয়েদের কি শিক্ষার অধিকার আছে?
হ্যাঁ, মেয়েদের শিক্ষার অধিকার রয়েছে। তবে সেটা থেকেও না থাকার মতোই। তবে নাবালক, পুরুষরা যেখানে পড়াশোনা করতে পারে সেই স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসায় পড়ার কোন অধিকার নেই মেয়েদের। এই তো আগেই বললাম, এই অধিকারের মূল্য কোথায়?
আর মেয়েদের মেক আপের ব্যাপারটা কী? আগের শাসনে তালিবান মেয়েদের মেক-আপ ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করেছিল।
শরিয়া আইন অনুসারে সঙ্গীত নিষিদ্ধ। মারাত্মক অবস্থা। কীভাবে জীবন যাপন করবে নারী?
তালিবান বলেছে, মেয়েদের কাজ করতে অনুমতি দেওয়া হবে। তবে আফগানিস্তান থেকে পাওয়া রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, ব্যাঙ্ক ও সরকারি অফিসের মহিলা কর্মীদের তালিবান এসকর্ট করে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে। বলা হয়েছে, তাদের জায়গায় পুরুষ আত্মীয়রা কাজকর্ম করতে পারেন। ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি কোন দিকে গতি করছে? মেয়েরা কোনরকমভাবে নিজের সৌন্দর্য দেখাতে পারবে না। যতরকমভাবে মেয়েদের নিষিদ্ধ করে, বন্দী করে রাখা যায় সেটাই করেছিল। এবং সেটাই করছে।
হাই হিল জুতো পরা তালিবান শাসনে নিষিদ্ধ হয়েছিল। মেয়েদের এমন ভাবে হাঁটতে হবে– কোনো পুরুষ তাদের পায়ের শব্দ শুনতে না পায়।
শরিয়া আইন ভাঙলে তালিবান দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারে। আগের শাসনে শরিয়া আইন অনুযায়ী বিভিন্ন অপরাধের ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রকাশ্যে জনতাকে দিয়ে হেনস্থা-নির্যাতন করা হত, মেয়েদের অবস্থা তছনছ হয়ে যায়। বেত মারা হত বা পাথর ছুড়ে হত্যা করা হত।
মার্কিন দেশ আফগানিস্তান দখল নেওয়ার পর, চায়না তলে তলে তালিবানদের শক্তি যুগিয়েছে। ফলে মার্কিন সৈন্যবাহিনীর পেছনে খরচ প্রচুর বেড়ে গেছে। আজ মার্কিন অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মার্কিন দেশের পক্ষে এই খরচ চালানো সম্ভব নয়। ফলে তারা ভেতরে ভেতরে তালিবানদের সাথে রফা করে নিচ্ছে। আবার উল্টোদিকে আফগানিস্তানের সরকারকেও তার দরকার এই চত্বরে চায়না বিরোধী অক্ষ ধরে রাখার জন্য। যার ফলে বারবার তারা চেষ্টা চালাচ্ছে আফগানিস্তান সরকার ও তালিবানদের মধ্যে শান্তি চুক্তি করে একটা সূত্র বার করা। কিন্তু তাদের এই চেষ্টা বানচাল করে দিচ্ছে চায়না। ফলে এই এলাকার ভবিষ্যৎ কি হবে? তবে এটুকু বোঝা যাচ্ছে চায়না-তালিবান অক্ষ শক্তিশালী হওয়ার ফলে এই এলাকায় নারীদের উপর, গণতন্ত্রের উপর এবং শিক্ষিত মানুষদের উপর আক্রমণ বেড়ে যাবে।
তাহলে আফগানিস্তান দখল করার আগে তালিবানদের দ্বারা নারীদের উপর অত্যাচারকে সামনে এনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে প্রচার গড়ে তুলেছিল, যে জনমত গড়ে ছিল সেগুলো Eyewash ছসল ? যে চায়নায় দাঁড়িয়ে মাওসেতুং বলতো- নারীরা পৃথিবীর অর্ধেক আকাশ। চায়না আজ সেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পথ ছেড়ে মার্কিন দেশের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে তালিবানদের নিয়ে। এই দুই খেলোয়াড়ের খেলায় আফগানিস্তানের নারীর ভাগ্যাকাশে আজ মধ্যযুগীয় অন্ধকার নেমে এসেছে। কিন্তু আফগান নারীরা তাদের মতো করে সংগঠিত হবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বের নারীদের আজ একত্রিত হয়ে এদের প্রতি সহানুভূতি জানানো উচিত এবং সমর্থন করা উচিত। প্রতিবাদ করা উচিত৷ তবেই আফগান নারীর ভাগ্যাকাশে নতুন সূর্যোদয় ঘটবে।
সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন লিখতে থাকুন পড়তে থাকুন ৷

রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।