সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ১৪)

পিরিচ পেয়ালার ও একটি সন্ধ্যা

পিরিচ পেয়ালার ঠুংঠাং- এ ভরে ওঠে সন্ধ্যা, সাথে ভীমসেন মেজাজী আড্ডা৷ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী কচ্ছ থেকে কোহিমা গোটা ভারতটা ঘুরে ফেলি কিংবা বলা কি যায় গোটা পৃথিবীটাই হয়ত ঘুরে ফেলি আমরা আড্ডা দিতে দিতে৷ আর বিষয়? সম্পর্ক থেকে রসায়ন, রাজনীতি থেকে সংস্কৃতি কোন বিষয়ে আলোচনা হয় না বলুন তো এই আড্ডায়! যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বারেবারে ধরা পড়ে পিরিচ পেয়ালার এই সন্ধ্যার আড্ডায়৷

তেমনই এক সন্ধ্যায় জীবন আগুনকে নিয়ে বাঁধল গোল৷ কোনটা ভুল আর কোনটা অন্যায় তাই নিয়ে চলল বিস্তর তর্ক৷
একেবারে চুলচেরা বিচার৷ নিত্তি মেপে এগানো৷ সমানুপাত ব্যস্তানুপাত কিছু কি বাকি থাকল? আমার আবার হিসেব কষাকষির এমন বহর দেখলে কেশব চন্দ্র নাগের কথা ভারি মনে হয়৷ আর ঐ বাঁদরটার কথা
তেল মাখা ডান্ডায় কিছুটা উঠছে আবার স্লিপ করে ততটাই নেমে আসছে৷

গ্রীষ্মের পৃথিবীর রৌদ্র স্নান দেখতে দেখতে, সংসারের ক্ষতগুলো চোখে পড়ে যায়৷ শাদা কাপড়ের ওপর গয়না বড়ি দিতে দিতে এলোপাথাড়ি চিন্তায় ঠাকুরদার মুখ মনে পড়ে৷ স্বর্ণ চাঁপার মত উজ্জ্বল কন্দর্পকান্তি ঠাকুরদা চিরকাল আলো বুনছেন৷ আর আমরা সেই আলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে মেখেছি৷ পিপল গাছের ছায়ার সঙ্গে তার ভারি মিল৷ এমন এক আশ্রয় যেখানে বড়ে গোলাম আলি, ছিনাথ বহুরূপী, লাঠি লজেন্স, পায়রা ওড়ানো, দারিক ঘোষের দই, নকুরের সন্দেশ সব যেন মেলা সাজিয়ে বসে আছে৷ জলচৌকির ওপর সন্ধ্যা নামলে আফিমের নেশায় রেগম আখতারের গান যেন ঠাকুরদার কুড়িয়ে পাওয়া চোদ্দ আনা৷

খড় বিচালির গাদায় রাতের ভেজা শরীর থেকে জোনাকিরা আদর চুরি করে৷ খিলানের মাঝ বরাবর হেঁটে যাচ্ছে আতসকাঁচের মত সময়ের স্ফটিক কায়া৷ মৌচটকা আবেশে বুঁদ হয়ে গাভিনটা আরও একবার গুটিয়ে নেয় নিজের শরীর, যেন তার আসন্ন সন্তানকে আরও নিবিড় করে গচ্ছিত রাখে গর্ভগৃহের আতুরঘরে৷ অভিসারী চাঁদের বুড়ির মাথায় তখন মায়াবী মুকুট৷ চড়কার সুতোয় সুতোয় আহ্লাদী মন কেবল মোমের মত গলতে থাকে৷

বর্ষার প্রথম সকাল কিংবা বসন্তের প্রথম সন্ধ্যা আমাকে বারবার অসহায় করে৷ বুকের মাঝখান থেকে একটা নদী বেরিয়ে তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে, কখন যে তা একটা আস্ত পলাশ গাছ হয়ে উঠেছে টেরই পায় নি৷ গীতবিতান থেকে শব্দরা বেরিয়ে এসে মেহফিল সাজিয়েছে৷ চাঁদটা ছেলেমানুষের মত খেলে বেড়ায় কোপাইয়ের জলে৷ প্রতিটা সম্পর্কে একটা আড়াল ভীষণ দরকার৷ প্রেমিকের চোখদুটোয় বেগম বাহারের লজ্জা দেখলে, আমি রডেডেন্ড্রন খুঁজতে থাকি৷ আমার প্রেম, আমার ঈশ্বরের সাথে প্রতিদিন দৃষ্টি বিনিময় করি৷ বোঝাতে পারিনি প্রতিটি ভোরে, প্রতিটি পৃথক প্রেমে, তোমার প্রতিভূ খোঁজা আমাকে বহুচারী করেছে ৷ শরীরে কলঙ্কের জালকাঠি বেঁধে অপাপবিদ্ধ সারসের মত বারবার বদল করি বাসা ৷ .ঘর বাঁধার আশে বারবার আগুন ক্রীড়া ৷

শৈশবে ঠাকুরদার দেওয়া আগুন ফুরিয়ে আসছে প্রতিদিন৷ তোমাকে ঘিরে যে আগুন তাকে আমি বৈভব বলি৷ মন্দ্রপূত চন্দ্রহার থেকে রেশমী রুমাল উড়ে এসে ঢেকে দেয় জীবনের আঘ্রাণ৷ অসূয়া বাসা বাঁধে উড়ন্ত উঠোনে৷ উনুনের ঝিকের ওপর একান্নবর্তী হাঁড়ি আর নেই৷ অসংলগ্ন সময়ের শিকড় বেয়ে দিনগত পাপোক্ষয় জমা হয়েছে কলতলার এঁটোকাটার পাঁজায়৷ আমাদের রামধনুর মত দিনগুলো বড় ক্ষয়িষ্ণু৷ চাইলেও, তাদের পায়ে শেকল পরিয়ে আটকে রাখা যায় না ৷

কমন্ডুলে রাখা শান্ত জলের মত কবে কখন তোমার আমার সম্পর্ক আজন্মকাল আবদ্ধ থাকলো ?

আসছে সপ্তাহে আমাদের সন্ধ্যার আড্ডায় আবার কী নিয়ে দক্ষযজ্ঞ বাঁধে দেখি! চিন্তা করবেন না, একেবার সেই বিষয়টা নিয়েই চলে আসব আগামী সপ্তাহে ” পেয়ালা পিরিচ ও একটি সন্ধ্যা”-র পরের পর্বে৷ ভালো থাকুক সকলে৷

*বিঃদ্রঃ পেয়ালা পিরিচ সহযোগে সন্ধ্যায় আপনিও জমিয়ে আড্ডা মারুন

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।