T3 || আমার উমা || বিশেষ সংখ্যায় রক্তিম ভট্টাচার্য

ভ্রমের দ্বিতীয় সন্ত্রাস

ছোট্ট স্টেশনটার সিঁড়ি বেয়ে প্ল্যাটফর্মে উঠে দাঁড়াতেই একটা শব্দ করে আমাকে ডেকে উঠল ছায়াটা। ছায়া কথা বলতে পারে না ঠিকই, তবে কখনও মানুষকে টেনে দাঁড় অবশ্যই করিয়ে দিতে পারে। আমি আমার স্বভাবমতো অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম পেছনে, নীচের দিকে। ছায়াটা আমার দিকে দেখছে শূন্য দৃষ্টিতে। যেন সে প্রত্যাশাই করেনি যে আমি তার ডাকে সাড়া দিয়ে থেমে যাব। তার ঘোলাটে মুখে অনেক কথা জমে আছে, বুঝতে পারছি। কিন্তু সে অপেক্ষা করছে আমার পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার।

কমলালেবুর মতো সূর্যটায় ফাটল ধরছে। রোদ ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে ওভারব্রিজের ওপর। শিউরে শিউরে উঠছে কাক-চড়াই-শালিকদের পরিবার। তাদের ছায়ারাও হঠাৎ কোনো আঘাত পেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অতর্কিতেই। মানুষের চোখে চোখ রেখে দুলে যাওয়া ওভারহেডের তারগুলো যন্ত্রণার অভাবে নিরূপায়, স্থির। তাদের কেউ স্পর্শ করবে না কোনওদিন- সরকারি নিদান। তারা অচ্ছুৎ- এই ভাবনায় অচেনা রাগে ফেটে পড়ে আচমকা। আকাশ থেকে টেনে আনে অশনি-ঝঞ্ঝা। তারা বিষপুত্র- তাদের বুকে কোনও চোরা ভালোবাসা আছে কি না, পরীক্ষা করতে গিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে স্বর্গবাস করেছে উদাসীন কাকেরা।

এখন তারের দিকে চেয়ে আছে আমার বিষণ্ণ ছায়া। একবার আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার আকাশের দিকে। কেঁপে কেঁপে উঠছে সহসা। আমার ইচ্ছে করে, একা একা ঘুরি। কিন্তু ছায়াসঙ্গী থাকার অভিশাপ এত মারাত্মক- কে জানত! আমি অন্য কিছু দেখার চেষ্টা করতে থাকি।

একটা সময় সঙ্গীর অভাবে কাতর আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতাম স্টেশনে। কল্পনা করতাম, পাঁচটা বাইশের ডাউন ট্রেনে উঠবে বলে দুটো সিঁড়ি একসঙ্গে টপকাচ্ছে সবুজ চুড়িদার-পরা রাজকুমারী। অথবা, টিকিট না কেটে ধরা পড়ে গেল আমার পাড়ার বিতানকাকু। হতেই তো পারে, পকেটমারি করতে গিয়ে জনতার সেবায় মুড়ে গেল চায়ের দোকানের ডিমেদা’র ফাজিল ছেলেটা। আমার আপাতদৃষ্টিতে দুঃখ পাবার কথা থাকলেও সেই মুহূর্তের কথা ভেবে হেসে ফেলি খুব। শুধু মানুষ কেন, মুহূর্তও তো সঙ্গী হতে পারে মানুষের। এরকম একেকটা মুহূর্তকে ছুঁতে খুব ইচ্ছে করত আমার। এখন তারা আমাকে উপেক্ষা করে। ছেড়ে দেয় লোকারণ্যে। ঠেলে দেয় ওই দানবিক যন্ত্রযানটির সামনে। যেন আমার থেকে মুক্ত হতে পারলে তারা বাঁচে। তাই আমিও আর স্টেশনকে আপনজন ভাবতে পারি না।

আজকের বিকেলটাই আমাকে স্টেশনে আনার জন্য দায়ী। এইসব বিকেলে মুহূর্তদের চাষ হয় পাথরের খাঁজে। বাবুইপাখির বাসাতে ডেকে ওঠে ছোট্ট এক ছানা। চারদিক ছেয়ে যায় তুলোর মতো সাদা ধোঁয়ায়। ছায়াটাও আজকাল ডাকে না আমায়, কিন্তু আজ সেও পেরে উঠেনি। এমন সময় সঙ্গীর দরকার তো হয়ই। ছায়ারও একটা মানুষের দরকার হয়। ও খোঁজে আমায়। আমি খুঁজি…। কী জানি, হয়ত নিজেকে।

হঠাৎ দেখি, আমার ছায়া আমাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। এ বড় আশ্চর্যের কথা ঠিকই, কিন্তু যতটা অবাক হলে তাকে ‘বিস্মিত’ বলা যায়, আমি ততটা হলাম না। আমার নাকের সামনে এখন ঘুরপাক খাচ্ছে একটা ছোট্ট মৌমাছি, যাকে হয়ত ফুলেরা ফিরিয়ে দিয়েছে পরকীয়ার অভিযোগে। আমি ওর দিকেই তাকিয়ে আছি। কিন্তু ছায়াটা আমার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটাল। সে বড় বড় পা ফেলে এগোতে থাকল। একেকটা মানুষের সামনে দাঁড়াচ্ছে, আর কিছু বলার চেষ্টা করছে। স্পষ্ট দেখছি, মানুষগুলোর চোখে-মুখে উদ্বেগের ছাপ ফুটে উঠছে। ওরা বিভ্রান্ত হবার ভয় থেকে বাঁচতে চাইছে। পালাতে চাইছে অবসাদগ্রস্ত হবার হাত থেকে। ওদের পা কেউ যেন বেঁধে দিয়েছে মাটিতে। ওদের বিধ্বস্ত লাগছে। কেউ কেউ বসে পড়ছে বেঞ্চে, আবার কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গুনে চলেছে মৃত্যুর কর।

মৌমাছিটা ঠিক আমার কপালে এসে বসল এখন। ওকে আমার খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে। একটা গোটা স্টেশন পেয়েছি ওর সঙ্গে কাটানোর জন্য, কিন্তু ছায়াটা! লোকেরা এখন ব্যস্ত নিজেদের ভয় জারিত করতে, ছায়া ব্যস্ত উৎপীড়নে। এ কি বড় একান্ত সময় নয়? ক্লীবের মতো আচরণ আমাকে শোভা পায় না। আমি হাত তুলে মৌমাছিটাকে হাতে নিলাম।

এমন সময় ছায়াটা চেঁচিয়ে উঠল তিনবার। করুণ, আর্দ্র স্বর। কী বিরক্তিকর! মুহূর্তদের বানচাল করাই ওর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। মৌমাছিটা অবশ্য এই চিৎকারে কেমন ছটফটিয়ে উঠল। তারপর সেও কেমন তারস্বরে ডেকে উঠল ছায়াকে। হঠাৎ, আমার নাকে হুল বিঁধিয়ে সে চলমান অশরীরীর মতো ছুটে যেতে লাগল ছায়াটার দিকে।

স্টেশনে সন্ধ্যা নামছে ঘন হয়ে। বাইরের কলা-বাগানে লেগে যাচ্ছে মনকেমনিয়া সুর। একটা গাঢ় অন্ধকার জড়িয়ে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্মের অন্য পাশে। মৌমাছিটা বোধ হয় এতক্ষণে আমার ছায়াটাকে আলিঙ্গন করতে পেরেছে। ভয়ার্ত লোকগুলো এবার নিজেদের মুক্ত করতে পারছে আস্তে আস্তে। বাড়ি খুঁজে চলেছে একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে। প্রত্যেকের চোখে চূড়ান্ত অবিশ্বাস। হুলের যন্ত্রণায় কাতর আমি বৈদ্যুতিন তারেদের আশীর্বাদ করতে করতে বুঝতেই পারছি, কেউ কাউকে দেখেনি এর আগে কোনওদিন। কেউ জানে না, কেউ আদৌ এখানে ছিল কি না কখনও। এখন কী করবে ওরা? আত্মঘাতী হবে কেউ কাউকে চিনতে না পারার মতো সাংঘাতিক অপরাধে? এ বিষয়ে সংবিধানে কী বলা আছে- এক্ষুণি মনে পড়ছে না। তবে, আমার একটা ইচ্ছা হঠাৎ বেশ পাক খেয়ে উঠছে শরীরে।

ছায়াটাকে কি লাইনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেব? সঙ্গে মরবে মৌমাছিটাও। আমাকে এভাবে বিপদে ফেলবে দুজনের মিলিত বিদ্রুপ- কল্পনাও করিনি। ভ্রমরে ভ্রান্তি? নাকি, ছায়াকে অভিশাপ?

ভাবনাদের সঙ্গে প্রকৃতির যোগ খুব দৃঢ়। প্রকৃতি বিখ্যাত দার্শনিক, তার ভাবনার সঙ্গে আবশ্যিকতার সম্পর্ক গভীর। তাই ঠিক এরকম সময়েই নির্জনতাকে ফাঁকি দিয়ে মাটির গহীন থেকে উঠে আসতে লাগল একটা বিশাল বড় ট্রেন। সে চাইছে, প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে। একান্ত কোনও বন্ধুকে ছুটিয়ে নিয়ে যাবে, পার করে এ-জন্মের সমস্ত অপেক্ষার বৈতরণী। ওভারব্রিজটা জেগে উঠছে ক্রমশ। অপেক্ষারা রেলিং বেয়ে নেমে আসছে গড়িয়ে। সর্পিল হয়ে উঠছে তাদের গতি। আর আমার হাত-পা খুব মজবুত হয়ে উঠছে একইসঙ্গে।

হঠাৎ দেখলাম আমার ছায়াটাকে। তার গলায় বসে আছে মৌমাছি। পরম আদরে শুষে নিচ্ছে যৌবনের সমস্ত ভুল। ছায়াটাও নিষ্কৃতি দিচ্ছে নিজেকে আদ্যন্ত শীতলতায়। ট্রেনটা এগিয়ে আসছে স্বপ্নের মতো। যাবতীয় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে নব্য-অষ্টাদশী তরুণীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে শ্বাপদের মতো হাঁ করা স্টেশনে। যে স্টেশন একটু আগেই দেখেছিলাম নির্মলে ভরপুর, এখন সে জান্তব হয়ে উঠছে। ক্রমশ রহস্যময় হয়ে উঠছে ওভারব্রিজের স্বর। আলো-আঁধারিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেখে যাচ্ছে ক্লান্তি আর দোটানা।

সহসা ট্রেনটা থেমে গেল শব্দ করে। যান্ত্রিক প্রগলভতায় চমকে গেলাম আমিও। থিতু হতে চাওয়া আলোটাও কেমন যেন বিরক্ত হল এই অভব্য আচরণে। কী হল?

মৌমাছিটা একটা দুষ্প্রাপ্য হাসি ফিরিয়ে দিল আমায়। তার চোখে মায়া, যেখানে ডুবতে গেলে সাঁতার ভোলা আবশ্যিক। সঙ্গে মৃদু কৌতুকের ঝিলিক। সাইরেনের আওয়াজে সতর্ক হয়ে উঠলাম। আমার ছায়াটা! সে তখন মিশে যাচ্ছে লাইন আর ট্রেনের ধ্বস্তাধ্বস্তিতে। কালো রক্তে ছেয়ে যাচ্ছে স্টেশনের শরীর। কিছুটা লেগেছে ট্রেনের গায়েও। আলোর হলকায় বাদামি হয়ে উঠেছে। ভয়ে নীল হয়ে যাওয়া স্টেশনের লোকগুলো এবার স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। তাদের আচরণে স্বস্তি। বাণিজ্যিক ভদ্রতায় উঁকি মারছে কৌতূহল, তবে তাদের সমবেত আহ্লাদের স্বরে কান পাতা দায়।

মৌমাছিটা আবার উড়ে এসে বসল আমার নাকে। হুলের আদর কেমন নম্র হয়ে উঠেছে এতক্ষণে। আর আমিও এবার বাড়ির প্রতি টান বোধ করছি। আর দেখতে পাচ্ছি, মৌমাছির একটা ছোট্ট ছায়া উচ্চতায় কেমন বাড়তে শুরু করেছে!

ট্রেনটা চলে যাবার পরেই আমি পা বাড়ালাম বাড়ির পথে। ছায়াটার উদ্দেশ্যে শুধু একটা কথা ভাসিয়ে দিলাম হাওয়ায়। মৌমাছির ছায়া হয়ত সেটা লুফে নিল, তবে আমার ছায়া সে ক্ষমতা থেকে বর্তমানে বঞ্চিত।

নিঝুম স্টেশনবন্দী কুহরে পাক খেতে লাগল আমার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি, “কাল আবার দেখা হবে”।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।