সম্পাদকীয় উবাচ

সত্যজিৎ রায় এই নামটাই যেন যথেষ্ঠ। বাঙালি শুধু নয়, গোটা বিশ্ববাসীর কাছে তিনি জনপ্রিয়

প্রতিটি গ্রীষ্মই বাঙালিকে ঘুরে ফিরে কম-বেশি দার্শনিক করে তোলে। তার একটা বড় কারণ পঁচিশে বৈশাখ। আর একটি কারণ সত্যজিৎ-যাপন। আসলে, চিন্তার স্ফুরণ, সময়ের তুলনায় এগিয়ে থাকা সামাজিক চেতনা, ভবিষ্যতের দিক-নির্ণয়, কালজয়ী কর্মজীবন এবং ক্ষণজন্মা প্রতিভার সমন্বয়ে গোটা উনিশ শতক ও বিংশ শতাব্দী জুড়ে বাংলার মননে যে বৈপ্লবিক আলোড়ন ঘটে গিয়েছিল, যাকে আমরা অনেকেই ‘বাংলার নবজাগরণ’ বলে থাকি, তার অভিমুখ রামমোহনে আরম্ভ হয়ে যদি রবীন্দ্রনাথে উৎকর্ষ লাভ করে, তা হলে সত্যজিৎ রায়ের বহুমুখী প্রতিভা সেই ‘বেঙ্গল রেনেসাঁ’র সম্ভবত শেষতম অধ্যায়।

পরিচালনার আগে গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করেন সত্যজিৎ রায়। এক ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন কোম্পানির ভিশুয়ালাইজার হিসাবে কর্মজীবন শুরু ৮০ টাকা বেতনে। পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ র কভার পাতাও ডিজাইন করেছিলেন সত্যজিৎ রায়।

সত্যজিতের সিনেমার বেশ কিছু ডায়লগ তাঁর পিতা সুকুমার রায়ের থেকে অনুপ্রাণিত। যেমন সোনার কেল্লার সেই বিখ্যাত ট্রেনের দৃশ্য যেখানে লালমোহনবাবুর সঙ্গে প্রথমবার আলাপ হবে ফেলুদার। লালমোহনবাবু ফেলুদাকে বলবেন, “ছাতি ২৬, কোমর ২৬, গলা ২৬, আপনি কি মশায় শুয়োর?” এটা সুকুমার রায়ের হযবরল থেকে নেওয়া।

চলচ্চিত্রকার সত্যজিতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে জাপানি চিত্র পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া একবার বলেছিলেন — ‘শ্রীরায়ের ছবি না দেখা আর পৃথিবীতে চাঁদ আর সূর্য না দেখে বেঁচে থাকা একই ব্যাপার।’

শন্তিনিকেতনে পড়ার সময়ে ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক জঁ রেনোয়ার সঙ্গে পরিচয় এবং সিনেমা সম্বন্ধে নানান কৌতূহল, উৎসাহ। আর সেই উৎসাহ নতুন করে জেগে উঠল লন্ডনে থাকালীন। চাকরিসূত্রে লন্ডনে যাওয়া এবং সেখানে এক মাসে শতাধিক ছবি দেখে ফেলেছিলেন তিনি। সেখানে ইতিালীয় পরিচালকের তৈরি ‘বাইসাইকেল থিফ’ ছবি দেখে চলচ্চিত্র বানাবার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী দিয়ে। প্রথম ছবিইতেই বাজিমাত। ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মধ্য দিয়েই তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতিকে আদায় করে নিয়েছেন। তারপর আর থেমে থাকেননি। অপু ট্রিলজি-র পথ পেরিয়ে তৈরি করেছেন একের পর এক দৃষ্টান্তস্থানীয় ছবি। ‘চারুলতা’ সৃষ্টি এবং পরবর্তী জীবনে বৈচিত্র্যসন্ধানেও বার বার নিজেকে, নিজের ভাবনাকে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ডকুমেন্টারি ও ফিচার ফিল্ম সহ মোট ৩৭টি ছবি করেছেন এবং তারিফ আদায় করে নিয়েছিলেন দেশ-বিদেশের আপামর চলচ্চিত্রপ্রেমী ও দর্শক-বোদ্ধাদের। চিত্রনাট্য রচনা, সংগীত স্বরলিপি রচনা, চিত্রগ্রহণ, শিল্প নির্দেশনা সহ চলচ্চিত্রের সব মহলেই দক্ষতা ও পারদর্শিতার বিচারে বিভিন্ন বছরে সম্মান ও স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন পদ্মশ্রী, গোল্ডেন লায়ন, পদ্মবিভূষণ, ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ফিচার ফিল্ম। ন্যাশনাল বেস্ট অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ডিরেক্টর, দাদা সাহেব ফালকে, ফরাসি সর্বোচ্চ সম্মান ‘লেজিওঁ দ্য’নর’ এবং ৭০ বছর বয়সে অসুস্থ অবস্থায় ১৯৯২ সালে পেয়েছেন চলচ্চিত্রবিশ্বের সেরা সম্মান অস্কার। অক্সফোর্ড সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। তাঁর তৈরি প্রতিটি সিনেমার নাম প্রতিটি বাঙ্গালী তথা চলচ্চিত্র প্রেমী মানুষের ঠোঁটস্থ৷চলচ্চিত্রের বাইরে তিনি ছিলেন একাধারে শিশুসাহিত্যিক, চিত্রকর, কল্পকাহিনি লেখক, গ্রাফিক ডিজাইনার সহ সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস আপামর বাঙালি পাঠককে বিমুগ্ধ সাহিত্যের স্বাদ দিয়েছে। তাঁর রচিত ও বর্ণিত জটায়ু, প্রফেসর শঙ্কু প্রভৃতি চরিত্র অনবদ্য সৃষ্টি। উল্লেখ্য, শিল্পী সত্যজিৎ রায় তাঁর সমস্ত বইয়ের ছবি ও প্রচ্ছদ নিজেই আঁকতেন। যেমন আঁকতেন চিত্রনাট্যের ছবি ও লোকেশনের ছবি। রে রোমন, রে বিজার দুটি টাইপ ফেস তৈরি করে পুরস্কার পেয়েছিলেন। এই বহুমুখী প্রতিভার জন্মদিন ২ মে বাঙালির ক্যালেন্ডারে এক স্মরণীয় তারিখ।

সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন লিখতে থাকুন পড়তে থাকুন ৷

রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।