Cafe কলামে রাজদীপ ভট্টাচার্য – ৮

প্যাস্টেল কালার

▪️পথের দেবতা

দেরাদুন থেকে গাড়িতে সারাটাদিন দীর্ঘ পথ পেরিয়ে সন্ধেবেলা এসে পৌঁছেছি যোশীমঠে। কালি কম্বলী বাবার আশ্রমে। সেপ্টেম্বর টপকে অক্টোবরে পা রেখেছে ২০১৫ সাল। হিমালয় অপেক্ষা করছে আরও একটা দীর্ঘ শীতের জন্য। শৃঙ্গের চূড়ায় চূড়ায় রোজ একটু একটু করে রুপোলী পরত ছড়িয়ে পড়ছে ভেজা ক্যানভাসে জলরঙের মতো। একটা স্যাঁতসেঁতে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা আজকের সন্ধেকে জড়িয়ে রেখেছে আষ্টেপৃষ্টে।
বদ্রীনাথগামী এই পথে শেষ বড় জনপদ যোশীমঠ। এরপর বিরান হিমালয়ের রুক্ষতার থাবা ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। কালি কম্বলী বাবার ধর্মশালা এই গাড়োয়াল হিমালয়ের প্রতিটি প্রান্তে দেবস্থানে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন কাল থেকে। ধর্মশালার স্থাপত্যে বয়সের ছাপ রয়েছে। স্থানীয় খাওয়ার হোটেলে রাত আটটা নাগাদ দলবেঁধে যাওয়াটাও এখানে চ্যালেঞ্জ। চারপাশ শুনশান। আসলে এখন হিমালয় ছেড়ে নেমে যাওয়ার সময়। ব্যবসায়ী মানুষজন এমনকি স্থানীয় লোকেরাও এসময় নিচে নেমে আসে। তাদের আর দোষ কি! স্বয়ং বদ্রীনাথও আর ক’দিন পরেই নেমে আসবেন যোশীমঠে। ফলে তীর্থযাত্রীর সংখ্যা হাতেগোনা।
তীব্র ঠান্ডায় রাত নটার মধ্যেই সেঁধিয়ে গেছি কম্বলের নিচে। আগামীকাল বদ্রীনাথ যাওয়ার পথ আরও কঠিন। বৃক্ষশূন্যতা, বায়ুশূন্যতায় ভরা। তার সাথে প্রবল ঝুঁকিপূর্ণ ধসপ্রবণ বন্ধুর রাস্তা। এসব আশঙ্কাই পাক খাচ্ছে নিস্তরঙ্গ রাতের চাপ চাপ অন্ধকারে। এমন সময় ধর্মশালার বারান্দায় কথাবার্তার শব্দ শুনে অবাক হলাম। দরজা খুলে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বাইরে বেরিয়ে বুঝলাম জনৈক সাধু এখন এসে পৌঁছলেন। একঝলক দেখলাম মানুষটিকে। মুন্ডিতমস্তক, কৃষ্ণবর্ণ দীর্ঘ মেদহীন চেহারা। বয়স ত্রিশের আশেপাশে।

দরজা বন্ধ করে ভাবতে বসলাম দেবপ্রয়াগের পর থেকে সেই চড়াই-উৎরাই শুরু। গাড়িতে আসতে গিয়েই হাঁপিয়ে গিয়েছি। আর এই মানুষটি হয়তো শেষ তিন দিন ধরে পায়ে হেঁটে আসছেন। ভাবতেই অবাক লাগে।
ভোর পাঁচটায় এলার্ম দেওয়া ছিল। এই শীত ঠেলে ওঠা মানে এক অসম্ভব ব্যাপার। গড়াতে গড়াতে রেডি হয়ে গাড়ি ছাড়তে প্রায় সাতটা বেজেই গেল। যত দ্রুত সম্ভব বদ্রীনাথে ঢুকে পড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। বছরের এই সময়ে যে কোনো মুহূর্তে তুষারপাত বা ধসে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। যোশীমঠ থেকে পথ সাপের মতো দুলতে দুলতে খাড়া পর্বত বেয়ে সোজা নিচে নেমে গেছে। অলকানন্দার পাড়ে বিষ্ণুপ্রয়াগে পৌঁছে তবে উৎরাই শেষ। খাড়া রাস্তায় গাড়িতে বসেই থোকা থোকা ভয় জাপটে ধরছে। এরপরেই একদম খাড়া চড়াই। গাছপালা দ্রুত শেষ হয়ে গেছে। পর্বতের গায়ে ঘাস ও শ্যাওলার ছোপ। হলুদ, কমলা, সবজেটে এমনকি লাল রঙের ছোঁয়া। শ্বাসের কষ্ট হচ্ছে কম বেশি। হোমিওপ্যাথি ওষুধ ফেলেছি জিভে। রুমালের কোণে কর্পুরের টুকরো রেখে গিঁট মেরেছি। তাই পালা করে নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নিচ্ছি বারবার। চারপাশে নির্জনতার চূড়ান্ত। কদাচিৎ একটি দুটি গাড়ি।

হটাৎ চোখে পড়ল দূরে পয়দল হেঁটে চলা এক দীর্ঘদেহী মানুষের দিকে। গায়ে গেরুয়া পোশাক। হাতে লম্বা লাঠি। কাঁধে ছোটো গেরুয়া ঝুলি। দীপ্ত ভঙ্গিতে চড়াই ভেঙে এগিয়ে চলেছেন। প্রতিটি পদক্ষেপে তুমুল আত্মবিশ্বাস। ইচ্ছাশক্তির আলো যেন ঠিকরে বেরচ্ছে সারা শরীর থেকে। একবার ভাবলাম গাড়িতে উঠে আসার কথা বলি। তারপর নিজের মূঢ়তায় নিজেই লজ্জা পেলাম। অবাক হয়ে ভাবলাম এরমধ্যে এতটা পথ হেঁটে ফেলেছেন সেই সাধু মহারাজ! যাঁকে গতকাল রাত নটার পরে আমাদের ধর্মশালায় পৌঁছতে দেখেছি। হয়তো আজ ভোর চারটেয় উঠে ওই মানুষ মারা ঠান্ডায় আবারও পথে নেমেছেন! হিমালয়ের প্রতিটি বাধা, প্রতিটি প্রতিবন্ধকতা নিজের পায়ে অতিক্রম করতে করতে এগিয়ে চলেছেন অভীষ্টের দিকে।
কোনো দেবমাহাত্ম্যের টানে আমি এই বদ্রীনাথের পথে আসিনি। আকর্ষণ অপরিসীম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং একটি না দেখা স্থানকে চেনা ও জানার। পথিমধ্যে এমন একজন মানুষের সাক্ষাৎ মুহূর্তে ভুলিয়ে দিল আমাদের এতক্ষণের পথশ্রম। নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার কূটকৌশল। সামান্য কিছু শারীরিক সমস্যায় যেন জর্জরিত হয়েছিলাম একটু আগে অবধি। ওই আপনভোলা দৃঢ়চেতা মানুষটিকে দেখে মুহূর্তে ভুলে গেলাম সেইসব আধিব্যাধি। সাধু মহারাজকে ছাড়িয়ে বেশ দূরে চলে এসেছে আমাদের গাড়ি। ফেলে আসা পথের দিকে তাকালে কোথাও তাঁর কোনো চিহ্ন নেই। তবু মনে হল ঠিক পিছনেই মানুষটি আছেন। আমাদের অভয়। পথের দেবতা।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।