|| শাম্ভবী সংখ্যা ২০২১ || T3 শারদ সংখ্যায় রিয়া ভট্টাচার্য

নিঃস্বন
এই শহর প্রতিপল রঙ বদলায়।
আলোর ভেতরে অন্ধকার, অন্ধকারের ভেতরে আলো, এই শহর যেন কোনো পাগল শিল্পীর নিতান্ত খেয়ালে আঁকা ক্যানভাস।
আমি প্রতীক, পদবীহীন। আমার মতো মানুষদের পদবী থাকেনা, কারণ সমাজের ভাষায় আমরা আগাছাবিশেষ। কল্লোলিনী তিলোত্তমার ভিড়ের অংশ হয়েও ব্রাত্য।
আমার নিবাস পাইকপাড়ায়। একটা ছোট্ট কামরা, দশটা পরিবারের জন্য একটাই কমন বাথরুম, একচিলতে বারান্দা… এই নিয়ে আমার ঘরবসত। হেঁপো রুগী মা, বিধবা দিদি ও তার শিশুসন্তান এই নিয়ে আমার পরিবার। আমি বা দিদি, কেউই আমরা বাবার নাম জানিনা। ছোটবেলায় শুনেছিলাম, তিনি অনেকবড় মহাজন। দুবেলা খাদ্য ও পরিচ্ছদের বিনিময়ে মায়ের সঙ্গে সময়যাপন করতেন। এভাবেই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমাদের আগমন। বাচ্চার জন্ম দিয়ে মায়ের রূপ ঢলে পড়ার পরে সেই ব্যক্তি আর খবর রাখেননি আমাদের। রেললাইনের ধারে ত্রিপলঘেরা একচিলতে জমিতে আমাদের নিয়ে উঠেছিলেন মা। পেট চালাবার জন্য ট্রাকচালকদের সঙ্গ দিতেও দ্বিধা করেননি। একটু বড়ো হতেই বস্তির গাঁজাখোর শিবুদার হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিল দিদি। মায়ের ঘরে নিত্য অনাহার ও আধপেটা খাবারের হাত থেকে বাঁচার জন্যই হয়ত। ফিরে এসেছিল মাসছয়েক পরে, পেটে সন্তান নিয়ে। জিজ্ঞেস করায় বলেছিল, গাড়িচাপা পড়েছে শিবুদা। এরপরে আর একটাও কথা বলেনি। তার নৈঃশব্দ্য অনেক না বলা গল্প বুকে চেপে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
আমার নাম প্রতীক কেন রেখেছিল মা আমিও জানিনা। ঠিক যেন কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন। হয়তো বা তাঁর অপ্রয়োজনীয় ভালোবাসার প্রতীক ছিলাম আমি নয়ত মহাজনের তীব্র লালসার।
স্বেচ্ছাসেবীদের খেয়ালে গড়ে তোলা স্কুলে আমার প্রথম অক্ষরজ্ঞান। পড়তে আমি খুব ভালোবাসি। চায়ের দোকানে ফেলে রাখা বাসী কাগজ, ঠোঙা পেলেই পড়ে ফেলি।
আমার বন্ধুরা আঠা শুঁকে নেশা করে। রাস্তায় কাগজ, প্লাস্টিকের বোতল যা পায় তাই কুড়িয়ে বিক্রি করে, কখনো কখনো পকেটও কাটে। আমিও আঠা শুঁকে দেখেছিলাম বারকয়েক, ঠিক ভালো লাগেনি। কেমন যেন ঝিমঝিম লাগে, ঘুম পায়।
দশবছর বয়সেই চায়ের দোকানে কাজে ঢুকেছিলাম আমি, প্লেট – গ্লাস ধুতাম, টেবিলে পৌঁছে দিতাম ফরমায়েশি চা – খাবার। বদলে মিলতো দুবেলা খাবার – সামান্য কিছু পয়সা ও মালিকের ঝাঁটালাথি। কোনোক্রমে কেটে যাচ্ছিলো দিনগুলো।
এখানেই মনিকা ম্যাডামের নজরে পড়ি আমি। রোগাপাতলা আমার মধ্যে এমন কি দেখেছিলেন তিনি জানিনা, তবে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের সঙ্গে, নিজের বাড়িতে।
এতবড় বাড়ি এর আগে কখনো দেখিনি আমি! কত আলো সেখানে! নাম না জানা কত দামী খাবার! জীবনে প্রথমবার পেট পুরে খেয়েছিলাম সেদিন। কিন্তু তারপরে…
মনিকা ম্যাডামের দেওয়া কাজ আমার পেটের ভেতরের নাড়িভুঁড়িগুলোকেও যেন দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিলো। হড়হড় করে বমি করে ফেলেছিলাম। বৈধ – অবৈধ বুঝিনি, শুধু এটুকু বুঝেছিলাম কাজটা নোংরা।
তারপর থেকে আমি এসবই করি। শিক্ষিত সমাজের কাছে আমার একটা বাহারি নাম রয়েছে, জিগালো। তবে আমাদের পেশায় আমাদের কাজের সূত্রে সিঙ্গেল ডেকার, ডবল ডেকার ইত্যাদি বলা হয়। নাহ, এর সঙ্গে বাসের কোনো সম্পর্ক নেই… সম্পর্ক রয়েছে কর্মদক্ষতার। পুরুষ ও মহিলা উভয়কেই খুশি করতে পারার দক্ষতার।
আজ দশবছর পরে আমি একজন নামী ডবল ডেকার, মনিকা ম্যাডামের স্পা এবং ম্যাসাজ পার্লারের একনিষ্ঠ কর্মী। কিন্তু…
মাঝেমাঝে মনে হয় যেন হারিয়ে গিয়েছে প্রতীক। যে বেঁচে আছে সে আসলে প্রতীক নয়, আসলে আমিই নই। আমি এই পুঁজিবাদী শহুরে হাওয়ায় উড়ে বেড়ানো একমুঠো ছাই, হাওয়া তাকে কোনদিকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে জানেনা সে নিজেই।
আজ আমার বাড়িতে অরন্ধন। মা আর দিদি সদ্য জানতে পেরেছে আমার কাজের ব্যাপারে, এখন ঘরের ভেতর থেকে তাদের নাকেকান্নার শব্দ পাচ্ছি আমি। বাড়িওয়ালা বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়ে গিয়েছে, প্রতিবেশীরা দশকথা শুনিয়ে যেতে ছাড়েনি। আসলে খিদের সময় মুখে কেউ খাবার তুলে না দিলেও কাদায় পড়লে লাথি মারতে দুইবার ভাবেনা। এইতো সমাজের চরিত্র।
সিলিং ফ্যান থেকে মোটা দড়িটা ঝুলছে। আজ আমি আত্মহত্যা করবো। আমি মরার পরে মা আর দিদির তেমন কষ্ট হবেনা। আমার তক্তপোষের নীচে সাজানো আছে টাকা, আমার মাংসের দাম। কিছু দামী গয়নাও রয়েছে, ক্লায়েন্টরা খুশি হয়ে দিয়েছেন আরকি! জীবনের শেষ কাজটা মিটিয়ে এসেছি কিছুদিন আগেই। গতকাল এসেছে রক্তপরীক্ষার রিপোর্ট, এইচ আই ভি!
আমি প্রতীক, এটা আমার গল্প। আজ আমি মারা যাওয়ার পরে আমার বাড়িতেও মানুষের ঢল নামবে, আহা উহু হবে৷ পরেরদিনের খবরের কাগজের এককোনে ছাপা হবে কোনো এক পুরুষ যৌনকর্মীর আত্মহত্যার খবর। কারণ নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু কেউ কখনো জানবে না আসল কারণ। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি জীবনের থেকে, ঘুম চাই আমার। শান্তির ঘুম।
যারা গল্পে বাস্তব খোঁজেন তারা ভেবে দেখুন, গল্প কখনো বাস্তব হয়না ; স্বপ্নের মতো।।
(সমাপ্ত)