আষাঢ় মাস। এক চিলতে মেঘ কালো রং ছড়াচ্ছে আকাশে। সূর্য দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে, সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই প্রায়। আষাঢ়ে মেঘ বলে কথা, বাড়ি ফিরতে হবে দ্রুত পা চালিয়ে ; পথে বৃষ্টি শুরু হলে ঘরে ফেরা মুশকিল হবে। একটু দুশ্চিন্তা আছে বটে, কিন্তু আবার খুশিও লাগছে। কারণ বাসায় গিয়ে এই বৃষ্টির রাতে ঘুমটা দারুণ হবে। পথে একলোক আরেক লোককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ভাই, কিছু বলবেন নাকি?’
একটু দ্বিধা করে লোকটি বললেন, ‘আমি বৃষ্টির কথাই ভাবছি। আমার ঘরের ছাদ বেয়ে পানি পড়ে, আজ রাতে পুরো ঘর ডুবে যাবে নিশ্চিত।’
এই রে! যে বৃষ্টিতে কেউ কেউ স্বপ্নের ঘুমের চিন্তা করে, সেই বৃষ্টিই আবার আরেক দল মানুষের জন্য বিভীষিকা।
মনটা খারাপ হয়ে গেল বটে ! তা এত ছোট বিষয়ে মন খারাপ করলে চলে না। আমরা বেঁচেই তো আছি এভাবে।
এসব না ভেবে বরং নিজেদের মতো করে আষাঢ় মাস নিয়ে একটু ভাবা যাক।
আষাঢ় মাসে পত্রপত্রিকাগুলো আষাঢ়ে গল্পের সংখ্যা বের করে। নন্দিত ওয়েব ম্যাগাজিন ‘টেচ টাচ টক’ও আষাঢ়ে সংখ্যা বের করছে।
আজ একটা আষাঢ়ে গল্পোই বরং শোনা যাক।
এক দেশে ছিল এক সরকার। বিরোধী দলগুলো যৌক্তিক-অযৌক্তিক নানা দাবিতে সারা বছর উৎপাত করে। ধর্মঘট ডেকে গাড়িতে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মানুষ মারার জঘন্য কর্মকাণ্ডের ইতিহাসও আছে। কারণে অকারণে সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে ফায়দা লুটার অপচেষ্টারও রেকর্ড আছে।
এই আষাঢ় মাসে, বৃষ্টির দিনেও তাদের শান্তি নেই। এই আন্দোলনের ডাক দিচ্ছে, এই ধর্মঘট করছে। সরকার ভাবে, আহা রে ওদের কত কষ্ট। আমরা তো মন্ত্রণালয়ের এসি ঘরে বসে আরাম করছি। বৃষ্টির দিনে বারান্দায় তৈরি থাকে সরকারি গাড়ি। ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে সহকারীরা। অথচ বেচারাদের কি কঠিন জীবন। বৃষ্টিতে আন্দোলনের পরিবেশ নেই। তারপর ভিজে জ্বর-সর্দি হবে, অনেক বছর বিরোধী দলে থাকায় টাকা-পয়সারও টানাটানি পড়েছে, ভালো হাসপাতালে চিকিৎসাও করাতে পারবে না। টাইফয়েড-নিউমোনিয়া হবে। না, এই দিনে ওদের ওপর চড়াও হওয়ার দরকার নেই। আন্দোলন করুক ওদের ইচ্ছে মতো। তার চেয়েও ভালো হয় ওদের কথাগুলো মন দিয়ে শুনলে। ডেকে নিই আলোচনায়। শুনি কি বলতে চায় ওরা। সরকার এক আষাঢ়ে সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত নেয়, বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন আপাতত বন্ধ। আষাঢ়ে সন্ধি হোক ওদের সঙ্গে। হোক বৃষ্টিমুখর বন্ধুত্ব।
সেই দেশের বিরোধী দল হেন কোনো বিষয় নেই যা নিয়ে ঝামেলা করে না। সরকারে যখন ছিল তখনও যে কি সব কাণ্ড করেছে। একে ওকে ধরেছে, প্রতিপক্ষকে হত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করেছে। এই বৃষ্টির দিনে আন্দোলনে নামার সময় আত্মোপলব্ধিও হয় কিছু। ইস! সেই সব অপকর্ম না করলে হয়তো আজ আমাদের এই হাল হয় না। কিন্তু কি আর করা যাবে পাপের প্রায়শ্চিত্ত তো করতেই হবে। আশার জায়গা এটাই, আমরা যেমন সরকারে থেকে বাড়াবাড়ি করে নিজেদের দুর্দিন ডেকে এনেছি, এই সরকারও তাই করছে। এবার না হোক, আগামী বছর না হোক, কোনো এক বর্ষায় ঠিকই তাদেরও এভাবে বৃষ্টিতে নামতে হবে আন্দোলনে। তখন যে কী মজাটা হবে! ভাবতে ভাবতে হঠাৎ খেয়াল হয়, আচ্ছা এই যে আমরা এত আন্দোলন করছি, তাতে মানুষের সাপোর্ট আছেতো? কিন্তু সাধারণ মানুষ আসছে না কেন? পুলিশ আমাদের এত মারে, তবু মানুষের মন কাঁদে না কেন? বোধহয় এ জন্য যে আমরাও সরকারে থাকতে মানুষের কথা ভাবিনি। মানুষ তাই আমাদের আর বিশ্বাস করে না। ভাবে, সরকারে গেলে আমরাও তো সেই আগের মতোই।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হয়, আচ্ছা এই আষাঢ়েই কেন নিজেদের বদলাই না! একে তো বৃষ্টিতে মানুষের নাভিশ্বাস, তার ওপর আমাদের এই আন্দোলনগত যন্ত্রণা। সব বাদ। মানুষের জীবনের যে যন্ত্রণা আন্দোলন-প্রতিবাদ করে রাস্তা আটকে সেই যন্ত্রণা আরো বাড়াচ্ছিই তো আমরা। তাহলে আমাদের সঙ্গে আসবে কেন? বাদ দিই সব। সরকার মানুষকে যথেষ্ট কষ্ট দিচ্ছে, এখন কষ্ট দেওয়া বাদ দিলেই তো আমরা এগিয়ে গেলাম। বিরোধী দল হিসেবে এই কয়েক বছর মানুষের কষ্ট বাড়ানোর বেশি কিছু তো আমরা করিনি। সব বাদ। এই আষাঢ় থেকে শুরু হোক নতুন ধরনের চিন্তা।
সেই দেশে কন্ট্রাক্টররা সব কাজ জমিয়ে রাখে বৃষ্টির দিনের জন্য। ভাঙা রাস্তা মেরামত, ব্রিজ পুনর্নির্মাণ সব বর্ষার সময়। তাতে ফাঁকি মারার সুবিধা। বৃষ্টির সময় খুব বেশি তত্ত্বাবধান হয় না, সিমেন্টের জায়গায় মাটি ভরে দিলেও চলে। তা ছাড়া পরে কাজে কোনো ফাঁক ধরলে সব দায় বৃষ্টির ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায়। এই বর্ষায় হঠাৎ তাদের মনে হলো, ছি. ছি. কি কাজ করছি আমরা। বর্ষায় এমনিতেই এই শহরের রাস্তা ডুবে যায় পানিতে, গাড়ি-ঘোড়া পাওয়া যায় না, তার ওপর আমরা রাস্তা ভেঙে জীবনটাকে আরো বিষিয়ে দিচ্ছি। দুটি পয়সা বেশি আয় হচ্ছে, কিন্তু যে অভিশাপ বহন করতে হচ্ছে তার ভার তো অনেক বেশি। বাদ, আর বর্ষায় কাজ নয়। অর্থবছর-প্রকল্পের সময় ফুরিয়ে যাওয়া এসব ঝামেলা আছে বটে, কিন্তু সরকারের সঙ্গে আলাপ করব যেন এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয়, যাতে আর কখনো বর্ষায় কাজ করতে না হয়। দরকারে অর্থবছরের সূচি বদলানোর প্রস্তাব করব।
সেই দেশে সিএনজি-ট্যাক্সি ড্রাইভাররাও অপেক্ষা করে থাকে বৃষ্টির। বৃষ্টি এলেই বলবে, যাব না। কিন্তু মানুষের তো যেতে হবে। তখন একশো টাকার ভাড়া এক হাজার টাকা চাওয়া যাবে। এই বর্ষায় হঠাৎ ওদের মনে হয়, কি খারাপ কাজ করি আমরা। বৃষ্টি মানে মানুষের এমনিতেই কত কষ্ট, তার ওপর আমরা আরো যন্ত্রণা বাড়াচ্ছি। না, বাদ। বৃষ্টি হলে আমরা বরং আরো তৎপর হবো। খেয়াল করব, হাসপাতালে যেতে চাওয়া রোগী কিংবা স্কুলে যেতে চাওয়া বাচ্চারা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির অপেক্ষায়। বলব, ভাড়া পরে। আগে চলুন।
বৃষ্টি আর আষাঢ়ে কোনো বৈষম্য নেই। এই দিনে তাই সবাই এভাবে একে অন্যের হয়ে যায়।
এবার একটি আষাঢ়ে কৌতুক। এক লোককে পথে রাস্তা আটকে ছিনতাইকারী বলল, ‘আপনার পকেটে যা আছে আমাকে দিন। ’
লোকটি বললেন, ‘তুমি জানো আমি কে? আমি একজন সংসদ সদস্য। ’
ছিনতাইকারী বলল, ‘তাহলে আপনার পকেটে আমাদের যেসব টাকা-পয়সা আছে সেগুলো আমাকে দিন। ’
আমাদের এই আষাঢ়ে গল্প যেদিন সত্যি হবে, সেদিন সংসদ সদস্য ছিনতাইকারীর কবলে পড়লে বলবেন, এই যে দেখো আমার পকেট খালি। সব কিছু তোমাদের জন্য ব্যয় করে আমার আর কিছু নেই। এই দেখো আমার খালি পকেট।
এবং সেই দিন বৃষ্টিতে ছাদ বেয়ে পড়া পানিতে ভিজে যাওয়ার ভয়ও থাকবে না কোনো হতভাগার।
সেদিনের আষাঢ়ে বৃষ্টিতে শুধুই থাকবে সুন্দর ঘুমের সোনালি স্বপ্ন।