গদ্য বোলো না -তে পদ্মাবতী রায় চৌধুরী

রাতের নাম রাস

রাতভর একলা চাঁদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভোর জাগতেই ঘুমটুকু রাঙতার মতো জড়িয়ে গেছিলো আঁখির আঠায় ৷ তা সেই ঘুম ভাঙলোই শাল্য সম্পাদকের ইনবক্সের ধাক্কাধাক্কিতে ৷
-রাজামশাই একটি বালিকা চাইলো…
-অ্যাঁ ! বালিকা !
-লেখা ও সৃষ্টিই সম্পাদকের কাছে বালিকাসম বাল্যে ! সৃষ্টি কি একা বালকের কম্ম ?
-আবার লেখা !
-লিখতেই হবে…সূচিপত্রে নাম দিয়েছি ৷ তাড়াতাড়ি লেখো…সময় নেই আমার…এখুনি চাই ৷
পৃথিবীর যাবতীয় সম্পাদকেরা এমনই হন ৷ অর্ডার করেই প্রস্থান ৷ এদিকে আমার ঝাপসা হয়ে আসা চোখ…সপ্তাহের বাজারের ফর্দ,হিসেবের খাতা,রান্নার মশলায় জিরজিরে হতে হতে রান্নাঘরের একফালি জানলা দিয়ে উড়ে যাওয়া নীল-হলুদ পাখিটাকে দেখতে থাকে ৷ হেমন্তের রোদ এসে পড়ছে ওর ডানায় ৷ রাসপূর্ণিমার চাঁদ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওর রাতের পালক ৷ আমার মনে পড়ছে কবেকার হারিয়ে যাওয়া এক পাগলাকে…তোকে…
আজ তেরোই নভেম্বর ৷ আমি ফেরাতে পারিনি কাউকেই ৷ আর আজকের দিনে,আমি ফেরাতে পারবো না কাউকেই ৷ সেবার একখানা লালসাদা ঘনবুনোট শাড়ির আঁচলের সুতোয় সন্ধ্যা লিখেছিলি গতজন্মে…
“ট্রিট দিস পোয়েম অ্যাজ থাউজেন্ড উন্ডস অফ লাভ…”
শাড়ির সুতোগুলি বলছে,হেমন্তের রাতের একটা নেশা আছে ৷ ঘোর লাগে ৷ হেমন্তের মরচে পড়া দুপুরের আলোয় কেক বেকারির গন্ধ ছড়ানোর দিন আজ ৷ অথচ,আমরা কেউই পারি না…সারা বইমেলা ছুটোছুটি করে আর বাকিদের মত কেক আর ক্রিমে মাখামাখি হতে ৷ অথবা তোর দেবতা হয়ে এক পকেটের বিড়ি আর অন্য পকেটের সিগারেট থেকে টান দিয়ে ধোঁয়া জ্বালিয়ে বসতে ৷ শুধু এই চাঁদের রাতে আমার ফুটপাথ মনে পড়ছে ৷ আর ফুটপাথঘেঁষে ঘুমিয়ে থাকা অভুক্ত শিশু ৷ মায়ের বুকের কাছে নোংরা মলিন হাজার তালির শাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা,অভুক্ত শিশুর চাঁদের মত ফুটফুটে মুখ ৷ আচমকাই সে ঘুমঘুম চোখ খুলে তাকালো রাসপূর্ণিমার দিকে…আর চাঁদ গলতে শুরু করলো তীব্র আদরে,ভালোবাসায়,যন্ত্রণায়,স্নেহে ৷ তুই বলেছিলি…দুধের বোঁটা আগলে যে নিরাপত্তায় ঘুম নেমে আসে…অতি দারিদ্রেও ঠিক ততটুকু মাত্র ভালোবাসা লাগে বাঁচতে গেলে ৷ আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে,ডেকচিভরা খিচুড়ি আর আলুভাজা সাজিয়ে দিই আমার নিরন্ন ঈশ্বরের কাছে ৷ এখনই জড়িয়ে নিই তুলোট কম্বলে নরম জীবন ৷ পারিনি এখনও…পাশে নিরাপদ আখরের একটা তুই নেই ৷ চাঁদগুলো জ্বলন্ত রাতের চাদরে মরে যাচ্ছে ৷ মানুষের প্রতিবাদ আর সাহস মরে যাচ্ছে ৷ আর  রাতগুলো নোটবন্দি থেকে বাবরি…কাশ্মীর থেকে এল.ও.সি…নোবেল থেকে আঁচলের আড়ালের আধপোড়া দাম্পত্য খুঁটে খাচ্ছে ৷ ইতিহাস আর ধর্মবটের যুদ্ধে মানবিকতা আর সৃষ্টির শরীর থেকে চুনসুড়কি খসছে সেই প্রাগৈতিহাসিক থেকে ৷ ইতিহাসের পৃথিবীর মত ভোর জ্বলে উঠলে মনে পড়ে,এই শহরের অন্তরাত্মা ধোওয়া হয়নি কতকাল গঙ্গাজলে ৷ ক্লেদার্ত মেঘ জমছে শহরের ধূলোয় ৷ তবুও শিশুটি আজও তাকিয়ে আছে আকাশে…চাঁদে…নক্ষত্রে…আশায় ৷ শুনেছি তুই কলমের “আলি আকবরে” ঝড় তুলছিস আজকাল…ভুলেই গেছিস আমাকে একদম ৷ শুধু আমার বারান্দার নিচ থেকে যে সন্ধ্যাবাতাস বয়ে যায়…তারা জানে,বর্ষা আর আধভেজা জুঁইগন্ধের সাথে তুইও নাকি আসিস অফিসফেরত এই রাস্তায়…শিবরাত্রির রাতে ৷ বইমেলার ঠেলাঠেলি ভিড়ে’নাটমন্দির’নামের আমাদের খোলা চাতালটায় পাক্কা দেড়ঘণ্টা উল্টে চলে কবিতা আর আমার “আলি আকবর”…যার ঠিক পৌনে চার টেবিল পার করে নিবিষ্ট মনে টাকা গুণে যায় তোর “রবিশঙ্কর” ৷ অথচ তাদের কথা হয়নি বহুকাল ৷ অথচ শিশুরা চাঁদ দেখতে গিয়ে আলোকেই দেখে ফেলেছে ৷ অথচ তাহারা মন থেকে বলে…ভালো হোক…তোর আলো হোক ৷ অথচ নারীটি এখনও অপেক্ষায় আছে স্তব্ধ কলিংবেলে আত্মা রেখে…কে যেন ফিরে আসবে বলেও সম্ভবত ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছে ৷ আধপোড়া দাম্পত্যে এতটুকুই তো আশা নিয়ে চাঁদের গলে যাওয়া ৷ কে যেন বলেছিল…আমাদের কবিতায় দেখা হবে ৷ রাসপূর্ণিমার চাঁদ সাক্ষী…তাই তো লিখে যাওয়া এখনও ৷ নভেম্বর আর তেরো…তোর জন্মদিনের ভোর আর রোদকে বলি…আলো থাকিস জীবনে…আগুন থাকিস কলমে…বাকি রইলাম আমি আর এই মিঠে হাওয়া হেমন্তরাত…রাসপূর্ণিমার চাঁদ জানে…”রবিশঙ্কর আর আলি আকবর”…আজও সেতার বাজান…মনে মনে ৷
“ট্রিট দিস কলাম অ্যাজ আ বাঞ্চ অফ রেড রোজেজ আলি আকবর…এই রাত আর চাঁদের সবটুকু আলো তোকে…তোকেই দিলাম…”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।