গল্পকথায় প্রজ্ঞা মণ্ডল

ডায়রি

“কাল থেকেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পুজোর শেষে এই অঝোর ধারায় বর্ষণ, ভালো লাগে কারুর? তার ওপর আবার অক্টোবর মাস, না চাইতেও হিমেল আমেজ। তার মধ্যে এই অফিস। উফ! ভালো লাগে না আর।” সকাল বেলা এলামের ডাকে ঘুম ভাঙার পর, বাইরে বৃষ্টি দেখে নিজের মনে মনেই একটা বিরক্তি প্রকাশ করে এসব বলে ওঠে তুলি।
তুলি ওরফে তিলত্তমা চক্রবর্তী। দিল্লির এক নামী সংস্থার নামকরা জার্নালিস্ট। নানারকম পোস্টার বা এড এও এই মুখ খুবই চেনা। দেখতে যেমন সুন্দর, স্বভাব ও সেরকমই ভালো আর কাজেও খুব পারদর্শী। এই জন্য অফিসে তার খুব কদর। তাই ছুটির কোনোও অবকাশই নেই। কিছু হলেই তুলিকে প্রোয়োজন হয়।
আজও অফিসে এক জরুরি তলব আছে, তাই সকাল সকাল এত ব্যস্ততা। নাহলে আজ সে অফিসে যেতোই না।
এসব ভাবতে ভাবতে তুলি রেডি হয়ে গেলো। আজ তার আর কিছু খেতে ভালো লাগছে না। কেন জানি সকাল থেকেই আজ তার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। তাই তাড়াতাড়ি করে বেরোতে গিয়ে গাড়ির চাবিই নিতে ভুলে গেছে।
“ধুৎ গাড়ির চাবিটা আবার কোথায় রাখলাম! একেই এই বৃষ্টি তার ওপর আবার চাবি আনতে ভুলে গেছি। আজ অফিসে দরকার আর আজই সব কিছুতে দেরী হচ্ছে।
থাক আজ আর গাড়ি বের করবো না। এমনিতেও চাবি ভুলে গেছি তার ওপর আবার বৃষ্টি। বরং একটা ক্যাব বুক করে নিই।”
যেমন ভাবা তেমন কাজ। তুলি সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা বের করে একটা ক্যব বুক করল। প্রায় দশ মিনিট এর মধ্যেই ক্যব এসে উপস্থিত।
তুলির ক্যামপাস থেকে অফিসের দূরত্ব গাড়িতে কুড়ি মিনিট মতো। তাই তাড়াতাড়ি ই সে অফিসে পৌছে গেলো।
অফিস থেকে কাজ শেষ করে তুলি যখন বেরোলো ঘড়ির কাটা তখন প্রায় বারো ছুই ছুই। কাজের ব্যস্ততায় যে কখন এত রাত হয়ে গেছে খেয়ালই করে নি সে। তাড়াতাড়ি করে জিনিস পত্র গুছিয়ে নিতে নিতে ক্যবটা বুক করে নিল।
ক্যব আসতেই গাড়ির ড্রাইভার কে গাড়ি জোরে চালানোর নির্দেশ দিয়ে গাড়ির সিটে শরীরটাকে এলিয়ে দিল তুলি। আজ বড় ক্লান্ত লাগছে তার। গত দুদিন যাবৎ শরীর টাও বেশ খারাপ। তার ওপর আবার কাজের এত চাপ। আর ভালো লাগছে না তার এসব। মনে হয় যেনো এক ছুটে দৌরে সৌরদীপ এর কাছে চলে যায়। কিন্তু সে উপায় ও যে নেই তার। হঠাৎ করেই তুলির চোখের কোনা দিয়ে এক ফোটা জল গাল বেয়ে নেমে এল।
” ম্যাডাম আপকা ঘর আ গিয়া। ইসি জাগা কা এড্রেস বাতায়া থানা আপনে। দেখ লিজিয়ে।..….. ও ম্যাডাম কেয়া হুয়া। ম্যডাম শুনিয়ে।”
ড্রাইভার এর ডাকে সম্বিত ফিরল তুলির। তাকিয়ে দেখল তার অ্যপার্টমেন্ট চলে এসেছে। সে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।
-“আপকা কিতনা হুয়া ভাইসাব?”
-“একশো বিশ রুপিয়া।”
-“ইয়ে লিজিয়ে। ঠিক হেনা?”
-“হা ম্যাডম ঠিক হে।”
ড্রাইভারের ভাড়া মিটিয়ে রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নিল।
বাইরে বৃষ্টিটা এখন ও পরেই চলেছে।ফ্রিজ থেকে ওয়াইন এর বোতল টা বের করে টেবিলের ওপর রাখল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যলকনিতে গিয়ে দাড়াল। বৃষ্টির ছোট ছোট ফোটা তাকে স্পর্শ করতে লাগল।তবে এই বৃষ্টি এবার যেন তুলির কাছে অসহ্য হয়ে উঠল। আর ভালো লাগছে না তার। সিগারেট টা শেষ করে ঘরে এসে কাবার্ডটা খুলে ডায়রি টা বের করল।
আজ প্রায় দশ বছর পর সে ডায়রিটা ধরল। প্রথম পাতা খুলতেই বাইরের বর্ষন এর সাথে সাথে তার চোখেও অঝোর ধারায় বর্ষন শুরু হল। ওয়াইন এর এক সিপ মুখে নিয়ে ডায়রি টাকে জরিয়ে ধরল।
সময় অসময়ে এই দশ বছর পুরানো ডায়রিই তার একমাত্র অবলম্বন। তারপর তুলি ভাবতে শুরু করে———
এই ডায়রিটা তাকে প্রথম উপহার দিয়েছিল সৌরদীপ। আসলে তার যে, নিত্যদিন ডায়রি লেখা অভ্যাস ছিল। প্রত্যেক দিন কি ঘটছে না ঘটছে তার সূক্ষাতি সুক্ষ বিশ্লেষণ সে ডায়রি তে লিখে রাখত। আর সৌরদীপ ও সেই ডায়রি লুকিয়ে লুকিয়ে পরতে ভীষন ভালো বাসত। তাই উপহারে ডায়রিই ছিল সবথেকে শ্রেয়।
তুলি ভালোবেসে বিয়ে করে সৌরদীপ কে। বাবা-মার কিছুতেই মত ছিল না এই বিয়েতে। তাই অবশেষে সৌরদীপের হাত ধরে পালিয়ে আসে সে। যেহেতু এক রক্ষনশীল পরিবারের মেয়ে সে, তাই পালিয়ে যাওয়ার ফলে বাবা-মাও আর কোনোও দিন যোগাযোগ করেনি তার সাথে। মাঝে দু-একবার তুলির দাদা খোজখবর নিয়েছিল তার। তারপর সেও বিদেশ চলে যায় তাই আর পরিবারের কারোর সাথেই যোগাযোগ নেই আর।
তবে সৌরদীপ কিন্তু কোন অভাব রাখে নি তুলির। আদরে ভালোবাসায় মুরে রেখেছিল তাকে।
সৌরদীপ রায় চৌধুরি, এক নামী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ম্যনেজার। গাড়ি বাড়ি কোনকিছুরই অভাব ছিল না তার।
সৌরদীপ তুলির থেকে অনেকটাই বড়ো ছিল। তাই ওদের মধ্যে কোন অশান্তি হতো না। দুজন দুজনকে পাগলের মতো ভালোবাসত।
ওদের যখন বিয়ে হয় তখন তুলি সবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। সৌরদীপ ই দায়িত্ব নিয়ে তুলি কে জার্নালিসম পরিয়ে উচ্চশিক্ষিত করে।
তবে তুলি কোনও দিনই চাকরি করতে চাই নি। শুধুমাত্র সৌরদীপ এর সাথে ভালোবাসায় সংসার করতে চেয়েছিল। তবে সৌরদীপ সবসময় চাইতো যেন তুলি একটা বড়ো চাকরি করে এবং সুখ্যাত হয়। কিন্তু সে কোনও দিনই কোন কিছুতে তুলি কে জোর করে নি।
সবই ভালোই চলছিল। তুলি আর সৌরদীপ বেশ সাচ্ছন্দেই দিন কাটাচ্ছিল। কত স্বপ্ন তাদের। সেগুলো সযত্নে বুনছিল একে অপরে। দুজন যেন দুজনের সম্পুরক।
এরকমই এক বৃষ্টি ভেজা সকাল। তুলি বার বার বারন করা সত্তেও সৌরদীপ আজ অফিসে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত।
-“আজ প্লিজ অফিসে যেও না দীপ ( সৌরদীপকে ভালোবেসে তুলি দীপ বলে ডাকে)।
-“এরকম অবুঝ হয়ো না তুলি। একটু বোঝো ব্যপার টা। আজ জরুরি মিটিং আছে অফিসে। না গেলেই নয়। নাহলে তোমার বারন শুনি না এরকম হয়েছে নাকি কখনও।”
-“তবুও আর একবার ভেবে দেখলে হতো না?!…..আজ না করে কাল করো। আমার মনটা খুব কু ডাকছে দীপ।”
-“প্লিজ তুলি একবারই তো। আর এরকম কখনো করবো না, প্রমিস। এবার টার মতো যেতে দাও।( কান ধরে সৌরদীপ বলে)।
-” দীপ তুমি আজকাল আমার কোনো বারণ শোনো না। ঠিক আছে। যাচ্ছো যাও, তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে বলো?”
-“(তুলিকে জরিয়ে ধরে) কথা দিচ্ছি কাজ শেষ হলেই চলে আসব।”
অগত্যা সৌরদীপের কথায় রাজি হয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য ছেরে দিল তুলি।
সেটাই তুলির জীবনের বড়ো ভুল ছিল। যা তার ভালোবাসা, সুখ শান্তি সব একমুহূর্তে কেরে নিয়েছিল।
সেদিনের পর আর দীপ ফেরে নি। বিকেল বেলা সুন্দর করে সাজানো একটি সববাহী গাড়িতে ফিরেছিল সৌরদীপের নিথর দেহ।
পোস্টমর্টম রিপোর্টে লেখা ছিল গাড়ি এক্সিডেন্টে মৃত্যু।
তারপর ই তুলি চাকরি নিয়ে কলকাতা ছেরে এই দিল্লি তে চলে আসে। দীপের ইচ্ছা পূরণ করে। তারপর ই তার এই পরিচয়……..
-“তুলি এই তুলি সকাল হয়ে গেছে তো। উঠে পরো। জ্বরটা এখন কেমন আছে? শরীর ঠিক আছে তো?”
চোখ খুলে তুলি দেখল সৌরদীপ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তুলি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। ভাবতে চেষ্টা করে কি হয়েছিল!
মনে করে সে কাল রাতে গাড়িতে করে ফিরছিল সে। হঠাৎ করেই গাড়িটা থেমে যায়। নেমে দেখে সামনে একটা ডায়রি পরে আছে। সে তুলে নেয় সেটা। ডায়রিটা অপূর্ব দেখতে ছিল তাই নেবে না নেবে না করেও, ডায়রিটা সে নিয়েই ফেলে।
তারপর ই বারিতে এসে সেটা পরতে শুরু করে দেয় সে। সেখানেই এই জীবনি টা পরে সে।
………কিন্তু, কিন্তু সেটা তো অন্য একটা মেয়ের জীবনি ছিল। তবে সে স্বপ্নে এরকম দেখল কেনো! তবে কি কনো সাদৃশ্য আছে তার সাথে!!!!!???
সে কি কোনভাবে এর সাথে জরিত ছিল। তুলির মাথা আর কাজ করে না।
-“এই তুলি কি ভাবছ এত? ঠিক আছো তো তুমি?”
-“দীপ তুমি ওই ডায়রি টা দেখেছ?”
-“কোন ডায়রি? কিসের কথা বলছো? জ্বরের ঘোরে কী বলছ তুমি?”
-“আরে ওই যে ওই ডায়রি। কাল রাতে কুরিয়ে পেলাম না!”
-“কী বলছ তুমি? কোন ডায়রি? কোনো ডায়রি আনোনি তুমি। কাল অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়িতে জ্বরে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে তুমি। তারপর গাড়ির ড্রাইভার আমায় ফোন করে। আমি তোমায় বাড়ি নিয়ে আসি। এর মাঝখানে ডায়রি কোথা থেকে এল?”
তুলি এবার সত্যিই বুঝতে পারে না, কি ঘটছে তার সাথে। খালি বারং বার একটাই কথা তার মাথায় ঘোরে
‘এটা কি সত্যিই স্বপ্ন ছিল?’
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।