সাপ্তাহিক ধারাবহ -তে প্রভাত মণ্ডল (পর্ব – ৯)

ইছামতীর সন্তান 

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর সেই বিনিময় প্রথা,সুদীর্ঘ স্মৃতি, জীবনযুদ্ধের অভিজ্ঞতার পাহাড়,ইছামতী পেরিয়ে এ দেশে আগমন।ইছামতীর চরা অঞ্চলে চাষাবাদ করে,মজুরি দিয়ে জঠরের অগ্নিক্ষুধা মিটিয়ে আজও টিকে আছে এই পল্লীর মানুষগুলো।আর আছে উপার্জন বলতে ইছামতীর বুক জুড়ে মৎস শিকার।ইছামতী নিজের বুক পেতে,অপত‍্য স্নেহে লালন করেছে তার গতিপথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দু-ধারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের শত শত পরিবারকে,এখনও তা করে চলেছে।ভবিষ‍্যতেও যে তার এই অবারিত দ্বার খোলা থাকবে তা বিন্দুমাত্র বলার অপেক্ষা রাখে না।বাবুদের চোখ রাঙানি এখানে নেই, নেই অকারণে গালিগালাজ,নেই শারীরিক অত‍্যাচারের প্রশ্নও।শুধু দান আর দান,বিনিময়ে কিছু চাওয়া নেই।দিন পেরিয়েছে,সভ‍্যতার ক্রমান্বয়ে সামিল হয়েছে গ্ৰাম,তবুও এই মানুষগুলোর জীবনযাত্রা থমকে আছে একইভাবে-বদলায়নি এক তিল পরিমাণও।
করোনা মহামারীর প্রথম পর্যায়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে চরে যেতে বাধা পেয়ে বেজায় ক্ষুব্ধ হয়েছিল এই পল্লীর মানুষগুলো।তবে এই অসুবিধার সম্মুখীন বেশিক্ষণ হতে হয়নি তাদের।সঞ্জয়বাবুর বিচক্ষণ দৃষ্টিতে ও কড়া নজরদারির মধ‍্যে রয়েছে তার এলাকার গোটা সীমান্ত।হ‍্যাঁ, এই সেই ব‍্যক্তি,সীমান্তরক্ষী বাহিনীর উচ্চপদস্থ আফিসার।যিনি বর্তমানে আংরাইল ক‍্যাম্পের দায়িত্বে আছেন।ইনিই ভুলোর ছেলেকে দায়িত্ব সহকারে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন।পল্লীর মানুষগুলোর মনে দীর্ঘদিন ধরে বাসা বেধে থাকা কুসংস্কারে আঘাত হেনে বুঝিয়ে দিয়েছেন বিজ্ঞান এগিয়ে।আস্থা জাগিয়েছেন আধুনিক চিকিৎসা ব‍্যবস্থার উপর।
সকাল ন’টার প্রায় কাছাকাছি সময়।হঠাৎ দুজন সেপাই সহ অফিসার পল্লীতে এসে সোজা ভুলোর বাড়িতে হাজির।বাইরে তেমন কাউকে দেখতে না পেয়ে —-
কেউ বাড়িতে আছো নাকি?
ঘর থেকে জ‍্যোৎস্না বেরিয়ে আসে।মাথার কাপড়টা টেনে নেয় —
হঅঅ ক‍্যাডা?
সরাসরি বাংলাতে জিজ্ঞাসা করায় জ‍্যোৎস্না প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি যে কে এসেছে।সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সেপাইরা অনেকে বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও বাংলা কেউই তেমন বলেন না।রাষ্ট্রভাষা অর্থাৎ হিন্দি ভাষাতেই যাবতীয় কথাবার্তা বলে থাকেন।তাই জ‍্যোৎস্নাও হঠাৎ করে বুঝতে পারেনি যে কে ডাকছে।বাইরে বেরিয়ে এসে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অফিসারকে দেখতে পেয়ে —
হ‍্যাঁ গা,শুনতিচো?বাইরে আসো।দ‍্যাহো ক‍্যাডা আইচে।
ভুলো অতশত কিছু বুঝতে না পেরেই একটু বিরক্তির স্বরে —
আরে কবা তো ক‍্যাডা আইচে?অত রঙ্গ করার কি হইলো?
হ‍্যাঁ, এই বিরক্তিটা স্বাভাবিক।আজ লকডাউনের বেশ কয়েকটাদিন পেরিয়ে আবার সপ্তাহ গড়িয়েছে।দিন আনা দিন খাওয়া এই মানুষগুলোর জীবন জীবিকা আজ অনিশ্চিত।প্রতিদিন খাওয়া হলেও তিনবেলা সেভাবে জুটছে না।ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কারণে মাথায় চিন্তা।আর অনবরত এই চিন্তা থেকেই একরকম মাথা ভার হয়ে থাকে সবসময়।সরকার থেকে বরাদ্দ রেশনে আর কতটুকুই বা চলে।ভুলোর কথা শুনে জ‍্যোৎস্না তেমন কিছু খারাপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে —
রঙ্গ করতিচি না,আইসা দ‍্যাহে তো যাও ক‍্যাডা আইচে,দ‍্যাকলি পরে তহন বুজতি পারবানানে।
ভুলো বাইরে বেরিয়ে আসে।শুকনো মুখ,শরীরটাও এই কয়েকদিনে অনেকটাই ভেঙে পড়েছে।এমন পরিস্থিতিতেও মুখে একটু অবুঝের হাসি হেসে —
ওওও,ছ‍্যার আইচেন।জ‍্যোছনা পাটিহান আইনা পাতি দ‍্যাও দেহি।
জ‍্যোৎস্না পাটি এনে পেতে দেয় বসবার জন‍্য।আধুনিক সভ‍্যতায় এই পাটির ব‍্যবহার আজ আর চোখে পড়ে না।অনেকে তো নামই জানে না।গ্ৰাম বাংলার সভ‍্যতাকে বহন করা নিত‍্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মধ‍্যে এই পাটি অন‍্যতম।আধুনিকতার ছোঁয়ায়, নগর সভ‍্যতার সংস্পর্শে এসে গ্ৰামাঞ্চলেও এখন বাড়িতে অতিথি কিংবা যে কোনো মানুষ বেড়াতে এলে সাথে সাথে বসবার জন‍্য চেয়ার দেওয়া হয়।কিংবা নাইলনের তৈরি মাদুর বিছিয়ে দেওয়া হয়।কখনো সখনো মোটা কাপড়ের তৈরি শতরঞ্জিও পেতে দেন কেউ কেউ।তবে কয়েক বছর আগেও খেজুর গাছের ডাল,সচারাচর যাকে ডেগোও বলে থাকেন অনেকে,সেই ডাল পেড়ে তা শুকিয়ে নিতেন।মা-বোনেরা সেই শুকনো পাতা ডাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তা চিকিয়ে খুব সুন্দর ভাবে বুননের মাধ‍্যমে পাটি বা চাটাই তৈরি করতেন।শুধু অতিথি এলে বসবার জন‍্য নয়,গৃহস্থালির নিত‍্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সবই শুকাতেও দিতেন এই পাটিতে।খেতে বসবার জন‍্যও আসনের বিকল্প হিসাবে খেজুর পাতা দিয়ে তৈরি চাটাই এর ব‍্যবহারই হত।এখন এসব আর তেমন চোখে পড়ে না,বিলুপ্ত প্রায়।তবে অভাবের সংসারে পল্লী জনবসতির মাঝে অল্পস্বল্প এখনো এই পাটির প্রচলন আছে।
সঞ্জয়বাবু বলেন —
তোমাদের ছেলে অখিল এখন কেমন আছে?ওর শরীর এখন ভালো তো?আর কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
ভুলো সকালে নদী থেকে মাছ ধরে এসে স্নান সেরে ঘরে গিয়েছিল।সে সময় সঞ্জয়বাবুর আগমন দুজন সেপাই সহ।মাথা মুছতে মুছতে ভুলো বলে —
না বাবু,আর কোনো অসুবিদে হয় নাই।হেই সুমায় আপনি যদি না আইতেন আর ডাক্তারগো কাচে লইয়া না যাইতেন,ছলডারে আর বাঁচাইতে পারতাম না।
ভুলোর চোখে জল চলে আসে।কাঁদো কাঁদো হয়ে —
আপনিই আমাগে দ‍্যাপতা।আপনার দান কোনোদিন ভুলুম না।
একটা দুটো করে পল্লীর বেশ কয়েকজন চলে আসে ভুলোর বাড়ির সামনে।ভুলো নিজেকে সামলাতে পারে না,সাহেবের পা’এ ধরতে যায়।সাহেব ভুলোকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেয় —
আরে এ কি করছিস?ওটা তো আমার কর্তব‍্য।আমরা এ ভাবে সীমান্তে ঘুরে বেড়ায়, ডিউটি করি তা বলে কি আমরা মানুষ না!আমরাও তো তোদের মতই মানুষ,আমাদেরও পরিবার আছে। মা,বাবা,ভাই,বোন,স্ত্রী,সন্তান সবাই আছে।তোরা অযথা আমাদেরকে ভয় পাস।যারা চোরা কারবার করে আমরা তাদেরকে শাস্তি দিই,অন‍্য কোনো সাধারণ মানুষকে নয়।আর যদি কখনো শরীর খারাপ হয় তবে ওই সব ঝাড়ফুঁক,ওঝা আর একদম নয়।সোজা ডাক্তারের কাছে যাবি,কেমন!
ওখানে উপস্থিত সকলেই শোনে এসব কথা।কেউ কেউ সহমত পোষণ করে আবার কারোবা মুখের চাউনি বদলে যায়।হবেই না বা কেন,প্রাচীন পন্থা ও অন্ধবিশ্বাসে বিশ্বাসী মানুষের কাছে যুক্তিসঙ্গত কথা হঠাৎ করে বললে,তারা তো আকাশ থেকে পড়বেই।ভুলো,জ‍্যোৎস্না সহ সুলতা আরো অনেকে একবাক্যে মেনে নেয় সাহেবের কথা।সুলতা আস্তে আস্তে জগার বউ এর কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে বলে —-
হঅঅ,সাহেব ঠিক কইচে বল?ওই জন‍্যি দেহি বাবুগের কিচু হইলে পরে সব ডাক্তারগো কাচে যাইয়ে দিনের দিন সাইরে ওটে।গটগট কইর‍্যা হাইটে চইলে বেড়ায়।এহন বুজতিচি ব‍্যাপারডা।
জগার বউ কেমন যেন একটু অস্বস্তি বোধ করে।সুলতার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।সুলতা বুঝতে পারে যে তার কথা জগার বউ এর পছন্দ হচ্ছে না।তবু কোনোরকম পরোয়া না করে —
দ‍্যাহো দিদি,রাগ করলি হইবো?ভাইবা দ‍্যাহো,ভুলানাত তারপরে গৌর কাউরারে তো এত বেশ্বাস করো,তা ভুলোর ছলডা তো কয়দিন ধইর‍্যা পইর‍্যা ছ‍্যালো, দেহার হাল ছ‍্যালো না।ওই সব পাতা গুলা,শিকর গুলা কত কিচুই না খাওয়াইলো তাতেও কিচুর কিচু হইলো না।শ‍্যাসে সাহেব আইসা যহন হাসপাতালে ডাক্তারগে কাচে নে গেল,তহন তো সাইরা উটলো বাপজান আমাগের।এহন দ‍্যাহো দিনি এই কয়ডা দিনে এক্কেরে গটগট কইর‍্যা হাঁইটা চইলা বেড়াইতেচে।
সুলতার একথা সাময়িক ভাবে জগার বউ এর মতে খেটে যায়।সে মনে মনে ভাবে —
তাই তো।আমাগে গৌর কাউড়া এত চটাং পটাং করে,কয় আমি এই বিদ‍্যে জানি,ওই বিদ‍্যে জানি, তা কিচুই তো কাজে আসে নাই,ভুলোর ছলডা যহন পইর‍্যা ছ‍্যালো।
সুলতা বুদ্ধিমতি।পড়াশুনা না জানলেও সে যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে।অন্ধ কুসংস্কার তাকেও হয়তো গ্ৰাস করেছে ঠিকই, কিন্তু তা অশিক্ষা ও পরিবেশগত কারণে।বেশিরভাগ ক্ষত্রেই দেখা যাবে অশিক্ষাই কুসংস্কারের মূলগত কারণ।তবে পরিবেশের প্রভাবও কিছুটা কাজ করে।এই সমস্ত পল্লী অঞ্চলে মানুষের সামনে যদি কিছু জীবন্ত উদাহরণ তুলে ধরা যায়,কিংবা তাদেরকে সঠিকভাবে বোঝানো যায়,শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে তোলা যায় তাদেরকে,তবে তারাও কুসংস্কার ত‍্যাগ করে বিজ্ঞানে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে।কিন্তু করবেটাই বা কে এসব কাজ।স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা কিংবা রামেশ্বর ঘোষের মত হোমরা-চোমরা স্বার্থবাদী মানুষেরা ভালো মতোই জানেন যে,এদের প্রচলিত সংস্কারে আঘাত হানলে কিছু ভোট কাটা যেতে পারে।আবার এই মানুষগুলোকে যদি শিক্ষিত করে তোলা হয়,তাহলে তাদের উপর হুকুম জারি করাটাও অনেকটাই কঠিন হয়ে যাবে,কমে যাবে প্রভাব।শিক্ষার আলোয় প্রতিবাদের ভাষা জেগে উঠবে,গর্জে উঠবে সাধারণ মানুষ।তাদেরকে ঠকিয়ে নিজেদের আখের গোছানো কঠিন হয়ে পড়বে তখন এই বাবুগোছের লোকজনের।
পল্লীর উপরে তীক্ষ্ম নজর রাখে রামেশ্বরের চ‍্যালা বিশু মণ্ডল।কে কোথায় গেল,কে কি করলো,কে কার সাথে কথা বলল,পল্লীতে বাইরের কে বা কারা প্রবেশ করছে,কার বাড়িতে যাচ্ছে এমনই প্রত‍্যেকটি বিষয় চোখে চোখে রাখে বিশু।আর সে খবর পৌঁছে যায় রামেশ্বরের ডেরায়।ক‍্যাম্পের সাহেব এসেছে খবর পেয়ে তারও দ্রুত আগমন ঘটে পল্লীতে।সাহেব কি বলছে না বলছে তা মন দিয়ে শোনে।মুখের ভাবটা এমন যেন নীরিহ, “ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না” অথচ অসৎ লোকেদের সাথে মেলা-মেশায় এবং তাদের তাবেদারি করতে সে একেবারে সিদ্ধহস্ত।সঞ্জয়বাবু নিজের কথা বলতে শুরু করেন সোজাসুজি ভাবে —
তোমাদের চাষের জমিতে যাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ,আমি কিন্তু তবুও যেতে দিচ্ছি তোমাদের সকলের কথা ভেবে।তবে এবারে মাছ ধরতে যাওয়া কিছুদিন বন্ধ করতেই হবে।
সবজান্তা বিশু এগিয়ে আসে।যে কোনো কাজে উপযাচক হয়ে কথা বলাটা তার স্বভাব —
ক‍্যানো স‍্যার, কি হলো নাকি।ইরা সব চাষা-ভূষো মানুষ, না খাটলি খাওয়া হয় না।তা এরাকোম করলি হয় নাকি?
— এরা সব চাষা-ভূষো মানে,তোমার বাড়ি কোথায়?
— এইতো স‍্যার কাপালি পাড়ায়।
— তুমি কি করো?
—- স‍্যার আমিও এই মাঠে-ঘাটেই কাজ করি।
—- এখানে তোমার কোনো কাজ নেই, তুমি আসতে পারো।যাদের এখানে বাড়ি শুধুমাত্র তারাই থাকো,বাকিরা যার যার বাড়িতে চলে যাও।এখানে ভীড় বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই।আর এখানে যারা আছো সবাই সোস‍্যাল ডিসট‍্যান্স অর্থাৎ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলো।
জগা বলে —
এইডা কি কইলেন বুজলাম না বাপ।আমাগে যদি এট্টু বুজায়ে কও অনেক উবগার হয়।
— হ‍্যাঁ,যে করোনা ভাইরাস এর নাম তোমরা শুনছো,ওটা মানুষ থেকে মানুষের শরীরে ছোঁয়া লেগে ছড়িয়ে পড়ে।যার ফলশ্রুতি হিসাবে যে রোগের সৃষ্টি হয় তার প্রতিষেধক বা ভ‍্যাকসিন এখনো পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি।তাই এই রোগ এলে মানুষের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।সেজন্য সকলে সকলের থেকে দূরে দূরে থাকবে,কেউ বাইরে কোথাও কাজে যাবে না,কোনো আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে কিংবা অন‍্য কোনো দরকারে কেউ কারো বাড়িতে যাবেও না আর তোমাদের বাড়িতেও যেন কেউ না আসে,সেটা সবসময় মাথায় রাখবে।পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে সবসময়, সাবান দিয়ে হাত ধোবে মাঝে মাঝে।
খগেন বলে ওঠে —
ছ‍্যার,কাজকম্ম তেমন নাই,গাঙ থ‍্যাহে যা মাচ হয়,এহন আর বাইরি যাইতে পারি না।ধারেকাচে পাড়ায় লইয়া যায়।দরদাম বেশি নাই,এদিহে জিনিসপত্রর যা দাম বাড়তিচে চড়চড় কইর‍্যা, তাতে প‍্যাটে ভাত দিমু নাকি সাবান দিয়া হাত ধুমু বুজতিচি না।
—– কেন তোমরা তো ইছামতীর চরে চাষের ক্ষেতে কাজ করতে যাও?
—- হঅঅ ছ‍্যার, যাই তো।আমাগে সগলের তো আর নিজের খ‍্যাত নাই,ফসল নাই।কারো কারো আচে আবার কেউ কেউ বাবুগের জমিতে মাইনে খাটে।তা সহল বাবুরা তো আর সমান না।সহল বাবু যদি সুবিৎ ঘোষের মত হইত,তা হইলে তো আমাগে প‍্যাটে দুইডা দানাপানি পড়তো।আর এই হারামি ঘোষ বাবুগে খ‍্যাতে যারা কাজ করতেচেলো এদ্দিন,ওগে মেজোবাবু কইচে ট‍্যাহা কম দেবে,ফসলের দাম নাই নাকি,আরো কত বাহানা দিতেচে।সাতদিন কাজের পরে দুই দিনের ট‍্যাহা দ‍্যায়।

নৃপেন,সুনীল,ভগলা,গোলোক এরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।সকলের চোখেমুখে বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট।একটা চিন্তার ভাঁজ কপাল জুড়ে।গোলোক এতসময় চুপচাপ সব শুনলেও এবারে বলে —
ছ‍্যার,আমাগে এদ্দিন হইলো কাজ নাই,শহরে যাইতাম কাজে,এহন সব বন্দ।কয়দিনের কাজের ট‍্যাহাও মাহাজন দেয় নাই।বলে কইয়ে ভুলোগে সাতে গাঙে মাচ ধরতে যাইতেছ‍্যালাম,এহন কি কইর‍্যা খামু কন দিন দেহি।

—- কেন তোমাদের রেশন দিচ্ছে না?
—- হঅঅ ছ‍্যার, দিতেচে,তা দুই কেজি কইরা চালে কয়দিন হয়।আর চাল না হয় সরকার দ‍্যাতেচে আরো তো খরচা আচে,সবই বোজেন।দুদির পুলা পানগের দুদটুহান কিনুম সেই সব ট‍্যাহা টুকানও নাই।
— আচ্ছা তোমাদের এখানকার মাতব্বরেরা কি কোনো ত্রাণ কিংবা সাহায্য দিচ্ছে না।তারা কি আসছে,খোঁজ খবর নিচ্ছে কোনো?এই সব রোগ সংক্রান্ত ব‍্যাপারে কিছু বলেছে তোমাদেরকে?
চার-পাঁচজন মানুষের একত্রিত গলার স্বর ভেসে আসে —
না সাহেব,এহন আইবে ক‍্যান,ভোট আইলে তহন চারবেলা কইর‍্যা আইবেনে।
শিক্ষিত সঞ্জয়বাবু বিচক্ষণ।কর্মসূত্রে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা।শুধুমাত্র মানুষের সাথে বললে ভুল হবে,সেই মানুষগুলোর ভাষা,সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জীবন প্রণালী এসব প্রত‍্যেকটি বিষয়ে তার নিখুঁত অভিজ্ঞতা।বিশেষত সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন অবহেলিত, বঞ্চিত, রাজনীতির শিকারে পরিণত মানুগুলো তার চোখে উঠে আসে বারবার।সে এক লহমায় বুঝে নেয় পল্লীর এই মানুষগুলোর অবস্থা।বিশুকে এখানে থাকতে নিষেধ করা সত্ত্বেও সে সরে গিয়ে একটু অন‍্য পাশে দাঁড়িয়ে সমস্ত কথাবার্তা শোনে।বৃদ্ধ জগা বলে ওঠে —
জানিস বাপ,এগে চোকেমুকে ছাল চামড়া নাই।ভুটার কাড করতি দশ হাজার বিশ হাজার কইর‍্যা যার কাচ থ‍্যাহে যেম্বায় পারে ট‍্যাহা নেচে।ভুট আইলে তহন কত বড়ো বড়ো কতা কয়।বড়ো নাপানাপি করে।কয় তুমাগে এই দিবানে,ওই দিবানে,আর এহন দুর্দিন আইচে,প‍্যাটে ভাত নাই,তা এগবেলা আইসে খবরটুককানও ন‍্যায় না কি করতিচি, বাঁঁইচে আচি না মইরা গিচি।
— এখানে সবাই আছো,প্রত‍্যেকের বলছি কান খুলে শুনে নাও।আমি তোমাদের ভালো চাই।এই রোগ যদি একবার এলাকায় ঢোকে, কেউ কিন্তু বাঁচবে না,মাথায় রেখো।একজনের হলে আশেপাশের সবার হবে।কোনো চিকিৎসা নেই যে ডাক্তারের কাছে গেলেও সেরে উঠবে।তাই যা বলি শোনো।
ভুলোর কণ্ঠে মিনতির সুর —
ছ‍্যার, আমরা তো গাঙে যাই,মাচ ধরি,কাউর সাতে ছুঁয়াছুঁয়ি কিচু করি না।
— দেখো তোমাদের গাঙ ইছামতীর ওপাশে বাংলাদেশের যে পুটখালি গ্ৰাম, সেখানে পাঁচজন করোনা রুগী ধরা পড়েছে।যদি কোনোরকম ষড়যন্ত্র করে কেউ এদেশে তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে,আর কোনোভাবে তোমাদের সংস্পর্শে আসে ওই ভাইরাস, তাহলে বুঝতেই পারছো কতবড়ো সর্বনাশ হবে।যা বলি তাই শোনো।আর দেখছি তোমাদের জন‍্য কিছু করতে পারি কিনা।
এসব কথা বলে অফিসার চলে যায়।পল্লীর মানুষ গুলোও যে যার ঘরে।তবে এখন কাজ না থাকায় সকলেই প্রায় বাড়িতেই।এক একটা জায়গায় কয়েকজন করে বসে চলতে থাকে জটলা।কথা কাটাকাটিও টুকটাক চলে।অবসরে অনিশ্চিত জীবনে যা হয় আর কি।সত‍্যিই,জীবন জীবিকার অনিশ্চয়তা,পেটে ক্ষুধার আগুন মস্তিষ্কে আঘাত হেনেছে এই মানুষগুলোর।পল্লীর সেই বাহান্নটি ঘর আজ না থাকলেও কম কিছু নেই।প্রতিটি পরিবারেই ছোটো বড়ো মিলে-মিশে প্রায় পাঁচজন থেকে সাতজন সদস‍্য।প্রাপ্তবয়স্ক প্রত‍্যেকের ভারতীয় নাগরিকত্ব না থাকলেও,বাবুদের কাছে উপার্জনের সর্বস্ব ঢেলে দিয়ে,ঘরের মা-বউয়ের সম্মানের বিনিময়েও পল্লীর অধিকাংশ মানুষই এখন নাগরিকত্ব অর্জন করে নিয়েছে।যারা বাকি আছে তাদেরও টাকা দিলে হয়ে যাবে এমনই কথা হয়ে রয়েছে বীরেশ্বরের সাথে।কেউ কেউ টাকা-পয়সা দিয়েও রেখেছে কিন্তু আজকের এই দুর্দিনে কোনো বাবুর দেখা নেই।ভোটের সময় গড়িয়ে এলে তখন বাবুদের পদধূলিতে পুণ‍্যাত্মা হয়ে ওঠে পল্লী।প্রতিশ্রুতির বান আসে,আবার ভোট ফুরালে সে বানের জল অনায়াসে নীচে নেমে যায়।ফুলে ফেঁপে ওঠা ইছামতীর জল যেন নিমেষে তলানিতে গিয়ে ঠেকে।

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।