অণুগল্পে পঙ্কজ কুমার চ্যাটার্জি

অপয়া ধ্রুবদা

আমি তখন ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ি। ধ্রুবদা প্রায়ই আমাদের কোয়ার্টারে আসতো। সবাই ওকে ডাকতো ‘অপয়া ধ্রুব’ নামে। ওর মুখ দেখলে নাকি দিন খারাপ যায়। বেঁটেখাটো গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। মাথায় এক ঝাঁক কোঁকড়ানো চুল। এলোমেলো থাকতো সব সময়। বাম গালে এক বিশাল গোল কালো জড়ুল। ওটাই নাকি খারাপ চিহ্ন। আমার থেকে বয়সে প্রায় দশ-বারো বড় হবে। রেলওয়ে স্কুলে পড়েছে। কিন্তু, পাঁচবার পরপর ম্যাট্রিকে ফেল। এখন প্রাইভেটে পরীক্ষা দেয়। কোন হেলদোল নেই। সারা দিন এক রেল কলোনি থেকে অন্য রেল কলোনিতে ঘুরে বেড়ায়। এমনকি রেলের অফিস-বিল্ডিং গুলোতেও ওর যাতায়াত আছে। আলিপুরদুয়ার জংশন রেল কলোনির মানুষ এক ডাকে ওকে চেনে। যেমন বিখ্যাত তেমন কুখ্যাত।

আমাদের কোয়ার্টারে আসলে ওর মুখ না দেখে উপায় ছিল না। আমি কিন্তু বুঝে পাইনি ধ্রুবদার মুখে জড়ুল কি হারামের কারণ হতে পারে! সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস শাসনের শেষ দিক। বামপন্থী আন্দোলন মাথা তুলছে। কলেজে ছাত্র পরিষদ আর ছাত্র ফেডারেশেনের মধ্যে সংঘাত লেগেই থাকতো। রেল কলোনির অনেক ছেলেমেয়েই কলেজে পড়তো। ফলে ছাত্র রাজনীতির আঁচ রেল কলোনিতেও এসে পড়তো। ধ্রুবদার অনেক স্কুল-বন্ধু কলেজে পড়ে বা পাশ করেও গেছে। ওদের সাথে মেশার সুবাদে সেও পরোক্ষ ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। একদিন রেল বাজারের কাছে পোস্ট অফিসে চিঠির খোঁজে গেছি। গিয়ে দেখি পোস্ট অফিসের পাশে একটা চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে ধ্রুবদা বক্তৃতা দিয়ে চলেছে। বাজার ফেরতা মানুষ এবং অনেক যুবকও সেখানে জমে গেছে। সবাই মনোযোগ সহকারে ধ্রুবদার বক্তৃতা শুনছে।

ক্লাস নাইনে ওঠা পর্যন্ত ধ্রুবদার পাশ করার খবর পাইনি। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতায় পড়তে আসি। তখন ধ্রুবদার কথা ভুলেই গেছিলাম। অনেক দিন পড়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা আনন্দবাজার পত্রিকাতে প্রকাশিত ধারাবাহিক “খুদকুড়ো”র এক পর্বে এই ধ্রুবদার নাম পাই। লেখক লিখেছেন যে উনি শুনেছেন ধ্রুবদা ম্যাট্রিক পাশ করার পর বিএ এবং এমএ ভালোভাবে পাশ করে নাকি এক স্কুলে শিক্ষকতা করেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বাবা আলিপুরদুয়ার জংশনে ডিভিশনাল ম্যানেজার ছিলেন। ওই সময় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কুচবিহারে হোস্টেলে থেকে স্কুলে পড়তেন এবং প্রতি শনিবার বাবার কোয়ার্টারে আসতেন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।