সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ১৬)

বাউল রাজা

(তৃতীয় খণ্ড ষোড়শ পর্ব)

কতক্ষণ ওরা এই প্রেমভাবে ছিলেন সেটা আমার জ্ঞানে নেই, এখন সে কথা মনে পড়লে ভাবি, তাহলে আমারও কি বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়েছিলো, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি এ কথার কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। ওদের এই তুরীয় অবস্থায় আমার তো কোনো ভূমিকা ছিলো না। তবে এরপর কানাইদা আমাকে অনেকসময় সুদামসখা বলে ডেকেছেন, কারণ জিজ্ঞাসা করলে ঘন বাদামী রঙের গোঁফের আড়ালে দন্ত বিকশিত করেছেন। বলেছেন–
— ” এই দ্যাকো দিকি, মনে নিলে মুকে বলতে পারবো না? ”
–” আহা, মনে কেন নিলো সেটাই তো জিজ্ঞাসা করছি। ”
—” আচ্চা পদীপদাদা, মনরে কে কবে শাষণে রাকতে পেরেচে বলো দেকি? ও হারামজাদা যে খর গীষ্মকালেও কদমফুলের সুবাস পায় গো। জ্যান্ত মানুষরে ফেলে, পাতরের মদ্যেও নারায়ণ খুঁজে মরে। এই তুমিই না গেয়েচিলে একদিন – মন বলে আমি মনের খবর জানি না?

এটাই হলো কানাইদা, কোন কথার পানসিকে যে কোন ঘাটে নিয়ে গিয়ে ভেড়াবে সে কেউ বলতে পারেনা। তবে যে ঘাটেই ভেড়াক না কেন, এটা স্থির নিশ্চিত যে সে ঘাট কখনোই আঘাটা হবেনা।
দুজনার সে ভাব মজলে বাউলদিদি কাছে এসে কাঁধের ওপর দুহাত রেখে এসে দাঁড়ালো। আমি চমকে উঠলাম। এর আগে এভাবে সবার সামনে ভামিনী কোনোদিনও এভাবে কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়ায় নি। ওর যেন সেসব দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই।

— বলি একটা কতা বলপো ঠাকুর? অন্যায় নিও না যেন।
আমি আলগোছে আমার কাঁধ থেকে ওর হাত নামিয়ে ওর দিকে চাইলাম। একটা অন্য ধরণের সুগন্ধ ভেসে আসছে ওর শরীর থেকে। এই যে এতোটা পথ ওর সাথে হেঁটে এলাম। আর সে হাঁটায় ঘনিষ্ঠতাও ছিলো যথেষ্ট, কিন্তু এ সুবাস তো তখন পাইনি! একটু যেন দুষ্টুমির হাসির রেখা খেলে গেলো বোষ্টুমির ঠোঁটে।

— আমাদের একটা বিশেষ কাজ পড়ে গেচে গো ঠাকুর। একুনি একটু আটলা গেরামে যেতে হপে। তুমি কি একটু একাএকা বাড়ি যেতে পারবে? আমাদের দেরী হপে না, এখুনি চলে আসপো। কিচু কী মনে করলে?

আমার আবার মনে করার কী আছে? গিয়ে না হয় দাওয়াতেই একটু বসলাম। বাউলের ঘর, না আছে সিন্দুক, না আছে আলমারি। ঘর আছে তার দুয়ার তো নাই।

— শোনো ঠাকুর, তুমি কিন্তু দাওয়াতে শোবে না একদম। ঘরে বিচানা পেতে রেকে এয়েচি। সেকানেই শোবে কেমন?

আজকাল আমি আর এদের কোনোকিছুতেই অবাক হই না। মনের কথা ঠিক কেমন করে যে এরা টের পেয়ে যায়?
ওদের সঙ্গ ছেড়ে, উপস্থিত সবাইকে প্রণাম জানিয়ে আমি বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম। শ্মশান থেকে বাড়ি ফিরতে গিয়ে পথের বাঁদিকে ফের ব্রীজটা নজরে এলো। এখানকার রাস্তাটা স্বাভাবিকভাবেই রাস্তার অন্য অংশের তুলনায় একটু উঁচু। সেই উঁচু অংশের ঢাল পেরিয়ে পথে পা দেওয়ার থেকে সামান্য দুচারপা হাঁটলেই বাঁদিকে নদী। সাথে টর্চ নেই, আমি তো আর এখানে আসবো বলে আসিনি, আমাকে কয়েদ করে আনা হয়েছে।
হঠাৎ করে খিলখিল করে হাসির আওয়াজে চমকে উঠলাম।
— কি গো ঠাকুর, তোমায় একা একাই পাটিয়ে দিলো বুজি?

( ক্রমশ )

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।