মহুয়াকে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতে দেখে প্রধানশিক্ষক মহাশয় এগিয়ে এসে বলেন–কী ব্যাপার মহুয়া নটা বেজে গেল আসতে?সাড়ে নটায় গেষ্টরা সব চলে আসবেন!তুমি কখন কী করবে?মহুয়া নতমস্তকে বলে-স্যার, মাঝরাস্তায় গাড়িটি প্রবলেম হয়েছিল।কিন্তু আপনি চিন্তা করবেন না,আমি এক্ষুনি সব ব্যবস্থা করে ফেলছি।স্যার বলেন —-আচ্ছা, যাও তাড়াতাড়ি।
মহুয়া চলে যেতেই প্রধান শিক্ষক মহাশয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।এতক্ষন টেনশন করলেও মহুয়ার ওপর ভরসা ষোলআনা আছে,ও ঠিক সব ম্যানেজ করে নেবে।না,একবার রান্নার ওখানে যাই-দেখি ওরা কী করছে !
আধঘন্টার মধ্যেই সব সাজানো, গোছানো রেডি।মহুয়া, তমালিকা ,অচিন্ত্য এই তিনজনে নিমেষে সব ঠিক করে দিল।নিজেরাও স্যার, ম্যাডামরা আজ খুব সেজেছেন।আসলে বছরের এই একটি দিন বিদ্যালয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠানে সবাই খুব আনন্দ করেন এবং নিজেরা ও পারফর্ম করেন। তার সাথে ছাত্রছাত্রীদের ও শিখিয়ে, পড়িয়ে খুব সুন্দর ভাবে তৈরি করেন।অনুষ্ঠান শুরুর আগে স্টাফরুমে নিজেরা সবাই একসাথে ছবি ও তোলেন। এরপর অনুষ্ঠান শুরু হয় ,মহুয়া, তমালিকার দ্বৈত কণ্ঠে ‘এসো আলো ,এসো হে,তোমায় সুস্বাগতম’গানটি দিয়ে।তারপর যথারীতি একে একে গেষ্টরা ও আসতে শুরু করেন।তাঁদের অভ্যর্থনা, মাঝে,নাচ,গান, বক্তব্য চলছে।হঠাৎ একটা বোলেরো ঢুকলো,প্রধান শিক্ষক মহাশয় ছুটে গিয়ে অতিথিকে নিয়ে এলেন মঞ্চে।এতক্ষণ মহুয়া সঞ্চালনা করছিল তার মনোমুগ্ধকর কণ্ঠ ও ভাষার জাদুকরী ছোঁয়ার অপূর্ব গুণে।দর্শক চুপ করে বিভোর হয়েছিল।হঠাৎ প্রধান শিক্ষক মহাশয় অচিন্ত্য কে কানে কানে কী বলায়-অচিন্ত্য এবার মঞ্চে মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে বলতে শুরু করেন—আজ আমাদের পরম সৌভাগ্য যে,ডক্টর ত্রিদীপ রায়কে আমাদের মধ্যে পেয়েছি, উনি ভীষণ খ্যাতিমান ব্যস্ত একজন ডাক্তার।উনি যে আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে এসেছেন, এইজন্য আমরা নিজেদের কৃতার্থ মনে করছি।উনার গুণের কথা একবার বলতে শুরু করলে বোধহয় আর শেষ হবেনা।উনি মৃত মানুষকে ও বোধহয় প্রাণদান করেছেন।তো আমরা এর বেশি কিছু বলছি না,এখন উনাকে বরণ করে নিচ্ছেন এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্রী সৃজন চ্যাটার্জি মহাশয়।সকলে যখন হাততালিতে ব্যস্ত, তখন মহুয়া তীব্র রাগে হাতের স্ক্রিপ্ট টা তমালিকা হাতে দিয়ে শরীরটা খারাপ লাগছে বলে স্টাফরুমে চলে আসে।এই ডক্টর রায়ের এত প্রশংসার বন্যা মহুয়ার সহ্য হচ্ছে না।মাইকের আওয়াজ স্টাফরুমে ও গমগম করছে।মহুয়া দুটো হাত কানে দেয়,তবুও রক্ষা হয় না।কী করবে সে?তবে কী ছুটে গিয়ে মঞ্চে উঠে সবার সামনে খুলে দেবে ওই লোকটার মুখোশ?না,না কেউ বিশ্বাস করবে না।বরং ওই বিখ্যাত ক্ষমতাবান মানুষটির কথাই সবাই বিশ্বাস করে,মহুয়াকে পাগলের দলে ফেলে দেবে।কিন্তু এত বছরের এই তুষের আগুন যে নিভছে না !দিনদিন বেড়ে এ তো আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটাবে ?
কলেজে পড়ার সময় কোনো এক বৃষ্টি ঝরা বর্ষার দিনে আলাপ মহুয়ার সাথে ত্রিদীপের।প্রবল বর্ষায় ভিজতে থাকা মহুয়ার সামনে ছাতা ধরে দাঁড়ালো ছেলেটি।মহুয়া অন্যসময় হলে এমন অযাচিত উপকারে রুদ্র মূর্তি ধরলেও আজ এই দূর্যোগে ভয়াবহ পরিস্থিতি জেনেই খুশি হয়েই পরিচয় জিজ্ঞাসা করে ,জেনেছিল-নাম ত্রিদীপ রায়।প্রথম বর্ষের বায়োসায়েন্স এর ছাত্র।মহুয়া অবশ্য পিওর সায়েন্স।যাই হোক এরপর বন্ধুত্বের রসায়ন জমে ওঠে।ধীরে ধীরে প্রেম ,প্রতিশ্রুতি ও।কিন্তু যেহেতু দুজনেই সিরিয়াস তাই,ক্যারিয়ারকে প্রাধান্য দেয়।ইতিমধ্যে ত্রিদীপ মেডিক্যাল এ চান্স পেয়ে যায়।কিন্তু টাকা পয়সার জন্য কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লে মহুয়া দাঁড়ায় পাশে।মহুয়া বাবা মার একমাত্র সন্তান।এরপর ত্রিদীপের ডাক্তার হওয়া, এদিকে মহুয়ার ও এম এস সি কমপ্লিট হয়ে,বি এড চলছিল বেশ।।তারপর হঠাৎ একসময় মহুয়ার বাবার হার্ট এটাক হয়ে মৃত্যু হলে মহুয়ার মা মেয়ের বিয়ে দিতে একপা।যথারীতি ,একবছর পরই দুই বাড়ির উদ্যোগে বিবাহ হলেও মহুয়ার মনে হয় ত্রিদীপের যেন কেমন পরিবর্তন।প্র্যাকটিস মন্দ চলছিল না,কিন্তু ওর স্বপ্ন আরো বড় এম .বি .বি. এস করা বিদেশে গিয়ে।কিন্তু এত টাকা কোথায় পাবে?এখানে ও আবার মহুয়ার ওপর চাপ ।বহু সাধের ক্যানিং স্ট্রিটের জমিটা বিক্রি করে বিদেশ গেল।সেদিন থেকেই মহুয়া চিনলো অন্য এক ত্রিদীপকে,যে কিনা স্বার্থের জন্য মহুয়াকে বিয়ে করেছে?হাজার প্রশ্ন মহুয়ার মনে ভিড় করে।মা,বারবার জমিটা বিক্রি করতে নিষেধ করেছিল,তবুও মহুয়া ভালোবাসার কাছে দূর্বল হয়ে গেছে।
হঠাৎ একদিন মহুয়ার প্রচণ্ড পেটের যন্ত্রণা।আই কিউ সিটিতে ভর্তি করতেই ধরা পড়লো সিস্ট।অপারেশন করতেও মহুয়ার মাকেই জমানো টাকা ভেঙে করতে হলো।এরপর শ্বশুরবাড়ির হালচাল দেখে মহুয়া প্রিপারেশন নিয়ে এস.এস. সি তে বসলো,এদিকে ত্রিদীপ আর সেই মতো ফোন বা খবরাখবর নেয়না।মহুয়া দিনরাত মনমরা হয়ে থাকে।এইভাবে সময় চলে যায়।একবছরের মাথায় মহুয়ার আবার সিস্ট! ডক্টর রা বলছেন এটা চকলেট সিস্ট-অজস্র ছোট্ট ছোট্ট সিস্ট নাড়ির সাথে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে ,একে বার করতে হলে ওভারি ও বাদ দিতে হবে।মহুয়ার শ্বশুর বাড়ির সবার আপত্তি থাকায়,সেবার অপারেশন হল না।কিন্তু ইঞ্জেকশন নিয়ে মহুয়াকে দিনের পর দিন যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়।একটা সময় বাধ্য হয়ে মহুয়ার মা ত্রিদীপ নেই, নিজে বন্ড সই করে ওপারেশন করায়-ওভারি বাদ দেয়।বাড়ি ফিরে থেকে শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা অসহ্য লাগে।ওদিকে ত্রিদীপের সাথে বাড়ি র ভালো যোগাযোগ।তাই সে ওএকজন এতবড় ডাক্তার হয়ে কিছু না বলে যেন, এড়িয়ে চলছে মহুয়াকে।এইসব দেখে মেয়েকে মহুয়ার মা কিছুদিন নিয়ে যায়।কিন্তু দেখা যায় ওরা যেন যোগাযোগই রাখছে না।বাহ্, ,যাকে জীবনের সমস্ত কিছু দিয়ে এতবড় ডাক্তার করানো হলো-আজ তার এই প্রতিদান?ভালোবাসা ছিল শুধু প্রয়োজনের?যতদিন মহুয়াকে স্বার্থের জন্য প্রয়োজন ছিল, ততদিন ছিল প্রিয়জন?শুধু টাকার জন্য ভালোবাসা-না কি সবটাই ছিল অভিনয়? ভেবে ভেবে না খেয়ে,না ঘুমিয়ে দিনের পর দিন মহুয়া অসুস্থ হয়ে পড়লো। একসময় ত্রিদীপ ফিরলো,কিন্তু না।মহুয়া ফোন করে করে তাকে নিয়ে এলে তার একটাই কথা–তুমি আমার জন্য ওয়েট করলে না?মহুয়া অবাক হয়ে বলে–একদিন তুমি বলছিলে যে,আমার গাছকে দরকার।আর আজ তুমি একথা বলছ?মা- মেয়ের জীবন বিপন্ন দেখেও থাকতে পারে?তুমি পারতে?ত্রিদীপ চুপ দেখেই মহুয়া বুঝতে পারে তার মতামত।হঠাৎ মহুয়া ত্রিদীপের হাতদুটো ধরে বলে –বলো আমরা কারো সন্তান এডাপ্ট্ করতে পারিনা?একজন অনাথ বাচ্চা মা,বাবা পাবে।কিন্তু শুনে ত্রিদীপ হাত ছাড়িয়ে নিষ্ক্রিয় থাকে।মহুয়া চুপ করে যায়।
এরপর থেকে ত্রিদীপ কম আসে,ফোন করলে ধরেনা।মহুয়াকে নিয়ে যাওয়ার নাম নেই।মহুয়া অনেক বার অনুরোধ করলেও সাড়া দেয়না।একদিন মহুয়া জোর করে চলে যায়,কিন্তু কয়েকদিন পর শুরু হয় মানসিক অত্যাচার।শাশুড়ি যত রকম নোংরা কথাবার্তা শুরু করে।ত্রিদীপ তো সংসারের কোনো ব্যাপারে থাকে না।রাত করে বাড়ি ফেরে শুধু হাসপাতাল, হাসপাতাল করে।এরপর সবচেয়ে বড় নার্সিং হোমে জয়েন করে নিজেকে আরো ব্যস্ত করে তোলে।ব্যস শুরু হয় দূরত্ব।এতদিনের স্বপ্নের মানুষের বহুমুখী রূপ ধরা পড়তে থাকে।ওই স্যাঁতস্যাঁতে ভিজে মানুষ দেখতে নিরীহ মনে হলে ও তার মুখোশ যেন মহুয়ার কাছে স্পষ্ট হয়ে আসে।
ইতিমধ্যে কানাঘুষো মহুয়া শুনতে পায়- ত্রিদীপ এক লেডি গাইনো ডক্টর এর সাথে জড়িয়ে গেছে।তাই তার চালচলনে পুরোপুরি পরিবর্তন।মহুয়া প্রতিবাদ করলে শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন ও।শাশুড়ি শোনায় মহুয়াকে-সব তোমার জন্য আমার ছেলে আজ এমন করছে।মহুয়া ঈশ্বরকে বলে-বাহ্।ঈশ্বর, এতকাল আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে যাকে গড়ে দিলাম, আজ সন্তান দিতে অক্ষম বলে আমি তার কাছে একেবারে ব্রাত্য হয়ে গেলাম? এই আমার একান্ত প্রিয়জন?আমি শুধুই প্রয়োজনের ছিলাম?শোকে,দুঃখে রাগে,অভিমানে,ঘৃণায় মহুয়া ওইবাড়ি ছেড়ে চলে এলেও কেউ একবার খোঁজ ও নিল না?
এইসব শোকে যখন মহুয়া জর্জরিত তখন হঠাৎ জানতে পারলো এস. এস. সিতে পাশ করেছে।ইন্টারভিউ ও দিয়ে এলো ,ভালোই হয়েছে।ইতিমধ্যে একদিন দেখে ত্রিদীপের ডিভোর্স লেটার।একবার ভাবলো সই করবে না,কনটেষ্টে যাবে।আবার ভাবলো-না,কী হবে জোর করে কী ভালোবাসা পাওয়া যায়?তাই মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স দিয়ে দিল এক বহুরূপী, মুখোশ ধারী সরীসৃপকে চরম ঘৃণায়।একজন আত্মসম্মানী মেয়ে কী করে থাকে এই লোকটার সাথে? সেই শেষ দেখা তার সাথে।
এরপর ঈশ্বরের করুণায় হোক যাই হোক মহুয়ার স্কুলে চাকরীটা কিন্তু হয়ে যায়।এই চাকরি তাকে বাঁচতে শিখিয়েছে,আর মা যেন প্রতিপদে তার হাত ধরে ধরে তাকে পথ চলতে শিখিয়েছে। –কিরে মহুয়া এখানে বসে কী ভাবছিস?তোকে স্যার ডাকছেন মঞ্চে।তাছাড়া তমালিকা ও ছটফট করছে তোর জন্য।কীরে শরীর খারাপ?সুকেশবাবুর কথাগুলো শুনে চমকে মহুয়া তাকায়।
-হ্যাঁ, যাচ্ছি স্যার। মহুয়া যখন মঞ্চে যায় দেখে ডক্টর ত্রিদীপ রায় বক্তব্য রেখে স্যার কে মাক্রোফোন দিলে, স্যার ধন্যবাদ জানিয়ে মহুয়ার হাতে তুলে দেন।এরপর গান চলাকালীন স্যার মহুয়ার সাথে পরিচয় করালে -মহুয়া রাগে নমস্কার করে বক্রভাবে তাকালে ,ডক্টর রায় রিয়েকশন বুঝে প্রতিনমস্কার জানান।মহুয়ার ইচ্ছে করে চিৎকার করে মুখোশটা ছিঁড়ে ফেলে সবাইকে জানাতে।কিন্তু পারে না।এমন সময় অচিন্ত্য ঘোষণা করেন –ডক্টর রায় খুশি হয়ে এই বিদ্যালয়কে একলক্ষ টাকা দান করলেন।শুনে মহুয়ার শরীর রি রি করে উঠলে এইসময় তমালিকার গান দিয়ে একটু নিজের অস্বস্তি ঠিক করে। তারপর সবশেষের একটা ক্লাস ফাইভের মেয়েদের জমজমাট নাচ ডক্টর রায়কে ও মুগ্ধ করলো।সকলে উঠে হাততালি দিলে, স্যার ও ছুটে এসে মাইক্রোফোনটা নিয়ে অভিনন্দন জানালে বাচ্চারা খুব খুশি হয়।
মহুয়ার আনন্দে চোখ দিয়ে যেন মুক্ত ঝরছে।এমন সময় স্নেহা ছুটে এসে-‘ মা’ করে জড়িয়ে ধরলে -মহুয়ার সব রাগ,ক্ষোভ ,,দুঃখ জল হয়ে অশ্রু রুপে গাল বেয়ে গড়িয়ে জীবনের সব প্রাপ্তির কলস পূর্ণ করে দেয়। যে আনন্দাশ্রূ ঘা খাওয়া জীবনে ও জয়ের আনন্দ দেয়?এই তো মহুয়া সব পেয়েছে! যেদিন স্নেহাকে এডাপ্ট করে ,সেদিন ও মহুয়া জানতো না যে,সে একে জন্ম না দিয়ে ও সফল মা হয়ে উঠতে পারবে !
অনুষ্ঠান শেষে মঞ্চ থেকে স্নেহার হাত ধরে আসতে আসতে ওই বহুরূপী বিষাক্ত সরীসৃপ
গাড়িতে ওঠার আগে বারবার চেয়ে চেয়ে মহুয়া ও স্নেহাকে দেখছিল, যা দেখে মহুয়ার মুখে প্রচণ্ড রাগের মাঝেও এক আত্মতৃপ্তির হাসি ঠিকরে বের হয়ে ,গোধূলির সূর্যের সঙ্গে একাকার হয়ে তাকে আরো মোহময়ী করে তুলছিল।