সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ৩)

পদাতিক

একটি বাচ্চা মেয়ে আমার আর মাস্টারের সামনে দুটো চেয়ার রেখে গেলো। আমরা ডাইনিং হলের সামনে সামান্য একটু অপ্রশস্ত জায়গায় লোহার শেকল দিয়ে ঝোলানো কাঠের পাটার দোলনায় বসে আছি। আমাদের বাঁপাশে একটা গোড়াবাঁধানো ছাতিমগাছ আর একটা পলাশ গাছ ডালপালায় জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক ওগুলোর পেছনেই মন্দির। মন্দিরের ঠাঁয়ে মাকালী আর শিবের অধিষ্ঠান। মেয়েটা চেয়ারদুটো পেতে দিয়ে মন্দিরের সামনেকার টগরফুল, জবাফুলের গাছ থেকে ফুল তুলতে শুরু করলো। কোত্থেকে আরও তিনচারজন সাত আট বছরের মেয়ে এসে মন্দির পরিষ্কার করা, মন্দিরের বাসনকোসন মাজাধোয়া করতে শুরু করে দিলো। আশ্রমের আলোকস্তম্ভের আলোগুলো ততক্ষণে জ্বলে উঠেছে।
সীমা দুবাটি মুড়ি, আলুভাজা আর গরম ধোঁয়া ওঠা চা চেয়ারদুটোতে রেখে সামনে দাঁড়ালো। –” ও জ্যেঠু, তুমি চিনিছাড়া লাল চা খাও তো? ”
–” কীভাবে বুঝলে? ”
–” এখন তো বেশীরভাগ লোকই সেটাই খায় গো। ”
মন্দিরের পুরোহিত ততক্ষণে হাতঘন্টা বাজানো শুরু করেছেন,
চারদিকে ধুনোর গন্ধ উড়ে বেড়াচ্ছে, খুব সুন্দর একটা পবিত্র পরিবেশ তখন আমার চারপাশে। বাচ্চারা একে একে হাতে স্টিলের থালা নিয়ে খাওয়ার ঘরে যাচ্ছে। টিফিন খাওয়া শেষ হলেই পড়াশোনা শুরু। মাথার ওপর হাল্কা মেঘের চাদর, সামনে মেয়েদের হস্টেলের মাথার ওপর দিয়ে চাঁদ ওঠার আভা। এই আভাটাকেই কি চাঁদোয়া বলে? নিশ্চয়ই না, তাহলে কি চন্দ্রাতপ? সেই তো একই হলো, চাঁদোয়া আর চন্দ্রাতপ কি আলাদা কিছু? নিশ্চয়ই না।

— ” আমি যখন আশ্রমে আসি তখন এই বাড়িঘর কিছুই হয় নি।”
মুড়ির বাটিটা হাত থেকে চেয়ারের ওপর রেখে বুদ্ধ মাষ্টার চায়ের কাপটা তুলে নিলো। বাঁ পা খানা দোলনার কাঠের পাটায় ভাঁজকরা, আর ডান পা মাটিতে রেখে মাষ্টারের চোখ আকাশে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে।
–” বৌটাকে কিছুতেই বাড়িতে রাখতে পারলাম না, অনেক চেষ্টা করলাম জানেন, এমনকি মেয়েদুটোকে মায়ের কাছে রেখে আমি সেই সুন্দরবনের গভীরের একটা গ্রামে, ওর বাড়িতে গিয়েও অনেক করে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ উপরোধ করেছি। কিন্তু কোনো গরু যদি একবার মাঠের ঘাস খাওয়া শুরু করে তাহলে… ”

মাষ্টারের মুখে যেন বাদলের মেঘ বাসা বেঁধেছে। কেন জানিনা ওর মুখটা সেই চাঁদোয়ার দিকেই তুলে রেখেছে। কতোদিন বাদে যে আলুভাজা আর মুড়ি খাচ্ছি। এখানকার মুড়িতে বেশ একটা মিষ্টি স্বাদ আছে।
–” মিথ্যে কথা বলবো না জ্যেঠু, ও বড় মেয়েটাকে রাখতে চেয়েছিলো কিন্তু আমি দিইনি। কেন দেবো বলুন দেখি? আমি জানি, মেয়েদুটোকে আমি মা ও বাবা দুজনের ভালোবাসা, কর্তব্য আর স্নেহ দিয়ে আগলে রাখবো, কিন্তু ও? ওর কাছে রেখে এলে ও কি আর… ”
এখানে গাছগুলোর পাতার নীচে ছায়ারা এসে বাসা বেঁধেছে। সেই আলো আঁধারিতে আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম মানুষটার চশমার ফাঁক গলে একটা আবেগের ফোঁটা নিঃশব্দে চায়ের কাপের ভিতর ঝরে পড়লো।

–” ও জ্যেঠু, টালিগঞ্জে তো সিনেমা তোলা হয় নাকি গো? তুমি কোনোদিনও সত্যিকারের হিরোইন দেখিছো? ”
সীমা এসে মুড়ির বাটি আর চায়ের কাপ তুলতে তুলতে আমার দিকে মুখ করে দাঁড়ালো।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।