অথ শ্রী উপন্যাস কথা-তে প্রদীপ গুপ্ত – ধারাবাহিক – ১

শুরু হলো আমার পঞ্চম উপন্যাস, একজন পর্যটকের চোখে কাশ্মির।
সমস্যা, রাজনৈতিক ঘাতপ্রতিঘাত, ও প্রেমের এক অনুভূতিশীল জীবনালেখ্য।
“পশমিনা”
প্রথম খণ্ড
— ঈদ মোবারক হো স্যারজি।
একমুখ না কামানো দাড়ি, আধময়লা শেরওয়ানি, আর একমুখ হাসি নিয়ে বছর পঁয়ত্রিশের এক কাশ্মিরী যুবক এসে নমস্কারের ভাঙ্গিতে এসে সামনে দাঁড়ালো।
— হামারা তরফসে ভী ঈদ মোবারক হো ভাইয়া,।
গুলমার্গের গেটের বাইরে গাড়ির স্টাণ্ডে দাঁড়িয়ে বেগর শক্কর ব্যালাক কফির কাপে বেশ আয়েশ করে ঠোঁট ছুঁইয়েছি। সঙ্গী সাথীরা গণ্ডোলার রোপওয়েতে চেপে আকাশ থেকে বরফ দেখতে গেছে। আমি বেচারা, হার্টে স্টেন বসানো রোগী, ভয়ে ভয়ে কোনোমতে বউয়ের জোরজবরদস্তির শাষণ মেনে অমিতবিক্রমে প্রায় ন’হাজার ফুট ওপরে এসে কফি খাচ্ছি। ওদিকে বৌ দলবল নিয়ে চোদ্দ হাজার ফুট ওপর থেকে কচ্ছপের পিঠ দেখবেন বলে খুশীতে ডগমগ করে রোপওয়েতে ঘুরতে গেছেন।
— চলিয়ে স্যারজি, হাম আপকো ছে ছে পয়েন্ট ঘুমাকে দিখায়েঙ্গে।
— ইয়েতো বহত খুশীকা বাত ভাইয়া। চলো দিলদার চলো, চাঁদ কি পার চলো, হামে তৈয়ার চলো —
— বাবুজি, আজ ঈদ কা দিন হ্যায়। খুশীকা দিন বাবুজি। চলিয়ে ম্যায় ভি তৈয়ার হ্যায়। কুছ নেহি লেঙ্গে আপসে। এয়সা হি চলিয়ে।
— এই দাঁড়াও — দাঁড়াও, ইতনাসা মেহেরবানী নেহি চাহিয়ে। কেয়া কেয়া পয়েন্ট দিখাওগে আউর কিতনা লেঙ্গে বাতাও পহেলে।
— বাবুজি – খোদা মেহেরবান তো গিদ্ধড় ভি পাহলোয়ান। আপকা মর্জিমে যো হোগা ওহি দে দিজিয়েগা। শোচো মৎ।
— দ্যাখো বাপু, আমি জোর সে জোর ছশো টাকা দিতে পারি।
— ওয়াও — ব্যাস ওহি সে চলেগা বাবুজি। না জানে কিউ আপ হামারা দিল জিৎ লিয়া, দিল বহত কিমতি চিজ হ্যায় বাবুজি, আওর আপনে তো — আচ্ছা, পহেলে বাতাও কাঁহা চলে?
— বোঝ কাণ্ড! আরে বাবা ম্যায় এক পরদেশী হু ভাই মেরে, মেরেকো কেয়া মালুম কাঁহা চলে। আপকা য্যায়সা মর্জি ওহি চলো মেরে ভাইয়া।
— আপকা ফটো খিচনা হ্যায় না?
এই মানুষটিকে কে পাঠালো আমার কাছে! একদম এ কথাটাই যে এতোক্ষণ মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিলো। চারদিকে অগণিত প্রমত্ত বসন্তেরা যে লুটোপুটি খাচ্ছে আদিগন্ত বিস্তৃত শ্বেতশুভ্র বরফ ক্ষেতের মাঝে সে ছবি দেখে আমারও যে কী ভীষণ ইচ্ছা হচ্ছিলো এতোক্ষণ। মনে মনে ভাবছিলাম কাকে বলি কিছু ছবি অন্তত স্মৃতি হিসেবে তুলে দেওয়ার জন্য।
— ভাইয়া মেরে, খিচনা হ্যায় তো পহেলা ফটো হাম দোনোকা হোগা।
— বাবুজি, ইহা আও, ইসি ইস্পট মে আচ্ছা হোগা। লেকিন এক রিকুইস্ট হ্যায় বাবুজি, হামারা ফোটো ফেসবুকমে নেহি দিজিয়েগা।
সেকিরে! সবাই যখন ফেসবুকে তাদের ছবি পোষ্ট করতে পাগল হয়ে উঠেছে তখন এই মানুষটি… আমি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইলাম ওর দিকে।
— বাবুজি, আপলোগোনে নহি সমঝেগা বাবুজি, আপকা কশ্মির অওর হমারা কশ্মির এক য্যায়সা নহি।
দেখলাম ওর হাসিখুশী মুখটা যেন সামান্য কঠিন হয়ে উঠলো। হঠাৎ যেন মনে হলো চতুর্দিকের এই কঠিন কঠোর শ্বেতশুভ্র বরফের বুকে বিন্দু বিন্দু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লাল টিউলিপের রঙে রাঙা রক্তের ফোটা।
— যারাসা মুস্কুরাও ভাইয়া। দেখো সূরজ ভি আজ কিতনা খুশিকা মুডমে হ্যায়। কিতনা রওশনদার হ্যায় ও, আজ না খুশীকা দিন!
— হমারা নাম ভি রওশন বাবুজি। হমকো দুখ নেহি ছু সকতা কভি। চলো, পহেলে আজ আপকো এক বহত সুন্দর ইস্পটমে লে যাউঙ্গি। মহারাজা প্যালেস।
উঠে বসলাম গাড়িতে। ওর পাশের সিটেই। চতুর্দিকে সাদা বরফের মাঝে জলপাই রঙের ছোপ। ভারতীয় জওয়ানেরা বন্দুক হাতে আমাদের সীমান্ত পাহারায় ব্যস্ত।
— এখানে এতো বিএসিএফ কেন?
— আপকা দেশ, স্যরি হমলোগোকা দেশ রক্সা করনেকে লিয়ে বাবুজি।
কথাটায় ঠোক্কর খেলাম। বুঝলাম ” আপকা ” শব্দটা ওর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। চারদিকের বরফের চাদরে মোড়া পাহাড়ের অপরূপ রূপ দেখতে দেখতে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো — সচ সচ ইয়ে জান্নত হ্যায়।
— ইয়ে সচ হ্যায় বাবুজি, হমারা কশ্মির বহত সুন্দর হ্যায়। ধরতি কি জমিন পর ইতনা সুন্দর অউর খুশবুদার দুনিয়ামে আউর কাঁহা পে ভি নহি হ্যায়।
সত্যিই তাই আমি ভারতের বাইরে পৃথিবীর কোনও দেশই দেখিনি, শুধুমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া। কিন্তু ভারতবর্ষের বহু রাজ্য আমার দেখা, কাশ্মিরের সৌন্দর্যের তুলনা মেলা ভার।
— লেকিন বাবুসাব, কভি কভি সুন্দর হোনা ভী গুনাহ হোতি হ্যায়।
(ক্রমশ)