সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ৭)

পদাতিক

পূবের আকাশে একফালি চাঁদ তার সমস্ত কৃপণতা ছেড়ে প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে পৃথিবীকে যতটুকু আলোয় ভরে দেওয়া যায়। তবুও আমগাছের ডালে, পাতায় জমাটবাঁধা অন্ধকারকে কিছুতেই যেন বাগে আনতে পারছে না ঐ শুক্লা পঞ্চমীর চাঁদ। প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারকে আলোয় ভরিয়ে তুলতে। চারদিকের গাছগাছালির বুকে ঘর বাঁধা ঝিঝি পোকারা ততক্ষণে তাদের একটানা বৃন্দগান শুরু করে দিয়েছে। বৌদি আটকে আসা গলাটাকে পরিষ্কার করলেন।
–” মিনু আমাদের খুব — মানে আমরা সত্যিই খুবই ভালোবাসতাম ওকে। ”
বৌদি যেন একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছেন। ভারী গলার স্বর ক্রমশই আরো ভারী হয়ে আসার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
–” সত্যি বলতে কি, আপনার দাদা তখনই আমায় বলেছিলেন মিনুকে আমাদের আশ্রমে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু… ”
–” ততদিনে তো এই অন্ত্যোদয় চালু হয়ে গেছে। বাসুদেবের কাছে শুনছিলাম। ”
–” ঠিকই বলেছে বাসুদেব। তখন এখনকার মতো পাকাবাড়ি হয়নি এ আশ্রমে, যখন মিনুকে আপনার দাদা এ আশ্রমে নিয়ে এলেন।
একদিন হঠাৎ বাসুদেব দৌড়ে আশ্রমে এসেই কান্না জুড়ে দিলো। কী ব্যাপার, না ওর দিদি যে বাড়িতে কাজ করতো তারা নাকি… ”
আমি নড়েচড়ে বসলাম। মনের ভেতর একটা গল্প জন্ম নিচ্ছে। মন কিছু একটা ধারণা করে নিতে চাইছে, আর প্রাণ উদগ্রীব হয়ে আছে বৌদির কাছ থেকে কাহিনীটা শোনার জন্য।
–” দাদা, যে কথাগুলো বলছি সেগুলো গল্পের মতোই শোনাবে। কিন্তু পঁচানব্বই থেকে আজ দুহাজার বাইশ, এই সাতাশ বছর ধরে যা দেখে আসছি, আমি যদি সত্যি আপনাদের মতো শিক্ষিত হতাম তাহলে হয়তোবা… ”
ভদ্রমহিলার কথায় আমি সত্যি লজ্জিত হচ্ছি। বিদ্যালয় শিক্ষায় শিক্ষিত এই অধম আজ হাঁ করে শুনে যাচ্ছি একজন গ্রাম্য বঁধুর এমন কিছু অভিজ্ঞতা, যে অভিজ্ঞতার আলোর প্রাবল্যে তথাকথিত সভ্য, শিক্ষিত আমি আমার জীবনের পথ চলার অভিজ্ঞতার পথকে আলোকিত করে তুলতে আজ এখানে এসে বৌদির পাশে বসে আছি। শুনতে চাইছি বা জানতে চাইছি আমার এই দীর্ঘ পদাতিক জীবনের ঝোলায় যে চরিত্রদের এখনো হদিস করে উঠতে পারিনি।
— বাসুদেব তখন বোধহয় সেভেন কি এইটের ছাত্র। আশ্রমের স্কুলে আশেপাশের গ্রামগঞ্জ থেকে যে সমস্ত ছাত্ররা আশ্রমের স্কুলে পড়তে আসতো তাদেরই একজন।
— ” ও কাকীমাগো, ওরা আমার দিদিকে মেরে ফেলবে গো। তাড়াতাড়ি চলো নইলে… ”
চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আপনার দাদা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
–” কি হয়েছে রে বাসুদেব? কাকে মেরে ফেলবে? কারা মেরে ফেলবে? ”

ওর স্বামী মারা যাওয়ার পর মিনুদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়লো। তার ওপর একটা বছর দুয়েকের বাচ্চা ওর কোলে। মিনুর মাও যা হোক দুএক বাড়িতে কাজটাজ করে সংসারটাকে আর টানতে পারছিলেন না কিছুতেই। বাসুদেবও তখন একেবারেই ছোট। সেও যে কিছু একটু করে মায়ের পাশে দাঁড়াবে সেটাও হওয়ার নয়। এমন সময় পাশের পাড়া থেকে খবর এলো, একজন সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়িতে একজন সর্বক্ষণের কাজের মহিলার প্রয়োজন।
অন্ধকার আরও গাঢ় হচ্ছে। ঝিঁঝিঁর একটানা পাখা ঘষার শব্দ আর আশ্রমিক ছাত্রদের পড়ার শব্দে, বেশ যেন একটা আবহ তৈরী করেছে। বৌদি পরের কথাগুলোকে কীভাবে বলবেন, হয়তো মনের ভেতরে সেগুলোকে সাজিয়ে নিচ্ছেন।
আমি ইচ্ছে করেই চুপ করে আছি। মনে হচ্ছে যেন এই নিরবতা অসীম। সেই অসীমতার জঠরে বেড়ে উঠছে একটা অসম্ভব বেদনা ক্লিষ্ট গল্পের ভ্রুণ।

— দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো। আপনি মিনুকে দেখেছেন তো, কীরকম নিঃশব্দে এতো বিশাল রান্নাঘর সামলায় ওরা কজন সেটা যিনি না দেখবেন তিনি বুঝবেন না। কিন্তু কী শান্ত মেয়েটা। মুখগুঁজে সারাটাদিন কাজ করে চলেছে। সেরকম মেয়েকেও নাকি গরম খুন্তি দিয়ে ছেঁকা দিতে হয়!
— মানে?
আমি আঁৎকে উঠলাম।
— হ্যাঁ গো দাদা। আপনাদের দাদা গিয়ে দেখে সেই গৃহস্থ বাড়ির রান্নাঘরের মেঝেতে মিনু চিৎকার করে কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করছে। বাড়ির গিন্নী উনুনে খুন্তি গরম করে সেই খুন্তি দিয়ে পরেরপর মিনুর হাতে, পিঠে ছাঁকা দিয়ে গেছেন। কেন? কী অপরাধ করেছে সে? গিন্নীর ডাকে নাকি সাড়া দেয় নি। ভাবুন দেখি দাদা?
আমার চোখের সামনে আমি যেন ছবিটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আর শিউরে শিউরে উঠছি।
— আপনার দাদা, সারা পাড়ার লোককে সাক্ষী রেখে মিনু আর ওর দুবছরের ছেলেকে এনে এই আশ্রমে তুললেন।

আমি অন্ধকারের ভেতরেও যেন ভদ্রমহিলার দুচোখের কোণে দুফোঁটা মুক্তোর বিন্দু দেখতে পেলাম।

জিন্দেগী কে সফর মে গুজর যাতে হ্যায় মকা, ওহ ফির নেহি আতে, ও ফির নেহি আতে…

ঠিক সেই মুহূর্তেই দুজন কিশোরী পুকুরের ঘাটে এসে বসলো।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।