সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ২২)

বাউল রাজা

তৃতীয় খণ্ড (দ্বাবিংশ পর্ব)

আমি অবাক হয়ে বাউলনির দিকে তাকিয়ে আছি। বাউলনির কনুই আমার কাঁধে, আর শালুকলতার মতো হাতটা আলতো করে ঝুলে আছে আমার বুকের ওপর। সে চোখ, সে চাউনি আমি ওর চোখে কোনোদিনও দেখিনি। মনে হলো যামিনি রায়ের আঁকা চিত্রপটের মতো ওর চোখ কানের পরিধি ছাড়িয়ে অন্ধকারে গিয়ে মিশেছে। আর কী মোহময় সে দৃষ্টি! তাহলে কী ভামিনির মন থেকে এখনও রাধাভাব চলে যায়নি?
এতোক্ষণ ধরে বকবক করে যাওয়া নদী এখন একদম নিস্তব্ধ। এমনকি যে নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জলের স্রোতের রুনুঝুনু শব্দ বুকে নিয়ে নদী সারাদিন ধরে বয়ে যায় সে শব্দটুকুতেও বুঝি মানা করেছে কেউ। সে মূহুর্তের কোনো রঙ নেই কিন্তু রূপ আছে, গন্ধ নেই কিন্তু বাস আছে, মূর্ততা নেই কিন্তু অবয়ব আছে।
কেউ একদিন, ঠিক কে সেটা মনে নেই, তৈত্তিরীয় উপনিষদ নিয়ে আলোচনাকালে বলেছিলেন — তুমি আসলে কোনো একক তুমি নও, বহুর সমষ্টি এক অখণ্ড তুমি। তোমাকে যদি তুমি একটি কেলাস হিসেবে বিবেচনা করো, তাহলে সেটির রূপ হবে অনেকটা প্রিজমের মতো। যার ওপর একটিমাত্র রঙ এসে পড়লেই সেই রঙ ভেঙে যাবে, দেখা যাবে সেই রঙটা আসলে একটিমাত্র রঙ নয় বরং বেশ কিছু রঙের সমষ্টি। সাধারণ ভাবে এই বহুর রূপ সাধারণের আয়ত্বাধীন নয়, কোন মূহুর্তে যে এই সমষ্টিগত রূপ মনের আয়নায় পড়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপের বিভিন্নতায় ধরা দেবে সেটার উত্তর জানেন একমাত্র পরমব্রহ্ম।

সেদিন আমি বুঝিনি কিছু, কিন্তু এই বাউলনি বুঝি আজ আমাকে সেই তৈত্তিরীয় উপনিষদের তত্ত্বকথা বোঝানোর জন্যই এখানে এসে আমার কাঁধে হাত দিয়ে এসে বসেছে।

— ঠাকুর —
আমি নিরুত্তর।
— এটা দরো দিকি
এ কথা বলে কৃষ্ণভামা আমার হাতে একটা আয়না ধরে দিলো। সে আয়নায় ভেসে উঠেছে আমাদের দুজনের ছায়া। আমার মুখের দিকে যেন কোনো অপরূপা মুগ্ধনয়ন নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি আয়নাটা ধরলাম। কিন্তু তখন আমার একবারের জন্যও মনে হলো না যে যাদুকরী এ আয়নাটা সে পেলো কোথায়!
—- একেনে রাকো দেকি আয়নাটাকে।
বলে সে মাটির সিঁড়ির বুকে একটা জায়গা দেখিয়ে দিলে।
— সত্যি করে বলো দেকি, কী দেকতেচো? আকাশ, তারাভরা আকাশ যেন একটা থালার মতো ঝলমল করচে। কী গো? সেটাই তো?
আমি মাথা নাড়ি। সত্যিই সে আয়নায় তখন আর আমাদের ছবি নেই, রয়েছে এক নক্ষত্রখচিত আকাশের ছবি।
— এবারে এটারে ভাঙো দেকি
বলে আমার হাতটাকে নিয়ে সে মুঠো বানিয়ে, সেই মুঠোটাকে আপন মুঠোয় বন্দী করে এক ঘা মেরে ভেঙে চৌচির করে দিলো আয়নাটাকে।

ক্রমশ…

Spread the love

You may also like...

error: Content is protected !!