|| পঁচাত্তরে পা, সাবালক হলো না? || T3 বিশেষ সংখ্যায় প্রদীপ গুপ্ত

পঁচাত্তর
বিকেলবেলা বেশ জোর বৃষ্টি হয়ে গেছে। স্কুলটার পেছনের মজে যাওয়া পুকুরটা বুঝি খানিকটা গর্ভবতী হলো। প্রত্যেকদিনের অভ্যাস মতোই অংকের মাষ্টার নুরুল সাহেব ক্লাস এইটের অংকর হোমওয়ার্কের খাতাগুলো সেরে রাখছিলেন। আগে বাড়িতেই নিয়ে যেতেন খাতাগুলো কিন্তু বৃষ্টিবাদলার দিনে আর বাড়ি বয়ে নিয়ে যান না তিনি, স্কুল ছুটির পর টিচার্স রুমে বসেই দেখে নেন খাতাগুলো।
সব খাতা দেখা শেষ হলে সেগুলোকে আলমারিতে তুলে রাখতে গিয়ে চমকে দাঁড়িয়ে পড়েন নুরুল হুদা।স্কুলের বাংলা শিক্ষিকা মল্লিকাদি লম্বা টেবিলের এককোণে মাথা গুঁজে বসে আছেন। কি ব্যাপার? ওঁর কি শরীরটরির খারাপ করলো?
আগামীকাল ভারতের পঁচাত্তর। সারাটা স্কুল জুড়ে রঙিন কাগজের তিনকোণা পতাকা দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে, ফ্ল্যাগ পোলটার সারাটা শরীর মুড়ে দেওয়া হয়েছে কাগজের তিরঙ্গায়। স্কুলের দেওয়াল জুড়ে স্বাধীনতা যোদ্ধাদের ছবি আটকে দেওয়া হয়েছে। এসবকিছু মল্লিকাদির তত্ত্বাবধানেই করা হয়েছে। এসব করতে গিয়ে কি তাহলে?
নুরুল সাহেব এগিয়ে যান দিদিমণির দিকে।
–” আপনার শরীর ঠিক আছে তো দিদিমণি? ”
মল্লিকা মুখ তুলে তাকালেন নুরুল সাহেবের দিকে। চোখমুখ টকটকে লাল হয়ে রয়েছে।
–” জ্বর আসেনি তো মল্লিকাদি? আপনি সুস্থ আছেন তো? ”
মল্লিকাদির দুচোখ দিয়ে ধারা বইলো।
–” আজ ওই রাজুটা –”
কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। একসাথে অনেক কথা বলতে চাইছেন, কিন্তু মুখ থেকে একটা শব্দও বের হচ্ছে না।
–” কোন রাজু! ক্লাস সিক্সের? কী হয়েছে রাজুর? ”
— ” মাষ্টারমশাই ছেলেটা যখন ক্লাশ ফাইভে এসে ভর্তি হলো, একটা কথাও ঠিকমতো বলতে পারতো না ও। সেই ছেলেকে বিশেষভাবে নজরে রেখে রেখে… আজ আমার সামনে ও… ”
নুরুল সাহেব মুখে কিছু বললেন না, কিন্তু ওর দুচোখে প্রশ্ন জেগে উঠলো।
–” এতো বাজে শব্দ যে ও উচ্চারণ করতে পারে, বিশ্বাস করুন আমি… আমি তো… মানে বিশ্বাস করুন আমি এখনও… ”
–” কী বাজে শব্দ বলেছে ও? ”
–” সে আপনাকে আমি কিছুতেই বলতে পারবো না স্যার, মানে উচ্চারণ করতে পারবো না। এতোটাই অশ্লীল।”
হলঘরে এক অখন্ড নীরবতা। নুরুল হুদার বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
—” কিচ্ছু করার নেই দিদিমণি, একদম কিচ্ছুটি করার নেই। শুধু রাজু কেন ওরা সবাই, সব্বাই, কেউ কারো থেকে এ বিষয়ে ভালো না। আমি তো আগে খুব বকাবকি করতাম ওদের, কখনও কখনও মারও দিতাম, কিন্তু আজকাল আর দিই না। ক্লাশ টেনের শান্তনুকে খুব বকেছিলাম একদিন। বাড়ি ফেরার পথে সন্ধ্যাবেলা কালভার্টের কাছে দেখি তিনচারজন ষণ্ডা মার্কা ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ছেলেগুলোকে কি বললো জানেন? বললো — মালটাকে দেখে রাখ। আমি বলামাত্রই কিন্তু…
কী বলবো কি আপনাকে, খুব ভয় পেয়েছিলাম জানেন, খুব ভয় পেয়েছি। তারপর থেকে আর কোনোদিনও… আমারও তো সংসার আছে বলুন? ”
কথাকটা বলেই ভদ্রলোক মাথা নীচু করলেন।
–” সবকটা বাচ্চাকে ধরে ধরে কাউন্সেলিং করানো দরকার। ”
–” কীহবে? বাড়িতে ফিরেই ফের টিভি, সিরিয়াল, বাবা মায়ের মোবাইল থেকে গেম আরও কতো কীই যে… সমাজটার কাউন্সেলিং করানো দরকার, বুঝলেন দিদিমণি কাউন্সেলিং এখন গোটা সমাজটার করানো দরকার। গোটা সমাজটার। ”
— ” কোনোদিকে দেশটার কোনোরকম উন্নতি নেই মাষ্টারমশাই। দিনেদিনে পুরো সমাজটাতে… দেশটাতে
ক্যান্সার ধরেছে মাষ্টারমশাই। সর্বাঙ্গে পচন ধরেছে। কাউন্সেলিং করাতে হলে তো সারা দেশটার করানো প্রয়োজন। আজ আপনি ছাত্রদের করাবেন ফের কালকেই তো আবার পচনের প্রভাব পড়বে ওদের ওপর ! ”
–” আপনি কি আপনার খাওয়ার থালাটা রোজ মেজে রাখেন না ? রোজ মাজতে হয় কারণ ওটা রোজ নোংরা হয় বলে, তাই না? ”
–” তাহলে কি আমাদেরই কোনো ফাঁক থেকে যাচ্ছে স্যার? আমরাই কি তাহলে বাচ্চাদেরকে… ”
–” শুধু আমরা কেন? সর্বস্তরের শিক্ষকদের ভেতর একটা মানবতার ফাটল তৈরি হয়েছে দিদি। সমস্তরকম সুকুমারবৃত্তিগুলোকে, সবুজগুলোকে ধ্বংস করার এক মহান প্রতিযোগিতা চলছে দেশজুড়ে। ”
— ” সর্বস্তরের শিক্ষক? ”
— ” বাংলাভাষার শিক্ষক আপনি। আপনি নিশ্চয়ই অচিন্তকুমার সেনগুপ্তর ছন্নছাড়া কবিতাটা পড়েছেন তো নিশ্চয়ই… ”
— ” গলির মোড়ে একটা গাছ দাঁড়িয়ে / গাছ না গাছের প্রেতচ্ছায়া / রুষ্ট, রুক্ষ, রিক্ত জীর্ণ –”
— ” দিদিমণি আমি কবিতাটাকে মন থেকে শ্রদ্ধা করি। কবি যে কী বাস্তবের ছবি এঁকেছিলেন লেখাটায় — আমরা এক বিরাট নেই রাজ্যের / নৈরাজ্যের বাসিন্দা / আমাদের কেউ নেই, কিছু নেই…
সত্যি করে বলুন তো দিদিমণি, আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগের শিক্ষকদের যে মানবতাবোধ ছিলো, ছাত্রদের ওপর যে দরদ ছিলো, ভালোবাসা ছিলো, যে দায়িত্ববোধ ছিলো, আমাদের ভেতর তার এক শতাংশও আছে? তখনকার দিনের যে সামাজিক শিক্ষকেরা ছিলেন, যে রাজনৈতিক শিক্ষকেরা ছিলেন, যে সাংস্কৃতিক শিক্ষকেরা ছিলেন আজও তাদেরকে আমরা কি সত্যিই অনুভব করতে পারি? একইরকম প্রেরণা পাই তাদের থেকে? তাদেরকে একজন মহান দেশপ্রেমিক হিসেবে দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখাতে পারি ছাত্রদের কাছে? দেশের জন্য তাদের স্বার্থত্যাগের উদাহরণ আছে কিছু? কবি কী নিষ্ঠুর ছবিটাই না তুলে ধরেছেন, চারিদিকে এখন শুধুই ক্ষুধাহরণের সুধাক্ষরণের উদাহরণ নয়, তা সুধাহরণের ক্ষুধাভরণের উদাহরণ। শুধু নিজের দিকে ঝোল টানা। ”
হলঘরটার মধ্যে এক অখণ্ড নীরবতা নেমে এলো। একসাথে এতোগুলো কথা বলে নুরুলসাহেব চুপ করলেন। সন্ধ্যার আঁধার নেমেছে স্কুলবাড়িটার গেটের কাছে বকুল গাছের পাতায় পাতায়। পেছনদিককার পুকুরটার থেকে ভেসে আসছে শুধু ব্যাঙেদের জলসার ঐকতান আর একটানা ঝিল্লিরব।
–” চলুন বাড়ি যাই মাষ্টারমশাই। আগামীকাল স্বাধীন ভারতের পঁচাত্তর। ভোরভোর স্কুলে আসতে হবে। আজ তো আবার মধ্যরাতের উদযাপন। কতো যে বোমপটকা ফাটবে আজ রাতে। বাজীর ভেতরে আবার কতোরকমের কারসাজি থাকবে কে জানে? খুব সাবধানে থাকবেন নুরুলস্যার। খুব সাবধানে থাকবেন, আপনি তো আবার একজন সংখ্যালঘু মানুষ। কি জানি এই পঁচাত্তরের উদযাপনের খুশীতে কতো মানুষকে না আবার। ”
কথা বলতে বলতে ওরা দুজন স্কুলের গেট পেরিয়ে রাস্তায় পা রেখেছেন। এখান থেকে দুজনের বাড়ির রাস্তা দুদিকে বেঁকে গেছে। মাথা নীচু করে দুজন দুজনার থেকে বিদায় নেবেন ঠিক তক্ষুনি —
” কী ব্যাপার? আমাদের নীতিমালার জ্ঞান ঝেড়ে এই বয়েসে এখনও পিরিত মাড়ানো চলছে? শালা হারামী মাষ্টার! দাঁড়া তোদের পেছনে দিচ্ছি। বুড়ো বয়েসে প্রেম করা বের করছি। ”
দুজনের সামনে ক্লাশ টেনের শান্তনু এসে পথ আটকে দাঁড়ালো। সাথে চার পাঁচজন ষণ্ডামার্কা ছেলে, সবকটার মুখে ভুরভুর করছে ধেনো মদের গন্ধ।
মুহূর্তের মধ্যে কী জানি কি হয়ে গেলো, মল্লিকাদি তার শাড়ির আঁচল কোমড়ে বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শান্তনুর ওপর। চুলের মুঠি ধরে গর্জন করে উঠলেন —
” এখনও সবকিছু শেষ হয়ে যায় নি রে, সবকিছু, সবাই শেষ হয়নি এখনও, শেষপর্যন্ত আলোই জেতে অন্ধকারের কাছে। স্বাধীনতা মানে উচ্ছৃঙ্খলতা না, স্বাধীনতা মানে সুন্দর, সুস্থ আবর্জনাহীন এক সর্বাত্মক উন্মেষের মন্ত্র।
পেছনেই নুরুলসাহেব দুচোখ বন্ধ করে আবৃত্তি করছেন
—” প্রাণ আছে, এখনও প্রাণ আছে / প্রাণ থাকলেই মান আছে / আছে বেঁচে থাকার এক অনন্ত সম্ভাবনা।