“এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো” বিশেষ সংখ্যায় ঋতব্রত গুহ

শেষ রাতের রহস্য 

১। 
কি অবস্থা দেখ চারদিকে ! বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার , বৃষ্টি  সব মিলে একটা মেস ! “
গরম চা এ চুমুক দিতে দিতে বলল কাকুসোনা । 
আমি আর ব্রত মন ভরে তখন শ্বাস নিচ্ছি । ডুয়ারসে রোমাঞ্চই আলাদা । আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় এটা অন্য কোন পৃথিবী । যদিও ডুয়ারস আমাদের শহরের খুব কাছে কিন্তু এখানে আসার সময় হয় কোথায় ! আমি আর ব্রত ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছি সদ্য । আমাদের আপাতত হাতে কোন কাজ নেই । আমরা কাকুসোনাকে অনেক কষ্ট করে চারদিনের ছুটি নিতে রাজি করিয়েছি । কাকুসোনার যেহেতু ব্যবসায়িক কারণে এদিকটায় বেশ পরিচিতি রয়েছে তাই আমাদের বুকিং পেতে অসুবিধে হয় নি । আমরা সরকারি বাংলোয় বুকিং পেয়েছিলাম । কিন্তু বাধ সাধল ব্রত । যেহেতু সরকারি বাংলো সেহেতু  সেখানে লোকজনের বেশ ভিড় । ব্রতের মতে অরণ্যের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করবার জন্য একটু নিভৃত স্থান প্রয়োজন । একটা জায়গায় এত ভিড় থাকলে সেই শান্তি পাওয়া যাবে না । শেষমেশ ব্রতের চাপে আমরা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম । এই জায়গাটা অনেকটা ভেতরে । একটা ছোট ফরেস্ট বাংলো । আশেপাশে তেমন জনবসতি নেই । একটু দূরে কোথাও জনবস্তি রয়েছে ।  আজ সকালে বাংলোর সামনে দিয়ে লোকজন যেতে দেখেছি । যদিও বিকেল হলেই জায়গাটা একদম ফাকা হয়ে যায় । 
“কাকুসোনা এইটেই তো আনন্দ । এমন রোমাঞ্চ ই তো চেয়েছিলাম । কি থ্রিলিং বল তো ! “
এখানে লোক বলতে আমরা চার জন । আমি , ব্রত , কাকুসোনা আর শিবু । শিবু এই বাংলোর কেয়ার টেকার । বয়স আন্দাজে খুব চুপচাপ । একজন রাঁধুনে সারাদিন থাকে । বিকেল বেলা চলে যায় ।
“একটু গা ছমছম লাগছে ! কি বলিস ! ” কাকুসোনা কে দেখে বোঝা যাচ্ছে যে কাকুসোনা বেশ ভয় পাচ্ছে । এমন পরিবেশে সেটা অস্বাভাবিক না । ব্রত কাকুসোনার কথায় বিশেষ পাত্তা দিল না । খালি গলায় গান ধরল । বাইরে বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। ভেতরে আলো থাকলেও তার তীব্রতা বিশেষ নেই । আমার বেশ ভয় লাগছে । হঠাৎ উপরের তলায় মানুষের হাঁটার শব্দ । আমি আর কাকুসোনা একসাথে লাফিয়ে উঠলাম । 
“ডিনারের সময় হয়েছে । শিবু আসছে নিচে ! এতে ভয় পাওয়ার কি আছে ! “ ব্রতের কথা শুনে একটু  বল পেলাম । 
“কাকুসোনা তো ভূতে বিশ্বাস করে । তুই তো সেটা করতিস না । তবে এত ভয় পাচ্ছিস কেন ! “
আলো তে অনেক জিনিস অবিশ্বাস করে থাকা যায় কিন্তু অন্ধকারে সেটা যায় না । ব্রতকে আমি উত্তরটা দিতেই যাচ্ছিলাম ততক্ষণে শিবু নেমে এসেছে ।
“স্যার ডিনার সেরে নেবেন । চলুন । এখানে বেশিক্ষণ বসে থাকা ঠিক হবে না । “
প্রথম অংশ টুকু ঠিক ছিল । পরের অংশ টা একটু দ্বন্দ্বে ফেলে দিল । আমি প্রশ্ন করার আগেই কাকুসোনা প্রশ্নটি করল । 
“বেশিক্ষণ বসে থাকা ঠিক হবে না মানে ! “
শিবু কোন উত্তর দিল না । আমি ব্রতের দিকে তাকালাম । ব্রতের মধ্যে কোন হেলদোল নেই । চেয়ারে হেলান দিয়ে দিব্যি বসে আছে । 
“কোন ভয়ের কারণ আছে ! “
আমার প্রশ্নেরও শিবু কোন উত্তর দিল না । 
“আসুন ! খেয়ে নেবেন । ” শিবুর গলাটা কেমন যেন একটা । শীতল এবং গভীর । এই পরিবেশে ওর গলা শুনলে ভয়টা বহুগুণ বেড়ে যায় ।  
ব্রত হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরল । এগিয়ে গেল শিবুর দিকে । 
“এখানেই তো প্যাটিনসন সাহেব আত্মহত্যা করেছিলেন । ওপরের ঘরটিতে । তারপর থেকে যারা এখানে এসেছেন তারা অনেকেই এই বাংলোয় ওনার আত্মার উপস্থিতি টের পেয়েছে । তাই না ! “
ব্রতের কথা শুনে কাকুসোনা আবার বসে পড়লেন । আমারও  কেমন যেন শিহরিত লাগল । 
শিবু ব্রতের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল । 
“আপনি জানেন ! তাও এসেছেন । 
ব্রত হাসল । 
“কেন ভূত কি প্রতিদিন আসে না কি মাঝে মাঝে আসে ! “
কাকুসোনা খেপে গেল । 
“ভূত নিয়ে একদম ইয়ার্কি ঠাট্টা মারবি না । যখন এসে ঘাড় মটকে দেবে তখন বুঝতে পারবি ! “
ব্রত ভূতে বিশ্বাস করে না । আর আমার বিশ্বাস টা অনেকটা পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল । এই যেমন এখন প্রবল ভাবে বিশ্বাস টা ফিরে আসছে । 
শিবু র গলার স্বরটা যেন আরও শীতল হয়ে গেল । 
“অত হাল্কা ভাবে নেবেন না স্যার । একজন ভদ্রলোক বছর দুয়েক আগে এখানে এসেছিল । রাতে ওই ঘরটাতে ঢুকেছিল । পরের দিন ওই ঘর থেকে ওনার লাশ পাওয়া যায় ! আপনারা তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। বেশি রাত করা ঠিক হবে না ! “
২। 
পাশাপাশি দুটো খাট । একটিতে কাকুসোনা শুয়েছে । অন্যটিতে আমি আর ব্রত । 
“কালকে প্রবাল কে বলে আমরা অন্য জায়গায় শিফট হয়ে যাব । এখানে লোকে থাকে !  এই ব্রতটার জন্য আমাদের দুজনকেও মরতে হবে ! “
“ভূত বলে কিছু নেই । সবটাই একটা ইলিউশন । বুঝলে কাকুসোনা ! “
“তুমি একা সব কিছু বোঝ ! আমরা তো সব মূর্খ । ওখানে যে খুন টা হয়েছিল সেটাকে কি বলবি হতভাগা ! “
কাকুসোনা আর ব্রতের মধ্যে এমন যুক্তি প্রতিযুক্তির লড়াই সবসময় চলতেই থাকে । কিন্তু অন্যসময় আমি যেমন ওদের বাক্যুযুদ্ধ উপভোগ করি আজ তেমন করতে পারছি না । একটা অস্বস্তি কাজ করছে মনের মধ্যে । পাশের ঘরেই তো ….। এমন সময় কারেন্ট টা যেতে হল । 
“ধুর ! আর ভালো লাগছ না আমার । আবার কারেন্ট টাও গেল । হ্যাঁ রে বচা বেঁচে ফিরব তো ! ” কাকুসোনা আমাকে এ নামেই ডাকে । 
“চল বরং ঘুমিয়ে পরি । যত এসব নিয়ে ভাবব তত অশান্তি হবে । “
“সেই ভালো ! ” সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে কাকুসোনা শুয়ে পড়ল । ব্রত ও “ গুড নাইট ” বলে শুয়ে পড়ল । কিন্তু এমন সময়ে ঘুম আসা কি আর সহজ কথা । আমারও ব্রতের ওপর রাগ হচ্ছে । এখানে না এলেই ভালো হত । এসেছি রিল্যাক্স করতে । সেখানে এত ঘটনা আর ভালো লাগছে না । এই ঘন অরণ্যের মাঝে এমন অভিশপ্ত বাংলো তে শুয়ে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছে এর থেকে আমার রাত জাগা শহরটাই ভালো । অন্তত সেখানে এমন ভূতের ভয় তো নেই । আচ্ছা ভূত কি সত্যি আছে ! না কি সবটাই মনের ভুল । একবার আমাদের অঙ্কের স্যার বলেছিলেন ভূতে যদি না বিশ্বাস কর তবে ভূত তোমার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না । কিন্তু যদি ভূতে তুমি বিশ্বাস কর তবে ভূতের সাথে তোমার দেখা হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল । আর ভালো লাগছে না ভাবতে । ঘুম নেমে আসছে চোখে । 
“বচা ! বচা ! “
আমার ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল । আমি আতকে উঠলাম । বাইরে বৃষ্টি পড়ছে  মুষলধারে । 
“কি হল ! “
দেখি কাকুসোনা রীতিমত কাঁপছে । আমি ব্রতকে ডাকার জন্য পাশ ফিরলাম । দেখি ব্রত নেই । আমার শরীরটা কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেল । চোখ গেল দরজার দিকে । দরজাটা খোলা । 
“কি হচ্ছে এসব ! “
“ব্রত কে আমি বাইরে যেতে দেখেছি । তারপর একটা খুব জোরে আওয়াজ হল । ” কাকুসোনা কাঁপতে কাঁপতে বলল । 
আমি লাফিয়ে বাইরে গেলাম । মোবাইল টর্চ টা জ্বালালাম । কাকুসোনা আমার পেছন পেছন এল । আমি জোরে জোরে ডাকলাম “ ব্রত ! ব্রত ! ” কোন উত্তর এল না । পাশের ঘরটাও বাইরে থেকে বন্ধ । তার মানে ব্রত সে ঘরে যায় নি । 
এই অন্ধকারে আমাদের পক্ষে ব্রতকে খুঁজে বার করা মুশকিল । আমার মনে হল শিবুর সাহায্য না নেওয়া ছাড়া উপায়ন্তর নেই । 
“শিবু ! শিবু !  ” কাকুসোনা জোরে জোরে ওর ঘরের দরজা ধাক্কাতে শুরু করল । কিছু মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে এল শিবু ! 
“কি হল স্যার ! “
“ব্রতকে পাওয়া যাচ্ছে না ! “
“সে কি ! উনি কি ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন ! “
“হ্যাঁ ! “
শিবু যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল । 
“শিবু ! কি ভাবছ ! “
“কিছু মনে করবেন না স্যার । আপনারা যারা শহর থেকে আসেন তারা কিন্তু এভাবে নিজেদেরই বিপদ বাড়িয়ে তোলেন । কি দরকার ছিল বাইরে যাওয়ার ! আগের স্যার কিন্তু এভাবেই মারা গিয়েছিলেন ! “
গলাটা কেমন শুকিয়ে এল আমার । ব্রতের কোন বিপদ হল না তো ! 
আমরা তিনজনে মিলে ব্রতকে খোঁজা শুরু করলাম । শিবুর কাছে ইমারজেন্সি লাইট ছিল  । অতএব একটু সুবিধে হল । অনেকক্ষণ ধরে খুঁজেও ব্রতকে পেলাম না । আমি ততক্ষণে মনস্থ করে ফেলেছি যে পুলিশকে খবর দেব  । শিবু আর কাকুসোনা ওপরে খুঁজছে । আর আমি খুঁজছি নিচে । ব্রতের চিন্তায় আপাতত ভয় বলে কোন বস্তু আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই । হঠাৎ বাংলোর পেছনের দিকটায় আমি একটা হোঁচট খেলাম । লাইট টা সামনে নিয়ে গিয়ে দেখলাম এক জোড়া পা । বাকি শরীরটা কাঠের পাটাতনের নিচে । নিচু হয়ে দেখলাম ব্রতের শরীরটা পড়ে রয়েছে । 
“ভাগ্যিস অজ্ঞান হয়েছিল । নইলে তো কেলেঙ্কারি হয়ে যেত । “
ব্রতের সবে জ্ঞান ফিরেছে । এখনও ধাতস্থ হতে পারেনি বেচারা । কেমন শিশুর মত চারদিকটা দেখছে। 
“কেমন লাগছে এখন ! “
“ভালো ! “
আমরা আরও কিছু সময় ব্রতকে দিলাম । অনেক প্রশ্ন জমে রয়েছে মনের মধ্যে । শিবু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে । ওর মনেও নিশ্চয় অনেক প্রশ্ন ।  
“আমি বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম । পাশের ঘরটা থেকে অদ্ভুত কিছু আওয়াজ শুনি । ঘরটার দিকে এগিয়ে যাই । আর কিছু মনে নেই আমার ! ” ব্রত শান্তভাবে বলল । 
“স্যার ওই ঘরটার থেকে আওয়াজ শুনে ওখানে যাওয়াটাই ভুল হয়েছে । ওই ঘরটা থেকে অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায় রাতে । আমি ডিপার্টমেন্ট এর লোকজন কে বলেছি সে কথা । ওরা এসব পাত্তা দেয় না । এই বাংলোটাকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত । অবশ্য সবাই জানে এই সব কথা । তাই এখানে কেউ সচরাচর বুকিং করে না । আপনারা যে এত জায়গা থাকতে এখানে কেন বুকিং করলেন সেটা বুঝতে পারলাম না । !”
ব্রত যেন কোন গভীর চিন্তায় মগ্ন । কাকুসোনা কে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব ক্লান্ত । আর আমি সময় গুনছি কখন আলোর দেখা পাব ! 
৩। 
রাতের বেলায় চারপাশটা যেমন দমবন্ধ লাগছিল সকাল বেলাটা সে তুলনায় অনেক মনোরম । অনেক স্নিগ্ধ । সারারাত বৃষ্টি হয়েছে । চারদিকে ঘন সবুজ । 
“তবে আজ আমরা শিফট করছি তাই তো ! “
কাকুসোনা গরম চা এ চুমুক দিয়ে বলল । 
ব্রতের মুখ দেখে মনে হল ওর আদৌ ইচ্ছে নেই । অথচ ব্রতেরই তো সব থেকে বেশি ভয় পাওয়া উচিত । 
ব্রত মৃদু  হাসল । 
“আজকের দিনটা থাকি । আশপাশটা একটু ঘোরাঘুরি করি । কাল বরং শিফট করি । “
“এখানে যা কিছু ঘটছে । এখানে এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না আমার ! ” আমি বললাম । 
“হ্যাঁ আর ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি ব্রত । চল আজই শিফট করে নিই ! “
কাকুসোনার অনুরোধেও কোন ভাবান্তর ঘটল না ব্রতের মধ্যে । ব্রত যেন একটা কিছু ভাবছে । 
“আমি কাল ওই ঘর থেকে যে আওয়াজ টা শুনেছি সেটা মোটেই ভূত সদৃশ নয় । কিছু একটা রয়েছে এর মধ্যে । একবার ঘরটা দেখলে ভালো হত ! “
“তুই আর বাড়াবাড়ি করিস না । শিবু তো বলেছেই ওই ঘরটা খোলা হয় না । আমাদের এত সমস্যায় মধ্যে নিজেদের জড়িয়ে কি লাভ বল তো ! তার থেকে ঘুরতে এসেছি ! ভালো করে সে কাজটা করি । এখানে কি রহস্য রয়েছে , কি ঘটছে এসবের মধ্যে ঢুকে কি লাভ বল তো ! ” কাকুসোনার কথায় আমারও পুরোপুরি সমর্থন আছে কিন্তু ব্রত নাছোড়বান্দা । ও আজকের দিনটা এখানেই থাকবে। 
ব্রত সারাদিন বের হল না । নিজেকে ঘরবন্দি রাখল । আমি আর কাকুসোনা বেরোলাম । যদিও আমাদের ব্রতকে একা রেখে বেরোনর ইচ্ছে ছিল না কিন্তু ব্রত একপ্রকার জোর করেই আমাদেরকে বের করল । ডিপার্টমেন্টের গাড়ি ছিল সাথে । আশপাশটা ঘুরে দেখলাম । এমন সবুজের প্রেমে বারবার পড়তে ইচ্ছে করে । নানা রকম পাখি , কত ধরনের গাছ  ! কোথাও কোন ট্রাফিক নেই  , অশান্তি নেই । যেন সর্বত্র একটা পরম শান্তি বিরাজ করছে । হালকা বৃষ্টি হচ্ছে আজকেও । ঘণ্টা তিনেক ঘুরে ফিরে গেলাম আমরা । দেখি  ব্রত বারান্দায় বসে একটা বই পড়ছে । 
“কি ঠিক আছিস তো ! “
ব্রত মুচকি হাসল । 
“আছি আপাতত । “
যাওয়ার আগে দেখেছিলাম ব্রত কিছুগভীর চিন্তায় মগ্ন ।  এখন অবশ্য সে সব নেই । ওকে বরাবরের মোট ফুরফুরে লাগছে। 
সারাটা দিন বেশ ভালোই কাটল । যে ছেলেটি এখানে রান্না করে তার রান্না অতুলনীয় । অনেকদিন বাদে এত তৃপ্তি করে খেলাম । আমরা রাত দশটার মধ্যেই খাওয়া দাওয়ার পর্ব মিটিয়ে শুয়ে পড়লাম । বাইরে জোর বৃষ্টি চলছে । ঘুমটা তাড়াতাড়ি এসে গেল । 
৪। 
“বচা ! বচা ! “
ব্রতের গলা । 
“এখন ডাকছিস কেন ! কটা বাজে ! “
“দুটো ! চল । “
আমি অবাক হলাম । 
“কোথায় যাব ! “
“অভিযান ! ” কাকুসোনা দেখি আগেই উঠে ফিটফাট হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে । 
“মানে ! “
“এতদিন ধরে যে ব্যবসা চলছে সেটা বন্ধ করবার সময় এসেছে ভাই ! সময় নষ্ট করিস না । “
আমরা তিনজনে ঘর থেকে বেরলাম । আজকেও এখানে কারেন্ট নেই । চারদিক অন্ধকার। দরজা টাকে ব্রত সাবধানে চাপিয়ে রাখল । আমাদের ঘর থেকে এগিয়ে গেলেই একটা কাঠের বারান্দা। তারপরই সেই অভিশপ্ত ঘর। আমরা পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলাম । ঘরটার বাঁদিকে একটা ছোট স্পেস আছে । আমরা সেখানেই মাথা গুঁজে কোনভাবে নিজেদের আড়াল করলাম । সামনের থেকে কেউ এলে আমাদের দেখতে পাওয়ার কথা নয় । 
“আমরা এসব কি করছি! ” আমি কিছুই জানি না কি ঘটছে । কাকুসোনাকে দেখে মনে হচ্ছে কাকুসোনা সবটা জানে । নইলে কাকুসোনা যে রকম ভীতু তাতে কাকুসোনা এত রাতে এই অন্ধকারে এমন রহস্য উন্মোচনে এসেছে সেটা একপ্রকার অসম্ভব । 
“একটু সবুর কর । আর কথা বলিস না ! ” নিচু স্বরে বলল কাকুসোনা । 
আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে । আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে । কাউকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না । এত নিকষ অন্ধকারে কোন রহস্যের সমাধান হবে কে জানে । হঠাৎ দেখলাম একটা আলো ক্রমশ উপড়ে উঠে আসছে । বাইরে প্রবল বৃষ্টি পড়ছে । আমরা আরও ভেতরের দিকে ঢুকে গেলাম । প্রথমে ব্রত , তারপর কাকুসোনা এবং সবশেষে আমি । আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না । মিনিট খানেক বাদে পাশের ঘরের দরজাটা খোলার শব্দ পেলাম । চাপা স্বরে কারা যেন কথা বলছে । 
“কবে যাবে মালগুলো ! ” একজন প্রশ্ন করল । 
“ভেবেছিলাম তো আজকেই যাবে । তবে কাল বোধহয় চলে যাবে । তোমরা দুদিন অপেক্ষা করতে পারলে না ! “
এই গলাটা আমি চিনি । শিবুর গলা । আমার শরীরটা কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে এল । 
“ধুর কালকেই ডেলিভারি দিতে হবে । তবে মালটাকে কাল যা করেছি তাতে মনে হয় আজ আর কেউ বের হবে না । আর যদি বের হয় ওদের ভূত ঠিক মেরে ফেলবে । আজ কোন ওয়ার্নিং নয় । সোজা খালাস করে দেব । “
আমরা তিনজনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম । ওরা মিনিট দশেক কাজ করার পর দরজাটা বন্ধ করে দিল । ওরা বারান্দা ধরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল । যাওয়ার সময় শিবু আমাদের ঘরের দরজাটা খুলল । 
“ ঘরে নেই ওরা ! ” শিবু চিৎকার করে উঠল । 
“খোঁজ । আজ সবগুলোকে মেরে ফেলব ! “
আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম “ কি হবে এবার ! ” এই প্রবল বর্ষায় চিৎকার করলেও তো কেউ শুনবে না । পালাবোই বা কোথায় ! “
কাকুসোনা ও ঘাবড়ে গিয়েছে । 
“ওই ছাগল ! কোথায় ওরা ! “
“আমাদের পালাতে হবে । পেছনে একটা সিঁড়ি আছে । ” ব্রত শান্তভাবে উত্তর দিল । 
আমরা ধীরে ধীরে পেছনের সিঁড়ির দিকে এগোলাম  । বৃষ্টি পড়ছে । তাই রক্ষা । নইলে পায়ের আওয়াজে ঠিক জায়গাটা ওরা ট্রেস করে নিত । পেছনের সিঁড়িটা ব্যবহার হয় না বোধহয় । খুব সরু আর ভগ্নপ্রায় । আমরা নামতে থাকলাম । হঠাৎ ওপর থেকে কে একজন আওয়াজ করে উঠল  “ ওই যে ওরা । নিচে নামছে !” আমরা প্রাণপণে দৌড় লাগালাম । হঠাৎ জিপের শব্দ শুনলাম  । হেডলাইট এসে পড়ল বাংলোর ওপর । বাংলোর ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে ত্রিমূর্তি । আরেকটু এগিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে আমরা নিজেদের আড়াল করে রেখেছি । গাড়ি থেকে নেমে এল কজন পুলিশ । ওরা পালানোর চেষ্টা করল কিন্তু শেষরক্ষা হল না । 
৫। 
আজকের সকালটা খুব ভালো লাগছে । আর কোন ভূতের ভয় নেই । কোন রহস্য অবশিষ্ট নেই । লোকাল থানার ইনচার্জ এসেছেন আমাদের ধন্যবাদ জানাতে । অবশ্য সব কৃতিত্ব ব্রতের । 
“আচ্ছা তোমার সন্দেহ টা হল কোথা থেকে ! ” অফিসার প্রশ্ন করলেন । 
ব্রত হাসল । 
“আমার মনে হয় ভূত বলে কিছু নেই । সবকিছুর পেছনেই একটা যুক্তি থাকে । প্রথম রাতে যখন আওয়াজ টা শুনি তখন কেমন একটা সন্দেহ হয় । কোন কারণ ছাড়া কেউ ভয় দেখাবে কেন । আমি ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই । ঠিক সেই সময়ই আমি অজ্ঞান হয়ে যাই । বোধহয় কোন স্ট্রং চেতনা নাশক ব্যবহার করা হয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল ঘরটা খুলে একবার দেখা উচিত । হঠাৎ আমার মনে হল শিবু বিষয়টাকে আড়াল করছে কেন ! পুরোটাই কি ভয় ! আমি ইলেক্ট্রিসিটি ডিপার্টমেন্ট এ ফোন করে শুনলাম এখানে সেদিন  রাতে কোন পাওয়ার কাট হয় নি ! অতএব কারেন্ট যাওয়ার বিষয়টি পুরোটাই ম্যান মেড।  সকালে সবার অলক্ষ্যে শিবুর ঘর  এ গিয়ে আমি ঐ ঘরের চাবিটা খুঁজি । খুঁজে পেতে বিশেষ দেরি হয় নি । ও হয়ত ভাবেনি কেউ ওর ঘর থেকে এভাবে চাবিটা  চুরি করবে ! ঘরের চাবিটার একটা কপি করে নিই । তারপর সেটা শহর থেকে বানিয়ে নিয়ে আসি । এই ব্যাপারে আমাকে বিশেষ সহযোগিতা করেছে কাকুসোনা । “
“ কখন গিয়েছিলিস তুই !” আমি প্রশ্ন করলাম । 
“ তোরা যখন ঘুরছিলিস তখন । সকালেই ফোন করে দেওয়া হয়েছিল ।”
“ আমায় জানালি না কেন এসব কিছু ! “
ব্রত হাসল 
“ একজন অন্তত থাকা উচিত ছিল যে কিছু জানে না । তবে সব কিছু প্ল্যানমাফিক চলছে কি না বোঝা যায় । এখানে কাকুসোনার পরিচিতি রয়েছে । তাই কাকুসোনা কে জানাতেই হত ! ” ব্রত বলে চলল। 
“শিবু দুপুরের সময়টা থাকে না । সেই সময়ই আমি ঘরের দরজাটা খুলি । দেখি তাকে তাকে সাজানো রয়েছে সাপের বিষ , তক্ষকের বিষ । এগুলো কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হয় বাইরে । ব্যস চিত্রটা পরিষ্কার হয়ে যায় । কিছু ছবি তুলে থানায় খবর দিই ! “
ব্রত থামল । অফিসার ব্রতের পিঠ চাপড়ে দিল । 
কিছুক্ষণ বাদে আমরা বেরিয়ে পড়লাম জয়ন্তীর পথে । রহস্যকে পেছনে রেখে । 
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।