অথ শ্রী উপন্যাস কথা-তে প্রদীপ গুপ্ত – ধারাবাহিক – অষ্টম পর্ব

পশমিনা

কাশ্মীর উপত্যকার দৈনন্দিন সমস্যা, রাজনৈতিক ঘাতপ্রতিঘাত ও প্রেমের এক অনুভূতিশীল জীবনালেখ্য।

— তুমি জেএনইউ তে পড়তে তাহলে তো নিশ্চয়ই অনেক বাঙালী সহপাঠীদেরকেও বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলে।
— হ্যাঁ, বহত। লেকিন…
— লেকিন? ওরা কি কেউ তোমার সাথে!
— আরে নেহি নেহি বাবুজি, আপকি হাওড়াবালে এক চ্যাটার্জী তো হমারা রুম মেট থা কিসিদিন কে লিয়ে। বহত প্রোগ্রেসিভ মাইণ্ডকে থা উও বান্দা।
— তাই?
আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম।
— হ্যাঁ জ্বী, বো বান্দেনে ধরম উরম কুছ নহি মানতে থে। লেকিন ম্যায়নে এক মুসলমান হু
— তো?
— আমারই থোরাবহত অসুবিধা হতো বাবুজি। হমারা এক বুজুর্গ লোগ বলেছিলেন যো অপনা ধরম নহি মনতি বো কারও ধর্মই মানে না বাবুজি।
আমি চুপ করে রইলাম। আমিও যে তাহলে সেই চ্যাটার্জীরই গোত্রীয়। কাশ্মিরীদের চরিত্রের একটা দিক খুঁজে পেলাম।
— তোমরা কাশ্মিরীরা খুব ধর্ম মানো তাইনা?
— জ্বী হ্যাঁ বাবুজি। ধর্ম মানা বা ধার্মিক হওয়া কোই গুণা নেহি। যিনি নিজের ধর্ম মানেন তিনি অন্যের ধর্মকেও ইজ্জত করেন বাবুজি। য্যায়সে আপ মান লিজিয়ে কি আপনি আপনার স্ত্রীকে ভালোবাসেন মানে অন্যের স্ত্রীকেও ইজ্জত দেন। তাই না বাবুজি?আমি কি ভুল বললাম?

ধর্মাধর্ম নিয়ে অনেক আলোচনা আমরা শুনেছি, কিন্তু এরকম উদাহরণ সম্ভবত আগে কখনও শুনিনি।
— না না, একদম ঠিক বলেছো। যিনি নিজেকে সম্মান করেন, তিনি অন্যকেও সম্মান করেন। যিনি নিজের ধর্মকে পালন করতে গিয়ে অন্যের ধর্মকে আঘাত করেন তিনি আদৌ ধার্মিক নন। তবে যিনি প্রকৃত অর্থে প্রগতিশীল তিনি সবার ধর্মকেই সমান সম্মান করেন। কিন্তু তুমি যে বললে তোমার বন্ধু খুব প্রোগ্রেসিভ মাইণ্ডেড ছিলো?
— হ্যাঁ, জরুর ছিলো বাবুজি। চ্যাটার্জী আমাকে আমার ধর্মকে নিয়ে কোনোদিনও বেইজ্জতদার বাত বলেনি, বরং ও আমায় ইফতার খিলায়া বাবুজি। হমারা পরব কে দিন মুঝকো খিলায়া ভি।
— তবে? তবে অসুবিধা কোথায় ছিলো!
— বো তো হমারা ঔর সে থা। একচুয়ালি হম মুসলিম লোগ — মাইনরিটি পার্সনস, অপনা ইজ্জত, অপনা ধরমকো রাখনে কে লিয়ে থোরাবহত কনজারভেটিভ বন যাতে হ্যে।

— কাশ্মীরে তো তোমরা মাইনরিটি নও, কাশ্মীরে তো তোমরাই মেজরিটি সেকশন অফ পিপল। তাহলে তোমরা কনজারভেটিভ হবে কেন?
— বাবুজি, ইয়ে স্রিফ দোমিনট টাইমমে বোলনেওয়ালা ম্যাটার নহি হে। এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে বহত টাইম বিত যায়েগা। ঔর হমারা ইয়ে সব ডিসকাস করনেসে ভি থোরা প্রবলেম হ্যায় বাবুজি। আপ পরদেশি আদমি, লাগতা হ্যায় ইজ্জতদার ভি, এছাড়াও আপনি আমার ঈশ্বর টেগোরের রাজ্যের লোক আছেন, থোরা টাইম আরাম কিজিয়ে, কশ্মির এক ভুলভুলাইয়াকা নাম হ্যায় বাবুজি। ইতনা খুবসুরতিকে নীচে ইতনা বদসুরত আপনি কোথাও দেখতে পাবেন না বাবুজি।
কথাগুলো বলে ছেলেটি কিছুক্ষণ মাটির দিকে মুখ করে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বসলো।
একটি দীর্ঘদেহী পাঠান যুবক ধীরেধীরে পাইন বনের অন্ধকারের দিকে হেঁটে চলে যাচ্ছে। আমার সামনে বয়ে চলা লিডারের বুকে ভেসে চলা বরফকুঁচিগুলো আমায় যেন ডেকে ডেকে বলছে — ইতনা খুবসুরতি কে নীচে ইতনা বদসুরত — ইতনা খুবসুরতি কে নীচে ইতনা বদসুরত —

ছেলেটিকে এখন আর দেখা যাচ্ছেনা। ভুলে ওর নামটাই জিজ্ঞাসা করা হয়নি। নাম যাই হোক, কিন্তু একজন জেএনইউতে পড়া যুবক কাশ্মীরের বিষয়ে অল্পসময়ে অল্পকথায় আমাকে একটা তালা বন্ধ বাক্সকে উপহার দিয়ে গেলো।

( চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *