সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ৩০)

পদচিহ্ন

মানবপ্রেমের মিলনতীর্থ অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রমের শিকড় ততদিনে সমাজের বুকে বেশ ভালোই ছড়িয়েছে। তখন প্রায় ষাটজন আশ্রমিক আশ্রমের নবনির্মিত বাড়িতে নিজেদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে। বলরাম করণের স্বর্গত পিতা খগেন্দ্রনাথ করণের নামাঙ্কিত অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়েও ছাত্রছাত্রী সংখ্যা আশীরও বেশী। স্কুলে আটজন শিক্ষয়িত্রীর ভরণপোষণ হয় আশ্রমের ভিক্ষান্নে। হাওড়ার এক যুবক, বুদ্ধদেব জানা, এসে যোগ দিলো বলরামবাবুর আশ্রয়ে। বুদ্ধদেবের দুই মেয়ে, একজন বছর আষ্টেকের তো ছোটটার বয়স মেরেকেটে দুই। আদতে মেদিনীপুরের ছেলে বুদ্ধদেবের বাবা হাওড়ায় চাকরি করার সুবাদে বুদ্ধদেবের বড়ো হয়ে ওঠা হাওড়ায়। অজস্র টিউশনের জনপ্রিয় শিক্ষক বুদ্ধদেব বিয়ে করেছিলেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক কন্যাকে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সেই মহিলা বুদ্ধদেবের সঙ্গ ত্যাগ করে দুই মেয়ে, সংসার, বাড়ি ফেলে পালিয়ে যায়।
বুদ্ধদেবের হার না মানা লড়াকু চরিত্র দুই মেয়েকে নিয়ে এসে আশ্রয় নেয় বলরামবাবুর আশ্রমে। সামান্য পারিতোষিক ও ভরণপোষণের বিনিময়ে বুদ্ধদেব আশ্রমের একজন দাদা হিসেব নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। পরবর্তীতে সারা আশ্রমের শিশুকিশোরদের কাছে মাষ্টারমশাই হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি তৈরী করতে রাতকে দিন করে পরিশ্রম করতে শুরু করেন। আসুন বরং বুদ্ধদেবের মুখেই শুনে নিই ওর কিছু কথা।

— জেঠু, আমার এই সাদামাটা জীবনে বলার মতো সেরকম কিছুই নেই।
— তুমি শুধু বলো তোমার জীবনেও তো একটা সুন্দর পরিবারের স্বপ্ন ছিলো, সেই স্বপ্নের পরিণতি আজ এরকম হলো কেন?
— দেখুন, সত্যি বলতে কি, বাবা হাওড়া শিবপুর বিই কলেজে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে ওই কলেজের ক্যাম্পাসেই আমার বড় হয়ে ওঠা। পড়াশুনোর শেষে বেকার বসে না থেকে টিউশন পড়ানো শুরু করি।

হ্যাঁ, একটু ভুল হয়ে গেলো। পড়াশোনা শেষ করে আমি একটা প্রাইভেট ওয়ারলেস কোম্পানিতে ওয়ারলেস অপারেটর হিসেবে যোগ দিই। উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল আমার ঘুরে বেড়াতে হতো। আজ মিনাখাঁ তো কাল বাসন্তী। কিন্তু খাটুনি যেরকমটা ছিলো মাইনেটা সেরকমটা ছিলো না। অবশেষে কাজ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। শুরু করলাম প্রাইভেটটিউটরের কাজ। প্রাইভেটটিউটর হিসেবে তখন আমার বেশ নামডাক ছড়িয়েছে। তিনচারটা ব্যাচ। প্রতিটা ব্যাচে অন্ততপক্ষে পঁচিশ তিরিশজন করে ছাত্র। মেদিনীপুরজেলায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে বাবা বাড়ি তৈরীর কাজে হাত দিয়েছেন। আমিও ঘনঘন ছুটে যাচ্ছি হাওড়া শিবপুর থেকে পূর্বমেদিনীপুর। এমন সময় মা ইনিয়েবিনিয়ে প্রস্তাবটাকে রাখলেন। –” বুঝলি খোকা তোর বাবা তোর জন্য একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে। দক্ষিণ চব্বিশপরগণার সুন্দরবনের দিকে বাড়ি। খুব লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে।

আমি মুখ নীচু করে শুনে গেলাম। যতো তালেবরই হই না কেন, বাবার মুখের ওপর কথা বলার মতো স্পর্ধা আমাদের ভাইবোনেদের ছিলোনা।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।