সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

বাউল রাজা

দ্বিতীয় খন্ড (প্রথম পর্ব)

একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে গেলো। ব্যান্ডেল জংশন ছাড়িয়ে ছুটছিলো গৌড় এক্সপ্রেস। একটা টুটিয়ার কামরায় জানালার পাশে বসে গাড়ির উল্টোদিকে আঁধারির ছুটে চলা দেখছিলাম।
কালীপুজো হয়ে গেছে দিনকয়েক হলো। বাতাসে হাল্কা শীতের আমেজ। চাঁদটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন ওটা ছলাকলার মাঝামাঝি এসে পৌঁছেছে। হাল্কা নীল সরের মতো একটা কুয়াশার চাদর ঝুলে আছে সামনের মাঠে। সে কুয়াশা হয়তো দেখা যেতো না, যদিনা চাঁদ এখন যৌবনবতী হতো। সামনের নয়ানজুলি ছাড়িয়ে যেখানে দিগন্তরেখায় মিশেছে আঁধার, সেখানকার জড়াজড়ি করে একে অন্যকে জড়িয়ে রাখা গাছগুলো রাতের আঁধারকে একটা অন্যমাত্রা এনে দিয়েছে।
প্রায় দেড় বছর পর একা একাই চলেছি অন্ধ বাউল কানাইদা আর তার সাধনসঙ্গিনী কৃষ্ণভামার ঠাঁয়ে। প্রতিটা মুহূর্ত জুড়ে রয়েছে গতবারের স্মৃতি।
ধ্রুবদাকে সাথে নিয়েই আসবো ভেবেছিলাম। দুবছর আগে যে নির্মীয়মান বহুতল আমাদের মিলনস্থল ছিলো, এখন আর সে বহুতলে আমাদের আড্ডা মারার কোনও উপায় নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো বাড়ি তৈরি হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সেটা যাদের অধিকারে থাকে, কাজ শেষ হয়ে গেলেই সেখানে আর তাদের প্রবেশাধিকার থাকে না। দুঃখজনক হলেও বিষয়টা বাস্তব সত্যি। সেই কনস্ট্রাকশন কোম্পানির অন্য সাইটে মালপত্র দিচ্ছি। কিন্তু এখানে পুরোনো স্টাফেরা কেউ নেই। বিমলদা, ধ্রুবদা সবাই অন্য এক বহুতলের কাজ দেখছেন। তবুও ধ্রুবদার বাড়ি গেছিলাম। গেছিলাম যাওয়ার কথা বলতে। কিন্তু তিনি আমার সাথে একসাথে আসতে পারলেন না। হয়তো দু’একদিন বাদে রওনা দেবেন।
ধ্রুবদার কথা মনে পড়তেই মনে পড়লো গতবারের ট্রেন ধরার কথা। কী কপালজোরেই না পেয়েছিলাম ট্রেনটা। দৌড়োতে দৌড়োতে কোনোক্রমে যখন রওনা হয়ে যাওয়া গাড়ির গেটের হাতলে হাত রেখে কামরায় সঁপে দিলাম শরীরটাকে, সেটা একটা ভেন্ডারের কামরা। একে বিনাটিকিটের যাত্রী, তায় ভেন্ডারের কামরার বাথরুমের পাশের জায়গাটুকুতে ডাঁই করে রাখা কাঁচালংকা আর সবজির বস্তায় বাথরুমের দুর্গন্ধময় মেঝেতে দ্রুবদাকে যখন নিশ্চিন্তে নাক ডাকতে শুনছিলাম, তখন সত্যিই জীবন কথাটার যে কি বিশাল ব্যাপ্তি, সেটা বুঝেছিলাম।
ট্রেনটা ঝাঁকুনি দিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু থেমে যায়নি। সাথে সাথেই একটা কুউউউউ ডাক ডেকে ফের চলতে শুরু করেছিলো।
এবারের ভাদ্র মাসেও যে তারাপীঠ মন টেনেছিলো, সেকথা সত্যি। কিন্তু ভাদ্রতে যাওয়ার ইচ্ছা এজন্যই ত্যাগ করেছিলাম যে ভাদ্রর অমাবস্যার যে একটা অমোঘ টান, সে টানের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টায় নিজেকে বুঝিয়েছিলাম যে ভাদ্র নয় অন্য কোনোদিন অন্য কোনো সময় গিয়ে দেখতে হবে যে অন্য সময়ের সাথে ভাদ্র মাসের অমাবস্যার সত্যিই কোনও পার্থক্য আছে কি না। নাকি সবটাই একটা মিথকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রচার করা। একা একা যাওয়ার পক্ষে যতই নিজেকে নিজে সার্টিফিকেট দিই না কেন, ধ্রুবদার অনুপস্থিতি কিন্তু হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ব্যক্তিজীবনে যতই স্বাবলম্বী বলে নিজেকে জাহির করি না কেন, আজকের এই যাত্রাপথে বারবার করে ধ্রুবদার মুখটা ভেসে উঠছে।
কানাইদা কি ধ্রুবদাকে ছাড়া একা আমার যাওয়াটাকে স্বাভাবিকভাবে নেবেন ? যদি তিনি মনে করেন যে বাউলনি কৃষ্ণভামার টানেই বুঝি আমি একা, ধ্রুবদাকে ফেলে উপস্থিত হয়েছি তাঁর আখড়ায়? যদি কানাইদার আখড়ায় না উঠে গুরুপদবাবার আশ্রমে গিয়ে উঠি, তাহলে কি তিনি আমায় আদৌ চিনে উঠতে পারবেন? যদিওবা চেনেন, তাহলে কি ধ্রুবদাকে ছাড়া আমাকে আদৌ আশ্রয় দেবেন তার আশ্রমে? ভাবনাগুলো যেন ট্রেনের জানালা থেকে পিছলে পড়া আলোর মতোই ছুটতে থাকলো আমার সাথে সাথে। ট্রেনটাও যেন তার দৌড়ের শব্দে একটাই প্রশ্ন করে চলেছে — তাহলে কি — তাহলে কি — তাহলে কি —
কার্তিকের অমাবস্যার থেকে চাঁদ মুক্তি পেয়েছে আজ আটদিন হলো। তার আলোর রঙ এখনও দুধসাদা হয়নি। একটু যেন ফিকে। শহর ছেড়ে বাইরে এলে বুঝি পুরোনো প্রেমিকার মতোই নিজেকে উন্মুক্ত করে দেয় আকাশ। ঝলমলে তারাদের ভীড় আর দিগন্তব্যাপী ধানখেতের ওপর ঝুলে থাকা কুয়াশার রেশমি চাদর যে মায়াজাল বুনে চলেছে, সেই মায়াজালে যেন আটকে আছে আমার চিন্তারা। সূত্রটা যখন ছিঁড়লো, তখন ট্রেনটা একটা বিশাল অজগরের মতো শরীরটাকে নিয়ে বর্ধমানে এসে হাঁফ ছাড়লো।
গাড়িটা প্ল্যাটফর্মে এসে গা এলাতেই জানালায় চাওয়ালা এসে হাজির। এখন আমি ঠিক এটাই খুঁজছিলাম। মনে পড়ছে গেলবার গলা শুকিয়ে গেলেও এককাপ চা খেতে পারিনি। এবার তাই একসাথে দু দুকাপ চা খেয়ে নিলাম। গাড়িটা যদিও নৈহাটি হয়ে আসে, কিন্তু নৈহাটিতে এতোটুকুও চা খেতে ইচ্ছে করে না। হঠাৎ কী যেন হয়ে গেলো আমার। না, মাথাটাথা ঘোরেনি, মনে হলো যেন আমার একপাশে কানাইদা আর অন্যপাশে কৃষ্ণভামা বসে আছেন। মাত্র এক ঝলকের জন্য। একদম পরিষ্কার দেখতে পেলাম। কৃষ্ণভামার দুচোখ মেঝের দিকে নামানো। মুখে স্মিত হাসি, আর কানাইদার সেই কোটরের ভেতর লেপ্টে যাওয়া আঁখিপল্লবের মাঝে সেই ভুবনভোলানো হাসির ঝলক।
কেন দেখলাম ওদের? তাহলে কি সূক্ষ্মশরীরে ওরাও আমার সঙ্গী হয়েছে আজ? শুনেছি মনের মধ্যে যাদের বসত তাঁরা কখনও কখনও হঠাৎ করে চেতনার মাঝে দৃশ্যমান হন।
–” আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে —”
লম্বা কম্পার্টমেন্টের একেবারে শেষের দিকটায় খমকের আওয়াজের সাথে গানটার কলি ভেসে আসছে। ঠিক এই সময়েই গানটা ধরতে হলো? আমার চেতন অবচেতনে যখন আমার মনের মানুষেরা এসে উঁকি দিয়ে গেলো, ঠিক তখনই কে তুমি বাউল আমার শ্রবনে সেই সুধারস ঢেলে দিচ্ছ –” ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো, দিও তোমার মালাখানি বাউলের এই মনটারে –”
মনে হলো সিট ছেড়ে উঠে ওর কাছে যাই, পরক্ষণেই মনে হলো দূর থেকে যেটা মধুর, কাছে গেলে তার মাধুর্য নষ্ট হতে পারে।
তবে মনে মনে গায়ককে বললাম — না গো গোঁসাই — আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখবো না। যে আমার মনমন্দিরে আসন পেতেছে, তার সাথে আমি অন্তরের অন্তরেই মধুর মিলনের আনন্দ উপভোগ করবো। জানালার বাইরে এই যে অনন্ত আকাশ, এই যে আদিগন্ত ব্যাপী চরাচর, এই নক্ষত্রপুঞ্জ, ছায়াপথ — আকাশগঙ্গা ছাড়িয়ে যে ব্রহ্মাণ্ড, সে ব্রহ্মান্ডের কোনও এক নক্ষত্রসৃষ্ট গ্রহের অভ্যন্তরে যে লীলায় মেতে আছেন বিশ্বপিতা, তার আস্তানায় না যেতে পারলেও যদি মনের আস্তানায় তার প্রেমকে প্রত্যক্ষ করতে পারি, তাহলে এই মানবজন্ম ধন্য হবে।
— বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও –”
কানাইদা — তুমি আর তোমার সাধনসঙ্গিনী যে মায়ার বাঁধনে আমায় বেঁধেছো সে কি শুধুই মায়া না কি সেটাই প্রেম, সেটাই অন্তরের যোগ। নইলে আজ আমি কিসের টানে ছুটে যাচ্ছি? স্থানমাহাত্ম্যেতারাপীঠ হলেও কি টানটা মা তারার না কি ওই কালো হরিণ চোখের যে মায়াবী ডাক সে ডাকে সাড়া দিতে আমার এই অস্থিরতা!
ওগো বাউলনি, আমি জানি তোমার সাথে আমার কোনও সম্পর্ক থাকতে নেই, আমি জানি কানাইদার কাছে তুমি অঙ্গীকারবদ্ধ। তবুও এ কোন টানে আমায় নিরন্তর টানছো? কেন আমি ধ্রুবদাকে ফেলে রেখেই ছুটে চলেছি একা? কই মা তারার মুখ আমার মানস চোখে ভেসে উঠছে না কেন? কেন আমি তোমায় দেখতে পাই আমার পাশে? যদিবা তুমি আমার কাছে প্রকট হও, তাহলে সাথে কানাইদাকেও এনে হাজির করাও কেন?
গাড়ির দুলুনির সাথে মনের তলায় তলিয়ে থাকা কথাগুলো নড়াচড়া করতে থাকে। আমি যেন ভাবনার অতলে তলিয়ে যেতে থাকি। এজন্যই বুঝি সাথে একজন হলেও ভ্রমণসঙ্গী প্রয়োজন হয়, তাহলে বুঝি এই ভাবনার অতলে তলিয়ে যেতে হয় না। কথায় কথায় সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়।
হঠাৎ করেই হট্টগোলে চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেলো। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি গুসকরা এসে হাজির। গতবার এই গুসকরাতেই সাথে পেয়েছিলাম প্রখ্যাত বাউল গোষ্ট গোপাল দাসের বাবাকে। ধ্রুবদা আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। নামটা যেন কী বলেছিলেন মনে নেই। তবে ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে তিনি একজন চমৎকার মানুষ। দুচোখ দিয়ে প্ল্যাটফর্মের সমস্ত মানুষদের একবার দেখে নিচ্ছি। সম্ভবতঃ গোষ্ঠর বাবাকেই মন খুঁজছে। গাড়ির দরজা দিয়ে একজন গৈরিক বসন পরিহিত মানুষ খমক হাতে আমার দিকেই এগিয়ে আসছেন। শ্মশ্রুমন্ডিত মুখে গোঁফের আড়ালে কি একটুকরো হাসির রেখা দেখলাম?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।