সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ৩)

সুন্দরী মাকড়সা

এমনকিছু বড়োলোকের ঘরে জন্মায়নি ঋষি। বিঘে কয়েক ক্ষেতের জমি, আর দুটো মিষ্টি জলের পুকুর। ছকাঠার মতো বাস্তু জমিতে ওর বাবারা দুভাই মিলেমিশে থাকেন। দুভাইয়ের একটাই ধানের গোলা। তবে রান্নাঘর আলাদা। পুকুরের পাড়ের কলাবনে যখন বাতাস ঝরঝর করে আওয়াজ তোলে তখন কেমন যেন মনে হয় জঙ্গলের রাজা মঙ্গলরায়ের পায়ের তলায় শুকনো কলার পাতা গুঁড়িয়ে যাওয়ার শব্দ।
বাড়ির উত্তরপূর্ব কোণে ধর্মঠাকুরের থান। ওদের সবারই বিশ্বাস যে তেনার উপস্থিতিতে বাঘেরা বেড়ালের মতো মাথা নীচু করে উঠোন পেড়োয়। এদিকওদিক ঘাড় ঘোরায় না। তা সত্বেও যখন সেবারে তাদেরই একজন মেজো ঠাকুরদার ঘাড় কামড়ে নদী পেড়িয়ে ওপারের জঙ্গলে উধাও হলো তখন সবাই ধরেই নিয়েছিলো যে কোনো অনাচারে ধর্মদেবতা বুঝি কুপিত হয়েছেন।
বাঘ নয়, ঋষিদের গ্রামের পরিবারগুলো আসলে ভয় পায় নোনা জলকে। আকাশের কালোমেঘের ডাকে যখন গবাদিগুলো গলার দড়ি ছিঁড়ে দিকশূন্য ভাবে দৌড়ে পালায়, ঠিক তখুনি, দামাল কিশোরের মতো নদীপারের মাটির বাঁধকে লাফ মেরে ডিঙিয়ে যায় রাক্ষসী নদী। আর হুড়মুড় করে ক্ষেতে পুকুরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে নোনা জল। গ্রামের মানুষের দুচোখ ভেঙে নোনতা স্বাদে ভরে ওঠে জীবনের খাতার পাতা।

গাঁয়ের ইস্কুলে প্রাথমিক পরীক্ষাগুলো পাশ করে ঋষির বাবা কলকাতার গড়িয়া বিরজিতে তাঁর শ্যালকের বাড়িতে রেখে দিয়ে এসেছিলেন ওকে। সেই যে কলকাতায় পা রেখেছিলো সে, কেবলমাত্র ঘুরতে যাওয়া ছাড়া আর কখনও কৈখালিতে পা রাখে নি ঋষি। সম্পন্ন মামাবাড়িতে থেকেই স্কুলের গন্ডী ছাড়িয়ে কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে সে।
হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে ধাক্কা মারলো দরজাটার গায়ে। দরজাটা ঠকঠক করে কেঁপে উঠে ফের শান্ত ছেলের মতো চুপ করে দাঁড়ালো।

ঋষি দরজার ছিটকিনি খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। এদিকটাতে এখনও আকাশ দেখা যায়। তারায় তারায় ঝকমক করছে আকাশটা। দুতিনদিন হলো অমাবস্যা গেছে। সন্ধ্যাবেলাতে সামান্য বৃষ্টি হয়েছে। দিন কয়েক বাদেই মহালয়া। আকাশের দিকে তাকালে ওর নিজের গাঁয়ের কথা মনে পড়ে যায়। ছেলেবেলার কথা, মায়ের কথা, সমস্ত গ্রামটাই যেন তখন আকাশের বুকে তাঁদের ঘরবাড়ি বানিয়েছে।
হঠাৎ করে কুঁয়োটার দিক থেকে একটা ধস্তাধস্তির আওয়াজে চমকে উঠলো ঋষি। ঝোপঝড়ের ভেতর ঘন অন্ধকার চাপ বেঁধে আছে। কিছু নজরে এলো না ওর। ঘরে ঢুকে পাঁচ ব্যাটারির টর্চটাকে হাতে নিয়ে কুঁয়োর দিকে আলো ফেললো ঋষি।
নাহ্, কোনোকিছু নজরে পড়লো না। পাঁচ ব্যাটারির টর্চটাতে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় কী? কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। ঝোপগুলোও ভালো ছাত্রের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে। সামনের দিকে দুপা এগোতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো।
এই রাতে আজ আর যাবে না। বরং কাল সকালে একবার গিয়ে না হয়…
হাতের টর্চটাকে নিভিয়ে ঘরে এসে ঢুকলো ঋষি — ”

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।