সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ৬)

বাউলরাজা

তৃতীয় খন্ড (ষষ্ঠ পর্ব)

আজও যখন একা বসে বসে সেই আশ্চর্য প্রেমিক নারীর কথা মনে হয় তখন যেন আমার সর্বাঙ্গজুড়ে নিঃশব্দে বিদ্যুৎ স্পর্শের অনুভব হয়। সব প্রেম, সব ভালোবাসা সমাজগ্রাহ্য নয়। যে প্রেম সামাজিক অনুশাসন মেনে মানুষ তৈরী করেছে, সে প্রেমে হয়তো দীর্ঘকাল বাদেও সহবাসের সমঝোতা থাকে কিন্তু মন কতোটা সেই সমঝোতাকে মনে মনে মেনে নেয় সেটা মন নিজেও জানে না। কিন্তু সমাজের চোখ রাঙানোকে উপেক্ষা করে, সমাজের তোয়াক্কা না করে যে প্রেমের জন্ম, সে প্রেমে হয়তো শরীরি সম্পর্ক স্থায়িত্ব পায়না, কিন্তু মনের গভীরে তার চিরকালীন বাস। সে সম্পর্কের সুগন্ধ বুকে নিয়েই হয়তো মানুষ তার শেষযাত্রায় সামিল হন। আমার প্রতি বাউলদিদির ভালোবাসা অথবা বাউলনির প্রতি আমার মনের যে আসক্তি সেটা কতোটুকু দেহজ সেটা আজও বুঝতে পারিনে, কিন্তু তার বৈঠার ছলাৎ শব্দ যে এখনও উতলা করে দেয় সেটা অস্বীকার করা অমানবিক শুধু নয় অস্বীকার করাটা পাপ।

আমার পায়ের পাতায় কৃষ্ণভামা ওর দুহাতের পাতা দিয়ে স্পর্শ করলো। ওর পদ্মডাঁটার মতো আঙুলগুলো চোখের জলে সিক্ত হয়ে আছে। ওই অন্ধকারেও আমি যেন একটা আলোকলতাকে আলুলায়িত হতে দেখলাম। আমার দিকে মুখ তুলে অস্ফুটে বললো — ঠাকুর!
যেন সেই কোন সুদূর থেকে একটা তারার আলো এসে আমার দুচোখকে স্পর্শ করলো।
— তুমি একটা কতা নিচ্চয় জেনো ঠাকুর, আমি আমার এই কৌমার্যকে আমার গোঁসাইকে নিবেদন করিচি। এ নৈবেদ্য আর অন্য কোনো থালায় অন্য কারো জন্য হাতে দরে সাজিয়ে দিতে পারবো না। কিন্তু তোমার অন্তরের আলো যে আলোর বাঁদনে আমায় বেঁদেচে, সে বাঁদনের গিঁট খুলবার সাদ্যিও আমার নেই।

এ বড়ো অদ্ভুত বড়ো জটিল প্রেম। এর গভীরে ডুবতে গেলে তল খুঁজে পাওয়া যাবেনা আবার ওপরে ভেসে থাকারও জো নেই।
আমি ধীরেধীরে নীচু হয়ে ওই আলোকলতার কাঁধ ধরে টেনে তুললাম। ফের আমার মুখের সামনে ওর মুখ, আমার ঠোঁটের সামনে ওর ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে। ওর শ্বাস আমার দুগালকে যেন আদর করছে। কিন্তু সে মুখে মুখ রাখা যাবেনা, স্পর্শ করা যাবেনা ওর দুঠোঁটের থরথরানি — এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
— আমি জানি বাউলদিদি। প্রত্যেকের সম্পর্কের মাঝে একটা করে গন্ডী আঁকা আছে। আমি কি কোনোদিনও সেই গন্ডীর দাগ স্পর্শ করতে চেয়েছি বলো? আমি সূর্য, চাঁদ আর পৃথিবীর সম্পর্কের কথা জানি। আমি জানি যে পৃথিবীর কোনো অধিকার নেই চাঁদকে ছোঁয়ার। অথচ সূর্যের আলোর স্পর্শের অহংকারে অহংকারী চাঁদ পৃথিবীর বুককে মায়াবী আলোয় ভরিয়ে দেবার অধিকারের অধিকারিণী।
— দাঁড়াও দেকি। সহজ করে বুইজে বলো দেকি, তাহলে আমাকে তুমি অহংকারী ঠাওরালে ঠাকুর! কোন অহংকারে তোমায় দেকতে না পেয়ে কেঁদে কেঁদে আমার দুচোক অন্দ হয়ে যায় বলো দেকি!
— সেটা তো অমাবস্যার অহংকার গো বাউলদিদি। ভালোবেসে অন্ধ হওয়ার মধ্যেও একটা চরম অহংকার আছে গো বাউলনি। সে অহংকার যার আছে সে বোঝে না, যে বোঝে সে বিরহের অমাবস্যার অন্ধকারে বসে বসে প্রতিপদের অপেক্ষা করে।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।