সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

বাউল রাজা

দ্বিতীয় খন্ড (ত্রিপঞ্চাশৎ পর্ব)

এ ঘটনাকাল আজ থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগেকার। কিন্তু কী আশ্চর্য, আজও যখনই সময়, সংসার থেকে একটুখানি অন্যমনা হওয়ার সুযোগ আসে, তখনই মনের ভেতর মেঘছেঁড়া চাঁদের আলোর মতো ঘটনাপরম্পরা এসে মনের আকাশে উঁকি দেয়।
প্রথমবার এসে যখন প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা তাঁর কাছে রাখতে দিয়েছিলাম, তখন গুরুপদবাবাই প্রথম আমাকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে আমাকে তারাপীঠে আরও বহুবার আসতে হবে। এরপর যে কতোবার যেতে হয়েছে আমাকে জীবন জীবিকার প্রয়োজনে সে কথা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। নলহাটি, রামপুরহাট, মহম্মদ বাজার, রাজগ্রাম, পাঁকুড়, বীরভূমের চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কালো পাথরের খনিতে কতো দিনকে যে রাত বানিয়েছি তার কোনো হিসেব নেই।
কোনোবার হয়তো দাদুর আশ্রমে রাতের পর রাত কাটিয়েছি। বীরভূমের উত্তপ্ত পাথরখাদানে কাটানো শরীরের সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে এসে আশ্রয় নিয়েছি গুরুপদবাবার ছোট্ট একটুকরো শান্তির আশ্রয়ে। হাজার হাজার টাকা নিশ্চিন্তে জমা রেখেছি ভদ্রলোকের জিম্মায়।
কোনো কোনো রাতে দেখা হয়েছে কানাই বাউলের সাথে, বাউলনির সাথেও দেখা হয়েছে বহুবার। কিন্তু ওরাও যেমন আমাকে কোনোদিনও ওদের আখড়ায় যেতে বলেননি, আমিও কাজের অজুহাতে ওদের এড়িয়ে গেছি। নদী, গাছপালা, চাঁদনি রাতের মোহময়তায় আবিষ্ট হয়েছি। রাতের পর রাত কাটিয়েও কানাইদার আশ্রম, ছাতিমগাছ, বাউলদিদি, ছোট্ট ছুটকির সাথে কাটানো সময়গুলো এক আশ্চর্য যাদুর মতো আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে।
হারিয়ে গেছে বললে মিথ্যে বলা হবে। সে সময়ের পরতে পরতে স্বপ্নের মতো যে দিনগুলোর, যে ঘটনাগুলোর প্রবাহ আমাকে একটা ঘোরের মধ্যে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিলো, জানি না সেই স্বর্গীয় অনুভূতি আবার কোনোদিনও আমি ফিরে পাবো কি না! সেইসব দিন হয়তো মনের গহনে লুকিয়ে আছে। যেমনভাবে লুকিয়ে থাকে মাটির বুকে দোপাটি ফুলের বীজ, সময় এলেই ফের ধীরে ধীরে অঙ্কুর মেলে ধরে তার পরিচিত পৃথিবীর বুকে, যেমনভাবে সুর লুকিয়ে থাকে দোতারার তারে, বাউলের হাতে পড়লেই ফের সেই সুর পাখা মেলে ভালোবাসার হাওয়ায় হাওয়ায়, ঠিক তেমনি করেই সেই দিনগুলোও হয়তো মুখ লুকিয়ে নিশ্চিন্তমনে ফের অপেক্ষায় আছে, শরীরের ঘাম শুকোলেই ফের কোনোদিন বাউলনি ঠোঁট ফুলিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে — ” আমি বুঝি খুব গভীর অন্যায় করেচি ঠাকুর ? নিচ্চয় করেচি, কিন্তু তাই বলে আমাকে ভুলে যেতে হবে! এতো বড় শাস্তি তুমি আমাকে দিতে পারলে গো ঠাকুর! “
অথবা নদী হয়তো ফের কোনোদিন পথ আগলে এসে দাঁড়াবে, বলবে –” ভাগ্যিস মানুষ হয়ে জন্মাইনি গো, মানুষ হলে পরে কি এরকম পাষাণ হতে হয়? মেয়েটির কান্নার জলে যে আমার বুকে বান ডাকে গো, কিন্তুক তোমার বুকে কি পাতর বেইনদে রেকেচো গো ঠাকুর! “
কিম্বা কোনো এক চাঁদনি রাতে কোনো খমকের সুরে কেউ হয়তো গেয়ে উঠবে –” আমি তারেই জানি তারেই জানি, যে আমারে আপন জানে তারেই জানি –” আর আমার মানসচোখে ছায়ার মতো দোল খাবে এক অভিমানী নারীর মুখ। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে একছুটে সে পালিয়ে যেতে চাইবে আমার মনের কোণের বাইরে।
শুধুই হয়তো আর হয়তো, মন কখনও বলছে হয়তো বা ফের হবে, আবার কখনও বলে উঠছে নিশ্চয়ই হবে, হতেই হবে। মনের এই দোলাচলের নামই কি জীবন? এই দোলাচল আছে বলেই কি মনের মধ্যে যাপন করা কোনো নারী নদী হয়ে কথা বলে ওঠে ? জন্মান্ধ কোনো বাউল তার দাওয়ার ওপর ছাতিম পাতার সাথে লুকোচুরি খেলতে থাকা চাঁদের ছায়া দেখতে পান? এমন অনেক কিছুই আমরা দেখি, দেখতে পাই, কিন্তু খেয়াল করি না। সেটাও কি ওই দোলাচলের জন্যই? কোন মানুষের মনের আকাশে কোন ভাবনারা শিমূল তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে, সেটা কীভাবে অন্য কোনো মানুষের গোচরীভূত হয়!
শুধু কী হয় বা হতে পারে, আর কী হয় না বা হতে পারে না — এই দোলাচলের মধ্যেই এই মায়াজগতের মায়াজাল ছড়ানো রয়েছে।

খাওয়া দাওয়ার পর, অনেকক্ষণ পর্যন্ত শুধু এপাশ ওপাশ করছি। কিছুতেই ঘুম আসছে না। ভোররাতে রওনা হতে হবে। সবাই নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে, ধ্রুবদার নাক ডাকার আওয়াজ বোধহয় পৃথিবীর শেষ প্রান্ত থেকেও শোনা যাচ্ছে। দূরে কোথাও কোনো সাধক বাউলের মরমীয়া সুরের মূর্ছনা যেন অষ্টমীর চাঁদের আলোর সাথে মিলেমিশে দোল খাচ্ছে ছাতিমছেঁচা বাতাসে।

হঠাৎ যেন একটা অস্পষ্ট ফোঁপানোর আওয়াজ ভেসে এলো। খুব কাছে অথচ যেন পৃথিবীর কোনও এক দূর প্রান্ত থেকে। কান খাড়া করলাম। কে কাঁদে? বাউলনি নয়তো!

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।