–” তুই এইখানে! আর আমি সারা তারাপীঠ খুঁইজ্যা বেড়াইতাসি –”
–” সারা তারাপীঠ মানে? ”
–” মানে ওই আর কি। গুরুপদবাবার ঘরে –”
–” ওই ঘরে বেশীক্ষণ থাকলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাবো। ”
–” ক্যান? ”
–” সারাটা ঘর জুড়ে কলকি থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এক কলকি শেষ তো সাথে সাথেই.. ”
–” সুবুদ্ধু মহারাজের কাছে গিয়া চুপচাপ বইস্যা থাক। ওনার কথার থিক্যা যেইটুকুন পারবি গিল্যা নিবি। মহাপুরুষ, বুইছস সাক্ষাৎ মহাপুরুষ। “
–” ওর কথাগুলো আপাতভাবে খুব সোজাসাপটা, কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে ভাবলে কথাগুলোয় দু-তিন রকমের মানে দাঁড়িয়ে যায়। “
আমি যে হঠাৎ করে এ ধরণের কথা বলবো, ধ্রুবদা সম্ভবত সেটা চিন্তাও করে উঠতে পারেন নি। ওর ধারণায় ছিলো, আমি বোধহয় মহারাজের কথাবার্তাকে ঠিক পছন্দ করি নি। এটা ওর ধারণাতেই আসে নি যে, আমি মহারাজের বিষয়ে এরকম একটা সার্টিফিকেট দিয়ে বসবো।
–” জানো ধ্রুবদা, আমাদের পার্টিতে একজন খুব মজার মানুষ আছেন। তিনিও একদিন আমাকে ঠিক এই ধরণের কথাগুলোই বলেছিলেন, তবে অন্য আঙ্গিকে। ”
–” কিস্যু বুঝলাম না। ওইসব আঙ্গিক ফাঙ্গিক, এতো খটমট কথা আমি বুঝতে পারি না, সোজা কইরা ক’ দেখি! ”
— ” মানে হলো গে, কথাগুলো একই ধরণের হলেও বিষয়টা আলাদা। মানে তোমার ওই সুবুদ্ধ মহারাজের কথা আর —”
— ” দ্যাখ, বড়ো মানুষগো চিন্তাও একই রকমের হয়। ওই যে ইংরাজিতে আছে না — আরে ধুস, কী জানি কথাডা? সময়মতো মনেও আসে না ব্যাঙের মাথা –”
–” গ্রেট মেন্স থিংকস এলাইক। ”
–” হ, হ — এইডাই –”
–” আমাদের পার্টির ভদ্রলোক ঠিক তোমাদের সুবুদ্ধ মহারাজের মতো একই উপমা দিয়েছিলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে। তিনি বলেছিলেন — খাঁচাটা হলো গে শৃঙ্খল, যেটা মেহনতী মানুষকে বন্দী করে রেখেছে — পরাধীনতার প্রতীক। পরাধীন মানুষ যখন স্বাধীনতার জন্য খাঁচার দরজা ভেঙে ফেলতে চায়, তখন পুঁজিবাদী মানুষ গণতন্ত্র নামের একটা নতুন বেড়ির সৃষ্টি করে। ছোট খাঁচাটাকে অনেকটাই বড় করে তৈরি করে তার ভেতরে পাখিটাকে ছেড়ে দেয়। পাখিরা যেন মুক্তির স্বাদ পায়। তাদের ডানা খাঁচার লোহায় ঘষা খায় না। সেই খাঁচার ভেতর নকল গাছপালায় ওরা উড়তে পারে, আকাশও যেন ধরা দেয় ওদের ডানায়, ওরা ভাবে ওরা মুক্ত। আসলে যে বন্দী হয়ে আছে গণতান্ত্রিকতার মোড়কে, সেটা সে বোঝে না।
আর তোমার মহারাজ, শরীরটাকে খাঁচা বানিয়ে মনপাখীকে বন্দী করে দিলেন সেই খাঁচার ভেতর। খাঁচাটাকে তুলনা করলেন রিপুর সাথে। শরীরটার থেকে মনকে উড়িয়ে দিতে বললেন মুক্তির আনন্দ পাওয়ার বাসনায়। একটা আশ্চর্য জিনিস দেখো, দুজনেই কিন্তু মুক্তির পথ খুঁজছেন। একজন ভাববাদী পথে, একজন বস্তুবাদী পথে। ”
–” দ্যাখ, আমার তোগো মতন অতো জ্ঞানগম্যি নাই। আমি শুধু একডা কথাই বুঝি, পৃথিবীতে যতো দর্শন আছে, সবাইরই শুধু একটাই খোঁজ। সেই খোঁজ মুক্তির, সেই খোঁজ উড়ানের, সেই খোঁজ আনন্দের, সেই খোঁজ প্রেমের। ”
–” বাঃ, কি সুন্দর করেই না কথাগুলো বললে গো ধ্রুবদা। কে বলে তুমি শিক্ষিত নও, তুমি স্বশিক্ষিত। সবাই যে পড়াশোনা করেই শিক্ষিত হবেন, তার তো কোনও মানে নেই। তোমার ভেতরে যে পাঠশালা আছে, সে পাঠশালা অনেক ইউনিভার্সিটির থেকেও সমৃদ্ধ।”
–” ও নদীরে
তোর মনের ভেতরে নারীর বাসা কই?
নারীর সাথে বান্ধুম বাসা
সেই আশাতেই রই —
নদীরে, তোর ভেতরে নারীর বাসা কই?
কৈশোর গেলো হেলাফেলায়
যৌবন গেল রঙ্গে,
প্রৌঢ় কালে, কই গেলা রে নদী
বার্ধক্যে কাটাই কার সঙ্গে রে নদী
কাটাই কাহার সঙ্গে..
উথাল-পাতাল ঢেউয়ে ভাসো গো নদী
নারীর লীলারঙ্গে…