|| শাম্ভবী সংখ্যা ২০২১ || T3 শারদ সংখ্যায় প্রদীপ গুপ্ত

ভাসান

এবার বাড়ির বড় বৌ কিছুতেই অক্রুর চাচাকে বাড়ি যেতে দেন নি। পঞ্চমীর দিন বিকেলে অক্রুরচাচা যখন বোস বাড়ির দূর্গাদালানের কলি ফিরিয়ে, বাড়ির আনাচেকানাচে জমে থাকা সমস্ত জঞ্জাল পরিষ্কার করে, দূর্গাদালানের মেঝে, চাতাল ধুইয়ে মুছিয়ে তার লুঙ্গির খুঁটে ধোয়া দুহাত মুছে বাড়ির বড় বৌয়ের কাছে এসে ছুটি চাইলেন, তখন প্রায় সাঁঝের আলো ছুঁই ছুঁই। বড় বৌ দূর্গাদালানের পিলসুজে পিদিম জ্বালবেন বলে কোঁড়া লালপেড়ে শাড়ি পড়ে হাতে পিদিম নিয়ে শিউলিতলা থেকে মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলেন।
সেসময় পালমশাইকে ঘিরে অপলক তাকিয়ে আছে বাড়ির বাচ্চা বুড়ো সবাই। রীতি অনু্যায়ী পালমশাই সেদিন, সন্ধ্যা উজোলে প্রতিমাকে চক্ষুদান করবেন।
–” মা জননী, এবার যে আমায় বিদায় দেতে হবে মা, আমার সব কাজ সারা হয়ে গেচে গো মা জননী। “
হাতের পিদিমটা আলগোছে শিউলি তলায় রেখে বড়বৌ অক্রুরের দুটো হাত ধরলেন।
–” না অক্কুরচাচা, এবেরে তোমায় আমি ছুটি দিতে পারবো না। তোমায় এবেরে দশমী অবদি থাকতে হবে। “
–” সে কি মা জননী! আপনি কি বলতেচেন সেটা খেয়ালে রেকেচেন? এতে যে তোমার ওপর… “
অক্রুরকে কথা শেষ করতে দেন না বড়বৌ। গলায় শাড়ির আঁচল পেতে অক্রুরের দু’হাত ধরে বলে উঠলেন —
— ” যে যা বলার বলবে, আমার তাতে কিচুই আসপে যাপে না। আজ ভোরে আমি যে স্বপ্ন দেকলুম, তোমার দু’চোকে নীলকন্ট পাখি এসে ঠাঁই নেচে, সে স্বপ্নরে আমি ভুলি কীভাবে বলো দিনি? “
–” তাই বললে কি চলে গো মা জননী, আমি যে… “
–” চাচা, তুমি বলো দিকি, ঠাকুরদালান রঙ করেন কিনি? মন্দিরের মেঝে, চাতাল ধুয়ে পাকলিয়ে পরিষ্কার করেন কিনি? তকন বুজি তিনি মোচলমান থাকেন না। হিঁদু হয়ে যান? আমি কোনো কথা শুনপো না গো অক্কুরচাচা, এবেরে তোমার যাওয়া চলপে না। মায়ের বোধনের থেকে বিসজ্জন পয্যন্ত থাকতে হপে। নইলে আমার ভোরের দেকা স্বপ্ন বিথা হয়ে যাবে গো। “
এ কথার পর আর কোনো কথা চলে না। অক্রুর হাল্কা করে মাথা নাড়তে বড়বৌ অক্রুরের ধরে থাকা হাত দুটো ছেড়ে, শিউলিতলা থেকে পিদিমটা হাতে তুলে নেন।
যাবতীয় বাসনকোসন ধোয়ামোছার দায়িত্ব, অক্রুরের হাতে সমর্পণ করে বড়বৌ নিশ্চিন্ত হলেন।
আজ দশমী। বিকেল থেকে ঠাকুর ভাসানের তোরজোড় চলছে। ঠাকুরমশাই ঘট নেড়ে দিয়ে বিসর্জন সম্পন্ন করলেন। বাড়ির পুরুষেরা ধুতির কোচা বাঁধছেন। হঠাৎ অক্রুরের দিকে নজর গেলো বড়বৌএর। অক্রুরের হাত ধরে রয়েছে বছর দশবারোর একটা ফুটফুটে মেয়ে। কী অপূর্ব রূপ সে মেয়ের। দেখে যেন চোখ সরাতে পারেন না বড়বৌ।
–” মেয়েটি কে গো অক্কুরচাচা! “
–” জানিনে গো মা জননী, বিসজ্জন দেকপে বলে এসে হাত ধরেচে। “
–” তুই কে রে মেয়ে? নাম কী তোর? বাড়ি কোতা? “
–” তুমি আমায় আগে দেকোনি গো বড়মা! এই চারদিন ধরে যে পাত পেড়ে ভোগ পেসাদ খেলাম গো, তুমিই তো বেড়ে দিলে গো? “
–” অ, তাই? তা তোমার নাম কী গো বাছা? “
–” পদ্মগো বড়মা। “
–” আহারে, ঠিক যেন পদ্মের কুঁড়ি গো, যাই হোক, বিসজ্জনের পর মিষ্টি মুক না করে যেন যেও না গো বাছা। “
দিঘীর ঘাটে ভীড়ে ভীড়। মেয়েটি অক্রুরের হাত ছাড়ে না। বোসবাড়ির আত্মীয় পরিজনের হাতে সাতপাক ঘুরে দেবী মৃণ্ময়ী বিসর্জিতা হলেন। সবার সাথে অক্রুর মেয়েটির হাত ধরে ফিরে চললেন বোস বাড়ির দূর্গাদালানের দিকে। দীঘির জল থেকে বিসর্জিতা মায়ের কাঠামো নিয়ে আসা হয়েছে ঠাকুরদালানে। আগামী এক বছর দেবীর বেদীতেই রাখা থাকবে কাঠামো। পরের বছর এই কাঠামোতেই ফের ধীরেধীরে গড়ে উঠবে মায়ের মৃণ্ময়ীমূর্তি। বড় বৌ তেলভরা প্রদীপ নিয়ে জ্বেলে দিলেন কাঠামোর সামনে। আজ সারারাত ধরে জ্বলবে এই প্রদীপ।
এরপর মিষ্টির হাঁড়ি থেকে সবার হাতে মিষ্টি দিয়ে মিষ্টিমুখ করা শুরু হলো। একেবারে শেষে দাঁড়িয়ে আছেন অক্রুরচাচা। কিন্তু মেয়েটি কোথায়? বড় বৌ বিচলিত কন্ঠে অক্রুরকে শুধোলেন — ” পদ্ম গেলো কোতা চাচা? “
–” সে তো আমার হাত ছেইড়ে দে ওই কাটামোকে পেন্নাম কইরবে বলে ওদিকেই গেলো গো বড়বৌ! “
বড়বৌ এগিয়ে গেলেন কাঠামোর কাছে। কোথায় সেই মেয়ে? কোথায় কী? কাঠামোর গোড়ায় পড়ে,রয়েছে একরাশ ফুটে থাকা পদ্মের কুঁড়ি।
বড়বৌ হাত ধরে টেনে নিয়ে এলেন অক্রুরকে। ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন — ” ওই দেখো চাচা সেই মেয়ে কেমন পদ্ম হয়ে ফুটে আচে মায়ের বেদীতে। আজ আমি বুজলুম গো, কেন সেদিন ভোরের বেলা আমি স্বপ্নে তোমার চোকে নীলকন্ট পাখীকে দেকেচিলুম গো চাচা। “
কথাকটা বলে গলায় আঁচল পেঁচিয়ে সবার সামনে অক্রুরের হাত দুটো ধরলেন।
— ” সত্যি করে বলো দেকি চাচা, ওই মেয়ের ছোঁয়ায় কি তোমার ধম্ম নষ্ট হলো? “
সবাই দেখলেন, দু’জনের চোখের জলেই ভেসে যাচ্ছে দু’জনার বুক।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।