রম্য গদ্যে প্রদীপ্ত দে

হনুবাবু, করোনা ও ত্রাণ

সকালে উঠে ঘোৎ ঘোৎ করে চা গিলে ,মুখে একটা মাস্ক লাগিয়ে হনুবাবু চললেন বাজারে। উলুঢুলু চোখে হনহনিয়ে যাচ্ছে । হাতে একটা ঢাউস বাজারের থলে। রোজ যেমন যান। একটু এগোতেই পাড়ার মোড়ে পটকা দাঁড়িয়ে। ও হো !! দাঁড়ান ,গল্পটাকে একটু পেছনে গুটিয়ে নিই।
সকালবেলা গিন্নীর চিলচিৎকারে ধড়ফড়িয়ে ঘুম ভাঙলো অনুমানবাবুর। অনুমান কর।
জন্মের পরে বাবা- মা ভেবে পেলেন না ছেলের কী নাম রাখা যায় । গুরুদেবের শরণাপন্ন হলেন । প্রখর রোদ্রে দু ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে যখন বাবাজির সামনে গেলেন তখন এমনিতেই চোখে সর্ষেফুল দেখছেন। গুরুর পায়ে পড়ে বললেন
– বাবা, ছেলে হয়েছে । কী নাম রাখি বাবা ?
গুরুদেবের চোখ কপালে। দুটো ঠোঁট অদ্ভুত ভঙ্গিতে উল্টিয়ে গুরুদেব পাল্টা প্রশ্ন করে ?
– ছেলে কী হতে চায় ?
ততক্ষণে পেছন থেকে তাড়া লাগাচ্ছে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ঠেলাঠেলি সয়ে চোখাচোখি করে ভিরমি খেয়ে বলল
– কী করে জানবো বাবা ? ও যে এখন শুধু ওয়াও ওয়াও করে কাঁদে।
দুটো ভুরু বেকিয়ে চোখ নীচে নিয়ে বাবা হাত তুলে বলল
– অনুমান কর।
ব্যাস !! আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঠেলে এগিয়ে চলে এল পরের লোক। ভীড়ের প্রবাহের সাথে বয়ে গেল ওনারা। স্বামী-স্ত্রী এটাই মনে মনে ভেবে নিল যে গুরদেবের কত মহিমা ! পদবী শুদ্ধু নাম বলে দিল । নাম হয়ে গেল অনুমান কর। দুর্ভাগ্য! এরকম নাম নিয়ে যে স্কুলজীবন থেকে তার ছেলেকে কী স‌ইতে হবে তার অনুমান তারা করতে পারলেন না।
ক্লাস থ্রি থেকেই চালু হয়ে গেল নাম । হনুমান কর । ক্লাস সিক্স থেকে পাকাপাকি ভাবে হনুমান। ক্রমশ অনুমান যত বড় হলো,তার নিজের কাছেই নিজের নাম গুলিয়ে যেতে লাগল। বহু মানুষের সামনে নিজের নাম বলতে গিয়ে সে হনুমান বলে ফেলেছে। এখন বয়স বাষট্টি। রিটায়ার্ড। কর্পোরেশন অফিসে ছিলেন। সারাটা জীবন মানুষের বর্জ্যনিকাশী পাইপলাইনের অভিযোগ শুনতে শুনতে দুর্গন্ধে ভরে গেছে ভেতরটা। হতাশায় চুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে মাথার তালু অবধি এখন খালি। এখন ওরা থাকে ওধারে । উচ্চতা কমের দিকে। পুরুষ্ট পেট আর থ্যাবড়ানো নাক নিয়ে ওনার ক্ষ্যাপাটে চেহারা দেখে দেখে ছেলেছোকরাদের খোলতাই সময় কাটে।
সক্কাল সক্কাল ঘুম ভেঙে ভেজা পাউরুটির মতো মুখ নিয়ে বিছানা ছাড়লো হনুবাবু। বাজখাই গলায় চিৎকারসহযোগে তখন গিন্নীর বাসন মাজা চলছে। গিন্নী শুচিবায়ুগ্রস্ত । রাতে যে বাসন মেজে রাখা হয়। সেই সমস্ত বাসন আবার সকালে মাজা হয়। সাথে চলে হনুবাবুর চোদ্দ পুরুষের উদ্ধারকার্য। তাই প্রতিদিন সকালে উঠে হনুবাবু পড়ি কি মরি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। করোনা ভাইরাসের সৌজন্যে বাইরে সমস্ত যাতায়াত বন্ধ। বাড়িতে থাকা দায়। অগতির গতি এখন বাজার। এলাকায় তিনজন করোনা পজিটিভ ধরা পড়ায় বাজারে ভীড় কমেছে। হনুবাবুর সেসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। হনুবাবু রোজ অভিযানে বেরোবেন‌ই।
পটকা কমবয়সী ছেলে। দূর থেকে হনুবাবুকে হুপ হুপ করে খেপালেও সামনে ভদ্র ব্যবহার করে। সেই পটকা আজ হনুবাবুকে পাকড়াও করলো
– কী হনুবাবু ? রোজ রোজ বাজারে কী অত কেনেন ? বাজারে ফালতু ভীড় বাড়ালে কিন্তু পুলিশ ধরছে ।
হনুবাবু সগর্বে একহাতে বাজারের থলে ধরলেন। আর এক হাতে পকেট থেকে বার করলেন একটা পুরনো ধ্বসে যাওয়া প্রেসক্রিপশন।
পটকা অবাক হয়ে বললো
– এটা কী ?
হনুবাবু মুখ থেকে মাস্কটা থুতনিতে নামিয়ে বলল
– ডবল পোটেকশন । বাজারের থলে আর পেসকিপশন। পুলিশ আমার ধরবে ?!! কসুপোড়া !!
এখানে বলে রাখা দরকার। হনুবাবু আদ্যোপান্ত ঘটি। কিন্তু এই বাঙাল টানে কচুপোড়া বলাটা এমনভাবে রপ্ত হয়ে গেছে যে তার দশটা বাক্যের মধ্যে একটা কচুপোড়া থাকবেই। পটল-চিংড়ি খাওয়ার মাঝে যেমন চিংড়ি পাওয়ার লোভ। তেমনই হনুবাবুর সাথে কথা চালায় পাড়ার লোকে এই “কসুপোড়া ” কথাটা শোনার লোভে। শোনা হয়ে গেলে সিদ্ধিলাভ। পটকার‌ও হল সিদ্ধিলাভ। তবুও কথা এগিয়ে নিয়ে গেল
– বুঝলাম। কিন্তু,গুরু রোজ রোজ কোথায় যাও ?
মাস্কটা নাকের ওপরে সটান তুলে দিয়ে হনুবাবু বলল
– তোকে বলবো কেন রে ? পথ ছাড়। দেরী হচ্ছে।
পটকা আর কথা বাড়ালো না।
হনুবাবুর আজকে একটা গোপন অভিযান আছে। সোজা বাজারের পাশ দিয়ে খালি থলি দোলাতে দোলাতে সে পোস্ট অফিসের কাছে এসে থামলো। মনে মনে ভাবলো,বাড়িটা কাছেপিঠেই শুনেছিলাম। একটু তদ্বির করা যাক। একটু এগিয়ে গিয়ে একটা লোককে জিজ্ঞেস করলো
– দাদা কোনদিকে ?
লোকটি অবাক ।
– কী কোনদিকে ?
– আরে পেশেন্ট ,পেশেন্ট। করোনা পেশেন্ট।
– সে তো হসপিটালে ।
– বাড়িতে কেউ নেই। যদি একটু..
– সব্বাইকে নিয়ে চলে গেছে আলাদা রাখতে।
– তাহলে দেখা হবে না ?
– দেখা ? এ আবার দেখার জিনিস নাকি !!

দূর থেকে মজা দেখছিল সান্তু । সে হনুবাবুর মতো মানুষেরা যাদের আসল খোরাক। এগিয়ে এসে বললো
– আরে হনুদা না ? কী ব্যাপার এদিকে ?

প্রথম ভদ্রলোক সরে গেলেন।
হনুবাবু একটু এদিক-সেদিক দেখে ঘনিয়ে এলেন সান্তুর কাছে। তারপর কাঁচুমাচু হয়ে বললেন
– একটু দেখবে ভাই। খুব প্রয়োজন নিয়ে এসেছি।
সন্তু চট করে একটা বিড়ি ধরিয়ে দাঁতে বিড়িটা চেপে রেখে চোখ কুঁচকে বলে
– কেসটা কী ?
– ইয়ে মানে, একটু করোনা রোগীর সাথে আলাপ করতাম। একটু ত্রাণের ব্যাপারে কথা বলতে চাই।
– ত্রাণ !! যাদের হয়েছে তারা কত বড়লোক জানেন ?!! গরমের ছুটিতে লন্ডনে বেরাতে যায়। ওদেরকে আপনি ত্রাণ দেবেন ?
– ত্রাণ দেবো ? কসুপোড়া !! সে আমি জানি । ত্রাণ দেবো না। ত্রাণ নেবো ওদের থেকে ।
ফুসফুস করে দুবার ধোঁয়া ছেড়ে সন্তু বলল
– ব্যাপারটা একটু খোলতাই করো তো হনুদা। বুঝলাম না।
– আরে, সবাইকে কী সব বলা যায় ? তোমার পরিচয় থাকলে বলো। তোমাকেও নাহলে কিছু দেওয়া যাবে।
– পরিচয় তো ভালোই আছে। ওদের বাড়িতে কেবল লাইনের টাকা তো আমিই কালেকশন করি। মোবাইল নাম্বার‌ও আছে।
শেষ কথাটা বলে একটু বাঁ চোখটা টিপে দিল সন্তু। তারপর নিজেই হঠাৎ চমকে গেল। হনুবাবু হঠাৎ সন্তুর হাঁটুর কাছে নেমে গেছেন গুটিয়ে।
– ভাই, দয়া করে একটু নাম্বারটা দাও ভাই। একটু উপায় করে দাও ।
কেবল অফিসের ক্যাশ কালেক্টর সন্তু কোনদিন এত দাম পায়নি। বেশ বিজ্ঞের মত ভাব করে বলল
– হুম,দেবো দেবো। কিন্তু, ব্যাপারটা আমাকে আগে বলো ।
হনুবাবু এদিক-ওদিক দেখে বলল
– ওদের থেকে সমস্ত ভাইরাসগুলো নিতাম । যেভাবে মেলে চেষ্টা করতাম। ওদের এঁটো খাবো। ওরা হাঁচবে- কাশবে আমি মাস্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো ।
– ওহ্ এবার বুঝেছি। তুমি করোনা রোগ নিয়ে সরকারের থেকে ত্রাণের অর্থ চাইবে।
– ধুত্তোর !! কসুপোড়া! শোনোই না। ওই করোনা রোগে ধরলে আমার লাভ‌ই লাভ। ধরা পড়লে চোদ্দো দিন পগাড় পাড়। আমার গিন্নি আমার টিকিটাও খুঁজে পাবে না।
– আরে তোমার গিন্নীর‌ও তো করোনা হয়ে যাবে।
– তাহলে তো আরো লাভ। গিন্নীকে তুলে নিয়ে যাবে কম করে তিন সপ্তাহের জন্য। বিয়ের পর থেকে কোনদিন এমন শান্তি পাইনি। বাপের বাড়িতে গেলে মেরেকেটে দুদিনের সোয়াস্তি। তারপরেই ব্যাক টু হাড়িকাঠ ।
– আর দুজনের কেউ মারা গেলে ?
আনন্দে দুটো হাত ওপরে তুলে হনুবাবু বলল
– আমি টসকে গেলে তো রক্ষে পাবো। ওপরে গিয়ে ধিরিঙ্গি নাচ নাচবো । জয় মা কালি !
– আর যদি গিন্নীর কিছু হয় ?
– কসুপোড়া !! গিন্নীর সুগার,পেশার,খাইরয়েড সব আছে। যমদূত রোজ আসে। তারপর গিন্নীর ওই হিড়িম্বাপানা চেহারা দেখে হজমোলা খেয়ে পিঠটান দেয়। তবে হ্যা, করোনার তো দেখছি মাথায় অনেক শি‌ং। যমদূতের মাথায় মাত্র দুটো। কিছু হলেও হতে পারে। আর হলেই লটারি।
তাই তো বলছি ভাই যদি একটু আলাপ করে দিতে।

– ও হরি ! এই কেস । তাই বলো। আচ্ছা এইবার আগে একটা কাজ করো ।
– কী কাজ বলো ভায়া ?
– ত্রাণকার্যের প্রথম ধাপটা সেরে ফেলো ।
– সেটা কীরকম ?
– আমাকে পাঁচশো টাকা দাও। কিছু খবর পেলেই জানাবো।
– কসুপোড়া !! কোথায় থাকো হে ? খবর জানানোর পাঁচশো টাকা ! তোমাকে লাগবে না । আমি নিজেই দেখছি কী করতে পারি।
– দেবে না ? আচ্ছা,তাহলে খবর না জানানোর দাও ।
– মানে ? হেঁয়ালি করো না তো ভায়া ।
– মানে,এসব খবর তোমার গিন্নীকে জানিয়ে দিলে কি ভালো হবে। তাই না জানানোর জন্যে পকেট থেকে সুরুৎ করে একটা খসাও দেখি ।
– ব্ল্যাকমেইল ?!!
– ধুস্ ! কী যে বলো না হনুদা। সবে মদের দোকান খুলেছে। গলা মদের তেষ্টায় ফেটে যাচ্ছে। দু-পাত্তর ঢালবো রাতে। চাইলে তুমিও আসো সবুজ সংঘে ।
বিড়বিড় করে বললেন হনুবাবু
– সবুজ সংঘ না ছাই !! অবুঝ সংঘ !
– কিছু বললে ?
– কসুপোড়া !! কখন কী যে বলি খেয়াল করতে পারিনা। তোমরা আমার ভাইয়ের মতো। আবদার করে খেতে চাইছো । হে হে… এই নাও হাজার টাকা। পাঁচশ টাকা খবর জানানোর। আর পাঁচশ খবর না জানানোর। তাড়াতাড়ি কোরো ভায়া। বড় কষ্টে আছি।

হাজার টাকা খুইয়ে বাজারের খালি ব্যাগ নিয়ে হনুবাবু ফিরলেন বাড়িতে। যেন ছাগল ফিরল বাঘিনীর খাঁচায়। প্রাণ হাতে করে।
গিন্নী খালি ব্যাগ দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ল
– বলি, সক্কাল সক্কাল কী বাপের মতো গ্যাজা খেয়ে বাজারে গেছিলে ? খালি ব্যাগ নিয়ে ফিরে এসেছ কেন ?!!
– আর বলো না গিন্নী। বাজারের মোড়ে পুলিশে ধরলো। বললো রোজ রোজ বাজারে আসেন বলে গ্রেফতার করবো ।
– ওহ্ মা !!
– আমি বললাম,না গিন্নীকে ছেড়ে আমি থাকবো না।
– তারপর ?
– তারপর আর কী ! কসুপোড়া ! হাজার টাকা ফাইন নিয়ে ছাড়লো।
– যাঃ … সকালেই দন্ড চলে গেল এত টাকা ! কাল থেকে তোমার বাজার যাওয়া বন্ধ। যা করার আমিই করবো। বুঝলে ?
– না বুঝে আর যাই কোথায় !
– হ্যা, তাই ভালো ।
হনুবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। যাও বা সকালে একঘন্টা একটু বাজারের নামে বাড়ির বাইরে থাকতেন ,কাল থেকে সেটাও বন্ধ।
প্রদীপ্ত দে
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।