— ওরে পোড়ারমুখী তোর বাপের এত ক্ষ্যামতা
যে আমার পিছনে খোঁচাস? মরবি মরবি সব ওলাউটা হয়ে মরবি! এই আমি এক বেধবা স্ত্রী আজ শাপ দিই তোর বংশ ধংস হয়ে যাবে – বাতি দ্যাবার নোক পাবিনি -এই কথা বলে রাখলুম – হুম!
বারো বছরের কন্যা সুকুমারী দৌড়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। ভয়ে আর লজ্জায় ঘরে খিল তুলে দেয়। মা ভিতরেই ছিল, আওয়াজ পেয়ে চলে আসে –
— কি হয়েছে রে সুকি ? বুড়ি কেন গালি পাড়ছে রে ? তুই কি কিছু করেছিস ?
— না , মা আমি আর রহমান বাইরে খেলছিলাম। কোথা থেকে একটা ইঁট এসে ওঁর ঘরের চালে পড়লো আর উনি আমাকেই গালি দিতে থাকলেন।
— বুঝেছি। থাক ওদিক পানে আর যাস না। রহমনকে বলে দিবি বাড়িতে এসে খেলতে।
— আচ্ছা মা।
মা আনন্দময়ী ভাবে এই বুড়িকে নিয়ে কি করা যায়? পাশে থেকে সব সময়ে গালিগালাজ শাপশাপান্ত করেই চলেছে। বাবা জগমোহন জুটমিলে কাজ করেন। বাড়ি ফিরতে আনন্দময়ী বললে —
— হ্যাগো এ বুড়ি যে গালাগালি খুব বাড়িয়ে দিয়েছে। কিছু একটা করো?
জগমোহন কি করবে ভেবে পায় না। রহমানের বাবার সঙ্গে মিলে কাজ করে। ওর সঙ্গেই কথা বলে।
রহমানের বাবা মহিউদ্দীন কথা গুলো শুনে চুপ করে থাকে। কোন উত্তর দেয় না। জগমোহন চাপ দেয় কিছু একটা না করলেই যে নয়!
মহীউদ্দীন রহমানের হাতটা চেপে ধরে —
— থাকনা -ও একটু –ওকে একটু মেনে নাও — ওকে না ঘাঁটালেই হলো। ও আর কদিন বাঁচবে? আমি বলছি শোনো ওর গালিতে কিছুই হবে না।ও আসলে পাগলী! শকুনের অভিশাপে কি গরু মরে?
জগমোহন কথাগুলো মানে। কিছু বলতে পারেনা। আবার মহীউদ্দীনের এইরকম আচরণের কারণ বুঝে উঠতে পারে না। স্ত্রী আনন্দময়ীকে সব বুঝিয়ে বলে।
একদিন মিলে কাজ করার সময় মহীউদ্দীনের হাত মেশিনে আঁটকে যায়। সে এক ভয়ানক অবস্থা! হসপিটালে অপারেশন শুরু হয়। হাত বাদ যায়। কিন্তু প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় ওর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। কিছু রক্ত পাওয়া যায় কিন্তু তাতে জীবন সংকুলান হয় না। আরো রক্তের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, কিন্তু কারোরই রক্ত গ্রুপ মেলে না। কি হয়! কি হয়!
সবাইকে অবাক করে পাগলী বুড়ি হসপিটালে পৌঁছে যায়। রক্ত দিতে চায়। ডাক্তার সময় নষ্ট করতে চায় না। গ্রুপও মিলে যায়। বুড়ির মতে রক্ত নেওয়া হয়, যদিও ডাক্তারের একটু সংশয় ছিলো এই বয়সী মহিলার রক্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে। কিন্তু বুড়িমহিলার উপযুক্ত স্বাস্থ্য ছিল এবং তার পেড়াপিড়িই এখানে কাজ করে। বুড়ির এই আচরণে সব্বাই তাজ্জব বনে যায়। বুড়ি রক্ত দেওয়ার পর অসুস্থ হলে তাকে মহীউদ্দীনের পাশের বেডেই ভর্তি করতে হয়।
তিনদিনের মাথায় মহীউদ্দীনের জ্ঞান ফেরে। একটু ভালো হয়। সব কথা শোনে।
কিন্তু পাশের বেডে থাকা সেইদিনই অসুস্থ বুড়ি মারা যায়।
পাগলী বুড়ি একটা ভালো কাজ করে গেল -এই কথাই সবাই মেনে নিল।
মিল কর্তৃপক্ষের সহানুভূতির জেরে গার্ডের কাজ পায় মহীউদ্দীন। ছেলে রহমান কে নিয়ে বাঁচতে পারবে সে।
একদিন বন্ধু জগমোহনকে আর তার স্ত্রীকে ঘরে ডাকে কিছু বলার জন্য। দুজনায় আসে।
মহীউদ্দীন শান্ত। ধীরে ধীরে শুরু করে —
— দুঃখ দিতে চাই না। ভুল বুঝো না। পুরানো কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি একটাই কারণে। সুকুমারীকে আমি তোমাদের মানুষ করতে দিয়েছিলাম -বলেছিলাম আমার পরিচিত একজনের মেয়ে। আমি মিথ্যা বলেছিলাম। যখন দেখলাম তোমাদের সন্তান সন্ততি হওয়ার আর কোন সম্ভাবনা নেই, তখন আমি তোমাদের মিথ্যা কথা বলেছিলাম। আজ সত্যি কথাটি বলি, সুকুমারী আমারই মেয়ে আর ওই বুড়ি আর কেউ নয় ও ছিলো আমার জন্মদাত্রী মা!
জগমোহন আর আনন্দী জানতো তাদের অসহায় অবস্থায় মহীউদ্দীন সুকুমারী কে এনে দিয়েছিল নিঃশর্তভাবে। তখন ওরা একটি শিশুকে পেয়ে আর বেশি ঘাঁটায়নি। কিন্তু আজ এই দুটি কথা জেনে অবাক হয়ে গেল। এক – সুকুমারী মহীউদ্দীনের মেয়ে আর ওই বুড়ি পাগলী ওর মা।
মহীউদ্দীন কাঁদে —
— তোমরা যাকে পাগলী বলে জানতে আসলে সে পাগল হয়ে গেছিল আমার জন্যই। সুকুমারীকে গালি দিত আমার উদ্দেশ্যেই। আসলে তো আমিই ওর বাপ! প্রথম ছেলে রহমান। দ্বিতীয় সন্তান হল কন্যা কিন্ত জন্ম দিয়েই আমার স্ত্রী রুলা মারা গেল। তখন আমার মা আমার সঙ্গেই থাকতো। আমি মায়ের অমতেই এই কন্যাশিশুটিকে তোমাদের দিতে চাওয়ায় গন্ডগোল বাঁধে। আমি মাকে ওষুধ খাইয়ে নিস্তেজ করে রেখে দিতে চেয়েছিলাম। কারণ আমি বুঝেছিলাম মা মরা এই কন্যাসন্তানকে মানুষ করতে পারবো না। তোমাদের ও কোনদিন কিছু বলিনি। তুমি একদিন ওই পাগলীর কথা বলেছিলে — মনে পড়ে — আমি চুপ করে গেছিলাম — মনে পড়ে —— ?
বলেই অঝোরে কাঁদতে থাকে মহীউদ্দীন।
জগমোহন আর আনন্দীও কেঁদে ফেলে —
বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে। অঝোর ধারায় জল পড়ছে। এই অসহনীয় গরমে এই বৃষ্টি এক শীতল আমেজে ভরিয়ে দিচ্ছে মন প্রান! আজ মহীউদ্দীন অনেক হালকা হয়ে গেছে সব বলে দিয়ে আবার জগমোহন আনন্দীও সব জেনে সব শুনে কৃতজ্ঞ! শুধু অবুঝ দুই কিশোর কিশোরী রহমন আর কিশোরী সুকুমারী কোন কিছু না জেনে, খুশিতে সেই বারিধারায় নিজেদের ভিজিয়ে নিচ্ছে এক অনাবিল আনন্দে!