বিশ্বাস করবে না কেউ জানি, অবিকল শিউলি রঙা একটা ভোরকে ফুটতে দেখলাম আজ। চম্বল নদীর কালো জল; জলের ওপর ঝুঁকে থাকা গাছগুলোও অন্ধকারে ঝাপসা। শুধু আকাশে অদ্ভুত সাদাটে আলো। আমার হাতে ক্যামেরা নেই। মোবাইল ইচ্ছে করেই ঘরে রেখে এসেছি। এসেছি অনিতাদিদির সাথে তর্পণ দেখব বলে। কিন্তু এই অপূর্ব, অবর্ণনীয় কনট্রাস্ট কে ধরে রাখবে, এমন ক্যামেরা কোথাও ই কি আছে! এর পরের ম্যাজিকটা আরো আশ্চর্য। দুই বিশাল মেঘের ফাঁকে ঠিক শিউলি বোঁটার মত একটুখানি সূর্য। অনিতাদিদির চোখে শিশির অশ্রু।
শিউলি কুড়োনোর দিন এখন অনেক দূরে। আক্ষরিক অর্থেই। আরে, নিখাদ পল্লীবালিকাই তো ছিলাম । সত্যিই। `শিউলিতলায় ভোরবেলায়, কুসুম কুড়ায় পল্লীবালা’ – কি শিউলিই যে কুড়িয়েছি একসময়! আমাদের গ্রীলদেওয়া বারান্দার পাশেই ঝাকড়া শিউলি গাছ। প্রতি বছর ডালপালা ছেঁটে দিত দাদু। তবু ফুল ফোটাতে কৃপণতা করেনি কোনোদিন গাছটা। `শেফালি পুলকে ঝরে পড়ে সুখে, খোঁপাতে চিবুকে – ‘ শিউলিও ঝরত, শুঁয়োপোকাও। শুঁয়োপোকার বাসা ছিল গাছটাতে। কতবার লেগেছে হাতে, পায়ে, গালে, গলায়। তাতে কি! অন্য কোন ফুল মাটিতে পড়লে কুড়োতে দিত না মাম, আমার ঠাকুমা। কিন্তু শিউলির বেলায় সাতখুন মাপ। আজকালের পোলাপানেরা পেত্যয় যাবে না, আমরা কিন্তু শিউলি বোঁটা দিয়ে কাপড়ও ছুপিয়েছি। পুতুলের অবশ্য। `দিও উত্তরীয় শিউলি বোঁটার রঙে ছোপাতে’ – গান তো শিখেছি অনেক পরে। নদীর পাড়, অনিতাদিদির তদগত মুখ, তর্পণের মন্ত্র সব মিলে কেমন মনে হল, জীবন বোধহয় কেড়ে নেয় না কিছুই। ফেরায় আবার কোন না কোন ভাবে। সেই ফুল কুড়োনোর দিন আর ফিরে পাবো না জানি, কিন্তু এমন একটা ভোরকে তো পেলাম। কোন পুণ্যবলে, কে জানে!
দিন শুরু হবে এক্ষুণি। হালকা মেঘ আকাশে। বঙ্গদেশে নাকি বৃষ্টির সম্ভাবনা। এখানে পরিস্কার দিন। কাল বাদে পরশু থেকে নবরাত্রি। তোরজোর শুরু হয়েছে তার। আমার ভেতরেও আগমনীর আলোর বেনু বেজেছে। এতকিছুর মধ্যে এই একটুখানি শিউলি ফোটার মুহুর্তটা বেঁচে থাকবে তো! আমিও তো তর্পণ করলাম আজ। মোহের তর্পণ। বাসনার। কিছু অবাধ্য স্মৃতির। ভাল থাকতে বললাম ওদের। পৃথিবীকে ও। আকাশ, বাতাস, জল, আলো – সবকিছু মধুময় না হলে, আমার সেই শিউলি ফোটা ভোর কে হারিয়ে ফেলব যে!