কর্ণফুলির গল্প বলায় প্রকাশ চন্দ্র রায়

নষ্ট হওয়ার কষ্ট

সুচেনাকে ভালবাসতাম খুব,ঘন ঘন কাছে আসতাম। সুচেনার প্ররোচনায় হঠাৎ একদিন নষ্ট করে ফেললাম ওকে। ঘটনার আকস্মিকতায় সুচেনা খুব খুশি হল আর আমি আহাম্মক বনে গেলাম। অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়ে,কাতরস্বরে বললাম,

-সুচেনা,আমি ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ।

খিল খিল করে হেসে উঠলো সে! বলল,

-আমি খুশি হয়েছি,সমৃদ্ধ হয়েছি তোমার ছোঁয়ায়।

-এ পাগল বলে কী রে!
পাপবোধে বিদ্ধ মন। কী করি এখন?

লাজ-লজ্জা ত্যাগ করে মা’কে বললাম,

-মা,আমি নষ্ট হয়ে গেছি,নষ্ট করেছি সুচেনাকে।

বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে ভেবে দেখে, মা বলল শেষে,

-বেশ করেছিস! যা সুচেনাকে বিয়ে করে আন।

ছুটলাম সুচেনার কাছে।
বাড়িতে কেউ নেই,সুচেনা একা। বললাম,
-মা তোমাকে বিয়ে করতে বলছে সুচেনা।
আবার খল খল করে হেসে উঠলো সে! হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরলো আমাকে,নষ্টের খেলায় মত্ত হতে চাইলো পুনরায়! হাত ছিটকে পালিয়ে এলাম ঘর থেকে।

পথে দেখা হলো সুচেনার বড় ভাইয়ের সাথে। বললাম,

-ভাইসাব,সুচেনাকে ভালবাসি,ওকে বিয়ে করতে চাই।

কথা শুনে ভীষণ ক্ষেপে গেলেন ওর গুণ্ডাভাই! ক্ষিপ্ত হয়ে মারতে শুরু করলেন আমাকে,লাথি-ঘুষি মারতে মারতে একটা ধাক্কা মারলেন প্রচণ্ড জোরে। রাস্তার পাশে একটা বাড়ীর বাউণ্ডারি দেয়ালে মাথা ঠুকে গেল আমার,ধুপ করে পড়ে গেলাম মাটিতে-আর কিছু জানি না।

পাগলা-গারদ থেকে ফিরে আসার বছরতিনেক পরেও ঠিক হয়নি আমার বিকৃতমস্তিস্ক। কোথায় থাকি,কোথায় যাই,ঠিক-ঠিকানা নেই তার। মা মারা যাওয়ার ছ’মাসের মাথায় বাড়ীঘর নাকি উচ্ছন্নে গেছে,জমি-জমা সব ভাগাভাগি করে নিয়েছে আত্মীয়-স্বজনরা। এসব তথ্য পাই পাড়ার হিতাকাঙ্ক্ষী কারো কারো কাছ থেকে,যখন মাথার গণ্ডগোলটা একটু কম থাকে। যখন বাড়াবাড়ি হয়ে যায়,তখন কাউকে চিনি না,মানি না,কোথায় যাই,কী করি,কী খাই কিচ্ছু জানি না। গোল্লায় গেছে সাহিত্যচর্চা-কবিতা,গল্প লেখা-লেখি সব। সুচেনা’রা অচেনা হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। খুববেশি অচেনা’রা থু-থু ছিটায়,ইট-পাটকেল ছুঁড়ে মারে। তবুও মাঝে মাঝে গান গাই-পাগল মন,মন রে,মন কেন এত কথা বলে রে? পাগলা সোহাগের গান শুনে হাসে সবাই।

আজ মাথাটা একটু পরিস্কার হতেই পড়তে পারলাম রাস্তার ধারের বড় সাইনবোর্ডটা। বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে “সুরভী-উদ্যান”রংপুর। স্মৃতিগুলো হুড়মুড় করে জেগে উঠতে লাগলো মনে! ঐ তো সামনে পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়! তারপরে শহীদ মিনার আর টাউন হল!যেখানে বড় বড় সব সাহিত্য-সম্মেলনে উপস্থিত থেকে কবিতা আবৃত্তি সহ নানারকম সাহিত্য আলোচনায় অংশগ্রহন করতে হতো বছরে কয়েকবার।

সুরভী উদ্যানের পিছনেই সরকারী কলেজ।
আহ্! কলেজ জীবনের স্মৃতিগুলো উঁকি ঝুঁকি মারছে বারবার!

একছুটে ঢুকে পড়লাম উদ্যানের ভিতর,এখানেই তো প্রথম প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল সুচেনা। একই পাড়ায় বাড়ী বিধায়,একই কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম দু’জনে। ও ফার্স্ট ইয়ার আর আমি থার্ড ইয়ার অনার্স।

উদ্যানে ঢুকে জোড়ায় জোড়ায় প্রেমিক-প্রেমিকাদের দেখে নিজের দিকে নজর দিলাম। আহা!চেহারা’র কী ছিরি! তিনবছর আগে পরিহিত জামা-কাপড় সব ধূলোয়,ময়লায় কেমন বিচ্ছিরি হয়ে গেছে,স্নানাহারের অনিয়মিততা হেতু কঙ্কালসার দেহ থেকে লাবণ্যরা বিদায় নিয়েছে,চুল-দাঁড়িতে আশ্রয় নিয়েছে উকুনের দল। বড় সাধ জাগলো আয়নায় চেহারাটা দেখি,আজ কতদিন থেকে যে দাঁড়াইনি আয়নার সামনে,তার হিসেব জানি না! হাঃ হাঃ করে অট্টহাসি হেসে উঠলাম অজান্তে।

সামনের বেঞ্চে বসে বাদাম খেতে মগ্ন প্রেমিক যুগল চোখ তুলে তাকালো,আমিও তাকালাম ওদের দিকে,কিন্তু একি! এ-যে সুচেনা! ভাল করে তাকালাম আবার,সুচেনা’ই তো! পাশের যুবককে চেনা গেল না। আবেগের লাগাম টানা গেল না আর!

-সুচেনা-সুচেনা!
দৌড়ে গেলাম ওদের কাছে,
-সুচেনা-সুচেনা!

ওর প্রমিক জমানো বাদামের খোসা সব ছুঁড়ে মারলো আমার চোখে মুখে। ভ্রক্ষেপ করলাম না,ছুঁ’তে চাইলাম সুচেনাকে,
ছিঃছিঃ করে উঠলো সে। বাহাদুরি দেখাতে কষে লাথি মারলো যুবক! ব্রহ্মতালু’র নার্ভগুলো বিগড়ে গেল আমার। জ্ঞান হারানোর প্রাক-মুহুর্তে শুনলাম,যুবক বলছে
-কে এটা?
ঘৃণামিশ্রিত উত্তর সুচেনা’র,
-আমাদের পাড়ার, পাগলা সোহাগ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।