মা দিবস স্পেশাল – এ পায়েল চট্টোপাধ্যায়

সামডে সামওয়ান উইল ফাইন্ড অ্যা মেমোরিয়াল মাদার্স ডে’

“অ্যা প্রিন্টেড কার্ড মিন্স নাথিং একসেপ্ট দ্যাট ইউ আর টু লেজি টু রাইট টু দ্যা ওম্যান হু হ্যাজ ডান মোর ফোর ইউ দ্যান এনি ওয়ান ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।”

মাদার্স ডে-এর কমার্শিয়ালাইজেশনের চেষ্টা চলছে তখন। এই মাদার্স ডে যাঁর হাত ধরে শুরু হয়েছিল তাঁর প্রতিবাদের ভাষা ছিল এটা। আর্থিক কোনো বিনিময়ের বাইরে একটা আলো মাখানো দিন হিসেবে উদযাপন শুরু হয়েছিল মাতৃ দিবস বা মাদার্স ডে-র। যে দিনে কোন কিছু দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকবে না, আড়ম্বরহীন অনুভূতিতে মাখানো স্নেহ ছাড়া।

আমেরিকার সমাজকর্মী ছিলেন অ্যান মেরি রিভস। শিশু মৃত্যু, অসুখের কবল থেকে মুক্তি, এসব নিয়ে কাজ করছেন অ্যান মেরি রিভস। সমাজের অন্ধকার সরানোর কাণ্ডারী। মেয়ে অ্যানা জার্ভিস তখন কিশোরী। এক মনে মাকে দেখত অ্যানা। কি অসামান্য মনোবল তাঁর। লড়াকু। হার-না-মানা মনোভাব। মায়ের বয়স বাড়ছে। এদিকে সময় স্রোতে পৌঢ়ত্বে পৌঁছেছেন মা।

কিন্তু সময়ের স্রোতে অনেক কিছু হারাতে হয়েছিল মাকে। একের পর এক সন্ততি হারিয়েছেন বৃদ্ধা। অ্যানাও বড় হচ্ছে। মায়ের গলায় আক্ষেপ। এত কিছু করেও কোথাও যেন অবহেলিত মায়েরা। উপেক্ষার পাত্রী! অনায়াসে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড ধরে নেয়া যায়। তবুও অ্যানার মা যেন আলোর প্রতিমূর্তি। সন্তান হারিয়েও শোকে গুটিয়ে নেন না নিজেকে। কষ্ট বেয়ে প্রার্থনা বেরিয়ে আসে। বৃদ্ধা একদিন আবেগের বশে বলেছিলেন’ “সামডে সামওয়ান উইল ফাইন্ড এ মেমোরিয়াল মাদার্স ডে”। কথাটা কানে এসেছিল অ্যানার। অ্যানা তখন তরুণী।

১৯০৫ সালের ৯ই মে। পৃথিবী থেকে চলে যান অ্যান মেরি রিভস। অ্যানা জার্ভিসের মা। আমেরিকার গ্রাফটন শহরের অ্যান্ড্রুজ উইলিয়াম চার্চে প্রয়াত সমাজকর্মী সেই বৃদ্ধার স্মৃতিতে বাহাত্তরবার ঘণ্টাধ্বনি বাজে সেদিন। কিন্তু মেয়ের মন কী শান্ত হয়েছে? মেয়ের মনে অনবরত বেজে চলেছে মায়ের গলার সেই আক্ষেপ? মায়ের সেই প্রার্থনা। মায়ের কথার সুর যেন আকাশে-বাতাসে সুবাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। শান্তি পাচ্ছে না মন। শান্তির খোঁজে অ্যানা ছুটে যান মায়ের গ্রেভস্টোনের কাছে। অ্যানার মনে হয় একটা রঙিন প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে আশেপাশে। প্রজাপতিটার নাম কি? মায়ের স্বপ্ন। অ্যানা কথা দেয়। কাকে? নিজেকে। নিজের আত্মাকে আর মাকে।
‘বাই দ্য গ্রেস অফ গড ইউ উইল হ্যাভ দ্যাট মাদারস ডে’।

শুরু হয় এক তরুণীর লড়াই। মায়ের সঙ্গে কাজ করা সকল সমাজ কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অ্যানা। তাঁর সঙ্গ দিয়েছিলেন বন্ধুরাও। রাজনৈতিক শীর্ষ পদে থাকা সকলের কাছেই চিঠি পাঠায় ওঁরা।‌

১৯১৪ সালে জয় হলো অবশেষে। প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ঘোষণা করলেন মাতৃ দিবসের জাতীয় ছুটি। শান্ত হল অ্যানা জার্ভিসের মন। সেই প্রথম শুরু হয়েছিল মাতৃ দিবস পালন। তারপর বিভিন্ন দেশে তার প্রসার ছড়িয়ে পড়ে। অনেক দেশ নিজের ইচ্ছে মত দিন বেছে নেয় মাতৃ দিবস পালনের জন্য। ভারতে এখনো মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার পালিত হয় মাতৃ দিবস।

কিন্তু অ্যানার কী হল? লড়াই শেষ হয়েছিল? জাতীয় ছুটি ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে কোথাও যেন মাতৃ দিবসের সঙ্গে বিজ্ঞাপন, বিপণন, বাণিজ্যিকীকরণের গন্ধ জুড়ে গেল। অ্যানার মন বিক্ষিপ্ত। তাঁর মা চেয়েছিলেন আড়ম্বরবিহীন একটা সাদামাটা দিন। ঠিক সাদা ফুলের মত। মায়ের প্রিয় ফুল। সাদা কার্নেশন ফুল। মাতৃ দিবসের গায়ে অনাবশ্যক বাহুল্যতার মোড়ক লেগে যাচ্ছে। এসবের মধ্যে স্পষ্ট অন্ধকার দেখতে পেতেন অ্যানা জার্ভিস। কষ্ট হতো তাঁর। কষ্ট হলেই মায়ের গোলাপি বিছানার কাছে দৌড়ে যেতেন অ্যানা। খোলা জানালার মত শান্তি পেতে। কিন্তু কমার্শিয়ালাইজেশন বন্ধ হয়নি এতে। বিজ্ঞাপন, কার্ড, ফুল সব মিলিয়ে বাজার ধরার চেষ্টা।

অ্যানা প্রতিবাদ করা শুরু করেন। ব্যবসায়ীরা প্রমাদ গোনে যথারীতি। এমনকি কার্ড বিক্রির প্রফিটের ভাগও দিতে চাওয়া হয়েছিল। তীব্র রাগে, ক্ষোভে হতাশায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন অ্যানা।

১৯৪৩ সালে আবার লড়াই শুরু হল। অ্যানা জার্ভিস পিটিশন দাখিল করলেন। মাতৃ দিবস বন্ধ করার চিঠি। নিজের বোন লিলিয়ানের সঙ্গে একা থাকতেন তিনি। বোন অন্ধ ছিল। কার্বন-মনোক্সাইড বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয় লিলিয়ানের। হতাশা পাথরের মত চেপে বসতে থাকে অ্যানার মধ্যে। ক্রমশ অন্ধকারে ডুবতে থাকে তাঁর মন। ফুল আর কার্ডের ব্যবসা তখন রমরমিয়ে নিয়ে চলছে। উৎসবের নামে অনাবশ্যক আড়ম্বর। হারিয়ে যাচ্ছে ফুলের মত সাদা দিন। মাতৃ দিবসের দিনের গায়ে যেন অ্যানার কষ্টবিন্দু জড়িয়ে ধরছে। কেউ খোঁজ রাখছে না তবে। কিন্তু ফ্লোরাল ইন্ডাস্ট্রির লোকেরা অ্যানার জীবনের শেষ কটা দিনের হাসপাতালের খরচ নিয়মিত দিয়ে যেত। থাকুক কোটরে বন্দি হয়ে। নইলে বেরিয়ে এসে আবার যদি আন্দোলন করে! ব্যবসার কী হবে তাহলে! ১৯৪৮ সালের ২৪শে নভেম্বর ৮৪ বছর বয়সে মারা যান অ্যানা। গ্রাফটনের সেই অ্যান্ড্রুজ চার্জ। সেই ঘন্টাধ্বনি। মায়ের কাছে ঠাঁই হয়েছিল অবশেষে। আজো উৎসবের মতো করে পালন হয় মাতৃদিবস। কার্ড। ফুল। উপহার। সব মিলিয়ে একটা রঙিন দিন। আড়ম্বরে পরিপূর্ণ। শুধু কার্নেশন ফুলের দেখা মেলে না। এই দিন নির্মাণের স্রষ্টা হয়তো তখন চোখের জল ফেলেন অন্তরীক্ষে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।