T3 || কোজাগরী || বিশেষ সংখ্যায় পায়েল চট্টোপাধ্যায়

অবগুণ্ঠনবতী

জীবনের ভেতর জীবন। মনের ভেতর মন। খোঁজ পাই আমরা? বা চেষ্টা করার অবকাশ মেলে? কখনো হয়তো খোঁজ পেতে পেতে পার হয়ে যায় দিগন্ত! জীবন সায়াহ্নে এসে আলোর দেখা মেলে।

কয়েকশো বছর আগেকার কথা। শিক্ষার অধিকার তখন ছিল শুধু পুরুষদের। এক কিশোরীর ভাইদের পড়াতে এসেছেন মেমসাহেব। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে শেখাচ্ছেন তাদের। ভাইদের সঙ্গে থাকার জন্য সেই কিশোরীকেও পাঠানো হয়েছে শিক্ষা-কক্ষে। কিন্তু উদ্দেশ্য অন্য। সাংসারিক কাজে ব্যস্ত মা ওই সময়টুকু মেয়েকে ভাইদের সঙ্গে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন। এদিকে সেই কিশোরীর চোখ ভেদ করে নানা গ্রন্থ-পাঠ পৌঁছে যায় অন্তরে। পড়াশোনা করার অধিকার নেই তার। তবে আগ্রহ প্রবল। শেখা চলতে থাকে। আলোকিত হতে থাকে সেই কিশোরীর অন্তর। যদিও সাহিত্যজগতে সেই আলো পৌঁছতে অনেক সময় লেগেছিল। তাঁর আত্মজীবনী যখন প্রকাশিত হয় তখন তিনি ষাটোর্ধ্ব নারী। প্রথম আত্মজীবনীমূলক রচনা যাঁর কলম হয়ে সাহিত্যজগতে আসে তিনি এক নারী। রাসসুন্দরী দেবী। গ্রন্থের নাম ‘আমার জীবন’।

নারীকে লেখাপড়া শেখানোর প্রয়োজন যখন সমাজ অনুভব করতে শুরু করে, সেই ভাবনাতেও ছিল পুরুষতান্ত্রিকতা। শিক্ষিত স্বামীর পাশে ‘সাজ’ বাড়ানোর মত শিক্ষিতা ‘স্ত্রী’। তার আগে পর্যন্ত নারীরা মূলত ধর্মগ্রন্থ পাঠের লক্ষ্যেই পড়াশোনা শিখতেন। রাসসুন্দরী দেবীও এই কারণেই লেখাপড়া শিখেছিলেন। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়।

১২১৬ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে রাসসুন্দরী দেবীর জন্ম। পরিবারে পড়াশোনার চর্চা থাকলেও মেয়ে হওয়ার ‘সুবাদে’ নিজেকেই নিজের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিতে হয়েছিল। বারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় রাসসুন্দরীর। তখন তিনি রাসসুন্দরী দাসী। শ্বাশুড়ি স্নেহ করতেন তাঁকে। বিয়ের পর প্রথম কিছু বছর সাংসারিক দায়ভার সামলাতে হয়নি সেভাবে।

তবে শ্বাশুড়ির অসুস্থতা নাবালিকা কিশোরীকে এনে ফেলল সংসারের বেড়াজালে। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের আসা যাওয়া লেগেই থাকত। একেক দিন দশ সের চালের ভাত রান্নাও করেছেন নাবালিকা বৌমা। নিজের আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন “তখন মেয়েছেলেরা লেখাপড়া শিখিত না, সংসারে খাওয়া-দাওয়ার কর্ম সারিয়া যে কিঞ্চিৎ অবকাশ থাকিত, তখন কর্তাব্যক্তি যিনি থাকিতেন, তাঁহার নিকট অতিশয় নম্রভাবে দণ্ডায়মান থাকিতে হইত। যেন মেয়েছেলের গৃহকর্ম বই আর কোন কম্মই নাই।”

আত্মজীবনীতে তিনি নিজেকে বারবার গৃহ-বন্দিনী বলেছেন। আড়ালের জীবন বা জীবনের আড়াল। মোটা কাপড়ে বুক পর্যন্ত ঘোমটা দিয়ে ঢেকে সব কাজ করতেন। তাঁর শব্দমালায় বারবার উঠে এসেছে আক্ষেপের কথা। ‘মেয়ে-জীবনে’র বঞ্চনার কথা। নারীদের হাতে কাগজ দেখলেও অসন্তোষ-এর শিকার হতে হয়েছে।

পড়াশোনার আগ্রহ থেকেই লেখাপড়া শিখতে চেয়েছিলেন’ রাসসুন্দরী। পরিস্থিতি বিপ্রতীপ। একবার স্বপ্নে দেখেছিলেন চৈতন্য ভাগবত পাঠ করছেন। পরের দিন প্রসন্ন মন নিয়ে দিন শুরু করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, এ যেন ঈশ্বরের আদেশ। তখন তিনি বিবাহিতা। ভাগ্যক্রমে হাতে পেলেন ‘চৈতন্যভাগবত’ গ্রন্থ। অথচ চেনেন না অক্ষর। বইয়ের একটি পৃষ্ঠা রেখেছিলেন রান্নাঘরে। অক্ষর চেনার জন্য বড়ছেলের তালপাতায় লেখা একটি পৃষ্ঠাও লুকিয়ে রাখলেন। তারপর দুই পাতা মিলিয়ে বহুকষ্টে পড়ে শেষ করেছিলেন ‘চৈতন্যভাগবত’। আর খানিকটা অক্ষর-শিক্ষা হয়েছিল ভাইদের পড়াশোনা দেখে।

স্বাদ পেয়েছিলেন অক্ষরমালার। মুগ্ধ মন নিয়ে শেষ করেছিলেন আরো ধর্মীয় গ্রন্থ। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’, ‘বিদগ্ধমাধব’, ‘বাল্মিকীপুরাণ’।

বাল্মিকীপুরাণের আদিকাণ্ড বাড়িতে ছিল। সপ্তকাণ্ড কোথাও পাওয়া যায়নি। তাঁর পুত্র দ্বারকানাথ থাকতেন কলকাতায়। তাঁকে দিয়ে বাড়িতে আনালেন সপ্তকাণ্ড। ছাপার অক্ষর ক্ষুদ্র। তাও কয়েকদিনের মধ্যেই শেষ করেছিলেন বাল্মিকীপুরাণের সপ্তকাণ্ড।

তখনো লিখতে জানতেন না। আক্ষেপ করেছিলেন ‘কিন্তু এই কথাটি আমার ভারি আক্ষেপের বিষয় যে, আমি লিখতে জানি না’। পুত্র কিশোরীলাল থাকতেন দূরে। চিঠি দিলেও মায়ের উত্তর পেতেন না। মাকে লিখলেন ‘মায়ের পত্রের উত্তর না পাইলে বিদেশে কি থাকা যায়!’। বাড়িতে এলো কাগজ, কলম, দোয়াত, কালি সবকিছু। কিন্তু সংসারের চাপে লেখার সময় পেতেন কম।

একবার স্বামীর অসুস্থতার কারণে কলকাতায় যেতে হয়। ছেলের কাছে থাকতেন। সেই সময়ে লেখার অভ্যাস করার সুযোগ মেলে। ধীরে ধীরে বৃদ্ধ হাতে শব্দেরা ধরা দিতে থাকে। কলম ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে জীবনের কথা। স্বামীর উল্লেখ সেভাবে পাওয়া যায় না তাঁর আত্মজীবনীতে। তার পড়াশোনার ইচ্ছে আর দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে সেই ইচ্ছে পর্যন্ত পৌঁছানোর কথাই জুড়ে রয়েছে আত্মজীবনীতে। তবে সেই সময়কার সমাজ-ব্যবস্থার পরিষ্কার ছবি পাওয়া যায় তাঁর লেখনীতে। যেমন স্বামীর মৃত্যু-সংবাদকে তিনি নিজের ‘স্বর্ণ-মুকুট’ খসে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। ” আমার শিরে স্বর্ণ মুকুট ছিল, এতকাল পরে সেই মুকুটটি খসিয়া পড়িল”।

নিজেকে বারবার খাঁচায় বন্দী পাখির সঙ্গে তুলনা করেছেন রাসসুন্দরী। ” এখন কখন মনে পড়ে সেই দিন, পিঞ্জরের পাখি বন্দী, জালে বন্দী মীন”।

তিনি আত্মজীবনী রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন স্বামীর মৃত্যুর এক বছর পর। ১৮৭০ সালে। তাঁর আত্মজীবনী প্রস্তাবনা করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। যদিও এই অংশটি যুক্ত হয় বইটির তৃতীয় সংস্করণ-এর সময়। তিনি শুরুতে লিখেছেন ” এ গ্রন্থখানি একজন রমণীর লেখা। শুধু তাহা নহে, ৮৮ বৎসরের একজন বর্ষীয়সী প্রাচীনা রমণীর লেখা। তাই বিশেষ কৌতুহলী হইয়া আমি এই গ্রন্থ পাঠের প্রবৃত্ত হই। মনে করিয়াছিলাম, যেইখানে কোন ভালো কথা পাইব পেন্সিলের দাগ দিব। পড়িতে পড়িতে দেখি, পেন্সিলের দাগে গ্রন্থ কলেবর ভরিয়া গেল”।

দীনেশচন্দ্র সেন রাসসুন্দরী দেবীর আত্মজীবনীকে সেই সময়ে সমাজে নারীর অবস্থানের একটি ‘খাঁটি নকশা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

জীবনের শেষ সীমান্তে এসে নিজের জীবনকে লিপিবদ্ধ করে গেছেন এই নারী। তাঁর জীবনের চিত্র জুড়ে অনেকখানি না-পাওয়ার অনুভূতির আঁকি-বুকি। তবু কোথাও জীবন তাঁকে একফালি আলো দিয়েছে। অক্ষর আর শব্দেরা তাঁকে বেঁধে রেখেছিল শেষ দিন পর্যন্ত। তাঁর লেখা তাঁকে সীমাবদ্ধতার গন্ডি পেরিয়ে দৃষ্টান্ত হিসেবে উজ্জ্বল করেছে।

তথ্যসূত্র: ‘আমার জীবন’- রাসসুন্দরী দেবী

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।