।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় প্রান্তিক বিশ্বাস

চৈত্র সেল

কাল আটটা। মেসবাড়ির দোতলায় একটা ঘরে মোবাইল ফোনটা বেজেই চলছে, অনেকক্ষণ ধরে। বছর তিরিশের এক ছোকরা বুবান এখানে থাকে, ওরই ফোন বাজছে। বাড়ি মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে। কলকাতায় চাকরি করে, রোজগারপাতিও মন্দ না, কিন্তু পয়সা বাঁচানোর চক্করে মেসেই থাকে। ফ্ল্যাট কিনবে বলে ডাউনপেমেন্ট করা হয়ে গেছে, ব‍্যাংক লোনও জোগাড় করেছে। হঠাৎ কোভিডের জন্যে লকডাউন হলো সারা দেশ, ব‍্যস্, ব‍্যাপারটা এখন ধামাচাপা। বাপ-মা দেশে গ্রামের বাড়িতে থাকে। আগে খুব গরিব ছিল ওরা, এখন ছেলের কল্যাণে একটু পয়সার মুখ দেখেছে। শোয়া অবস্থাতেই হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিল ও। ট‍্যাপ করতেই দেখল বাবা ফোন করেছে। গতকাল রাতে ঘুম ঠিক মতন হয়নি। সুদেষ্ণার সাথে ফোনেই ঝগড়া চলেছে অনেক রাত অব্দি। অন্যান্য স্বাভাবিক দিনে এই সময় পাড়া সরগরম থাকে। লকডাউনে এখন শুধু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। অনেকটা বুবানদের গ্রামের বাড়ির মতন পরিবেশ। ও জানে বাবা কেন ফোন করেছে – মাসের শেষে ও পোস্ট অফিসের মাধ্যমে এখনও টাকা পাঠায়নি বাড়িতে। বুবানের চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি; ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়ায়। উপুড় করে রাখল ফোনটা।
বুবানের মেসটা দক্ষিণ কলকাতায়, অশ্বিনী দত্ত রোডে। প্রত‍্যেক বছর এই সময়টায় পয়লা বৈশাখের আগে রাসবিহারী মোড়, লেক মার্কেট, গড়িয়াহাট গমগম করে। ফুটপাথে হাঁটা দায়। দোকানে, স্টলে প্রচণ্ড ভিড়, লোক গিজগিজ করে। একটু পরে পরেই হকারদের মিলিত চিৎকার – ‘সেল সেল সেল’, ‘মিলছে সস্তায়, নিয়ে যান বস্তায়’! পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে এই সেলের ব‍্যাপারটা ছিল অনেকটাই অন‍্যরকম। পাইকারদের সঙ্গে দোকানীদের সারা বছর লেনদেনের হিসেব পুরোপুরি মিটমাট করার এটাই ছিল সময়, ধারবাকি সব মিটিয়ে দিতে হবে। বাংলা নতুন বছর শুরু হবে হালখাতা দিয়ে, তারপর আবার শুরু হবে নতুন হিসেবপত্তর। তাই যা স্টকে থাকতো, সেগুলোই ছেড়ে দিত লাভ না রেখে; কেনা দামেই, কখনও বা তার থেকেও কম দামে। কোনো ধুতির ভাঁজে হয়ত একটু ময়লা দাগ, কোনো শার্টের একটা হাতায় সেলাইয়ের সুতো একটু খোলা কিম্বা কলারে ধুলোর দাগটা বসে গেছে, শাড়ির ছাপাটা হয়তো একটু আবছা এক জায়গায়, ম‍্যাক্সি, নাইটির পাটের ভাঁজে হালকা দাগ – এইরকম ছোটখাটো খুঁত আরকি। দোকানীরা বোঝাতো – ‘ওসব কিচ্ছু না, জিনিসটা নিয়ে যান, ঠকবেন না। নিশ্চিন্তে নিয়ে যান, বাড়িতে গিয়ে সাবানজলে একবার কেচে নেবেন, সব দাগ চলে যাবে। কোথাও পাবেন না এই দামে’। ভিড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়া খদ্দেররাও অনেকক্ষণ বেছেটেছে বেশ কম দামেই সেসব লুফে নিত। সেসব ছিল স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল। এখনও কিছুটা তাই, কিন্তু বেশিরভাগই কিছুদিন আগে থেকে দাম বাড়িয়ে রেখে দেয়। তারপর এইসময় ডিসকাউণ্ট দিয়ে বিক্রি করে মহাজনের পাওনা টাকা জোগাড় করে। আজকাল তো এই সেলের বাজারের জন‍্যে নাকি কাপড়-জামা নতুনভাবে তৈরিও হয়!
লকডাউন হলেও পোস্ট অফিস খোলা আছে, বুবানের মেস থেকে দু দুটো পোস্টঅফিস পায়ে হাঁটা পথ। কিন্তু যাওয়া হয়নি সুদেষ্ণার জন্য। সুদেষ্ণা তো পিরীতির আঠা। বারবার সাবধান করে বলেছে যে বুবান যদি পোস্ট অফিসে যায় তবে ও কথা বলা বন্ধ করে দেবে। বুবানকে মেসবাড়ি থেকে বেরোতেই বারণ করেছে। বলেছে পোস্ট অফিসে নাকি সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক বেশি; কারণ ওখানে দেশ, বিদেশ থেকে নানান জিনিস আসে! বান্ধবীর কথা ফেলতে পারেনি; হয়তো গিয়েও মিথ্যে বলতে পারত, কিন্তু পরে ঠিক ধরা পড়ে যেত বুবান।
বুবানের রাগ হয় বাবার ওপর – এতবার বলা সত্ত্বেও কিছুতেই এটিএমের ব্যবহার শিখলো না। অথচ ওদের পাশের গ্রামেই এটিএম আছে। এখন যা পরিস্থিতি পাড়ার লোকের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে কাটাতে হবে কয়েকটা দিন। সে অভ্যেস যে বাবা-মার আছে, তা তো বুবান গ্রামে থাকার সময়েই চাক্ষুষ করেছে। গ্রামের লোকেরা এখন ওদের হিংসে করে, তবু এই অসময়ে চাইলে নিশ্চয়ই দেবে। জানে পরে ঠিক পেয়ে যাবে। ছেলে তো বাপ-মাকে দেখে, ভালো রোজগেরেও বটে।
আবার ফোনটা বাজছে। এবার ধরল বুবান, বিরক্তির সঙ্গে অত্যন্ত তেতো গলায় বললো
– বলো।
– ভালো আছিস তো রে বাবা?
– হ্যাঁ। এত সকালে ফোন করলে…
– মায়ের ওষুধগুলো ফুরিয়ে গেছে রে।
– ও…
– তোর শরীর ঠিক আছে তো?
– হ্যাঁ।
– মনটা বোধহয় ভালো নেই। এখন নিশ্চয়ই কোথাও বেরোতে পাচ্ছিস না! শহরে থাকিস, ওখানে তো খুব কড়াকড়ি! এখানে থাকলে তবু একটু এদিক সেদিক যেতে পারতিস।
– হুঁ…
– দাঁড়া তোর মাকে দিই। কাল রাত্তিরে তোর জন্যে চিন্তায় চিন্তায় ঘুমোতে পারেনি একদম।
বুবান প্রমাদ গুনলো। বাবা সবসময় ঠিকঠাক বলতে পারে না মুখ ফুটে, তুলনায় মা বেশ ঠোঁটকাটা, যা বলার সোজাসুজি বলে দেয়।
– ভালো আছিস তো বুবান?
– হ্যাঁ, বললাম তো বাবাকে এক্ষুনি…
– তা বটে। শোন, তোদের অফিসে টাকা বা ছুটি কোনটাই কাটবে না তো?
– কাটতেও পারে, ঠিক জানি না।
– তোদের মেসবাড়িতে কি এখন রান্নার মাসি আসছে?
– সেদিনই বললাম তো আসছে।
– সে তো পরশু। কাল এসেছিলো?
– হ্যাঁ।
– তোদের বাজার কে করছে?
– আমরাই পালা করে করছি। মালিক দূরে থাকে, আসতে পারছে না।
– আচ্ছা। বুঝেসুঝে থাকিস। কিছু খেয়েছিস?
– না, তোমাদের ফোনে ঘুম ভাঙলো।
– ওহ, তুই তো আগে ছ’টায় উঠে পড়তিস!
– এখনো উঠি, কাল শুতে দেরি হয়ে গেছিলো।
– ও, ঠিক আছে; তুই উঠে পড়ে আগে মুখ হাত পা ধুয়ে নে।
মা একটু থামলো। বুবান লাইনটা কাটার জন্যে আঙুলটা তুলে ফোনের কাছে আনলো
– শোন বাবা, তোদের ওখানে কি চোত্ মাসের সেল একদম বন্ধ? তুই তো বলতিস এইসময় বাজার খুব জমজমাট হয়।
– হ্যাঁ, কেন, কিছু লাগবে তোমাদের?
– একটা নতুন জামা পারলে নিজের জন‍্যে কিনিস বাবা, কাল বাদে পরশুই পয়লা বৈশাখ…বছরের প্রথম দিন তো, একটা কিছু নতুন গায়ে দিতে হয়।
ফোনটা কাটার সময় বুবানের মনে হলো মায়ের গলাটা যেন কান্নায় একটু ভেজা!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।