সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে পিয়াংকি (সাবেক কথা – ২৩)

সিরিজ সাবেক কথা
বোচকা
” এই যে সনাতন, চললে কোথায়? তোমার পিঠে কি নিয়েছ অত? “। সনাতন পিছন ফিরে তাকায়। কে ডাকে তাকে?দেখতে পায় না কাউকে।সনাতন এগিয়ে চলে। তার মাথার জটা থেকে বেরিয়ে আসছে হাজার বছরের সঞ্চিত জন্মযোগ। নদীর মতো এঁকেবেঁকে চলতে চলতে আচমকাই বদলে গেছে বাঁক। ভারি বোঝায় পিঠ নুইয়ে যাচ্ছে। তবু সে স্থির। ঋজু শরীরে ধারণ করেছে কর্তব্যরত সেবক-চরিত্র।
ক্রমসঞ্চয় অথবা উত্তররীতি — কাঁধে পিঠে বেড়ে চলেছে বোচকার ওজন। হ্যাঁ, বোচকা,একটি যুগের অবসান অথবা একটি যুগের সূচনা। বোচকায় ভরে রাখা ঔদার্য থেকে নেমে যাচ্ছে আমাদের পোষা বেড়াল। সেই বেড়ালের গায়ে লোম আর উজ্জ্বল দুটো চোখ। সনাতন সেই বোচকা ভরে পথের ধার থেকে কুড়িয়ে তুলছে মাটি। মাটিই একমাত্র কারণ যার জন্য ডুবিয়ে রাখা যায় এ যাবতকালের আট আনা সুখ। মোক্ষ অথবা নির্বাণ — গর্ভগৃহে বরদানের দৃঢ়তা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় প্রাচীন সনাতন। তার বুকের ওপর অজস্র পাখি,খুঁটে খাচ্ছে গমের দানা। সনাতনের সর্বাঙ্গ জুড়ে ফসলক্ষেত। বেড়ে উঠছে বোচকার ভার।
পথ কখনো মসৃণ ছিল না, পথ কখনোই মসৃণ থাকে না শুধু থেকে যায় যা তা হল পথচারীর পায়ের ছাপ। চলমান মুহূর্ত থেকে শুরু করে কয়েক আলোকবর্ষ দূর পর্যন্ত দেখা যায় চাঁদের কলঙ্ক, যে কলঙ্ক মনে করায় পিঠের বোচকায় ভরে নিতে হবে এইসমস্ত। সুতো দিয়ে সেলাই করে দিতে হবে বোচকার মুখ, ভিতর ভিতর অন্ধকার বাড়বে,ব্যস্তানুপাতে কমবে দাঁড়িপাল্লার মাপ। বোচকায় ঠাসা ইতিহাসের ভিতর যে মাটির দেয়াল, সেখানে আঁকা হবে ভোর থেকে রাত।সনাতন নিজে হাতে তুলে নেবেন রংতুলি।
স্মৃতিভুল নাকি ভ্রমদাগ — পার হয়ে যাচ্ছে স্তর। এই স্তরগুলো যেন এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সিঁড়ি। প্রতি সিঁড়িতে পরীক্ষা। বোচকা পিঠে সনাতন এগিয়ে চলেছে। ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে প্রতিটি পর্ব। কর্মফলের বাটখারায় এখন পরিযায়ী পাখি। দর্শনের পথে দগ্ধ পণ্ডিত। মোক্ষলাভের দুয়ারে অগ্নিসংযোগ। প্রারব্ধ মায়া থেকে বেরিয়ে আসছে ডানাকাটা পরী। কামনায় একটি পরিপূর্ণ আয়না, ক্রোধরিপুতে গর্জনরত সাম্রাজ্য।
সনাতন ধীর। স্থির জলরাশির মতো পবিত্র তার প্রতি পদক্ষেপ। বোচকার ওজন হ্রাস পাচ্ছে, খুলে গেছে সেলাই করা মুখ। আস্ত একটি ব্রহ্মাণ্ড বেরিয়ে এসে মিশে গেছে এই জল-স্থল-অন্তরীক্ষে।
বোচকা এখন শূন্য। সনাতনের শরীরে মহাকাল ধূমকেতু আর নির্ভার আয়ুপথ…
৩১ শে বৈশাখ
দুপুর ১২:৪৩
ইছাপুরের বাড়ি