গল্পেরা জোনাকি -তে রীতা চক্রবর্তী

পিঠেপুলি মেলা

গ্রামের মাঠে মেলা বসেছে। হাতে লেখা সাদা কাগজে মেলার বিবরণ লিখে পোস্টার দেওয়া হয়েছে সব কটা স্টেশনে। এই মেলার আকর্ষণ হল গ্রামের মেয়েদের হাতে তৈরি নকশীকাঁথা, কাপড়ের ব্যাগ, রঙিন সামিয়ানা, ঝালরদেয়া ছোট-বড় আসন, টেবিলক্লথ, কুরুশের সুতোয় বোনা নানান শৌখিন জিনিস। আর আছে মা ঠাকু’মার হাতে তৈরি নানান স্বাদের আচার, বিউলির ডালের বড়ি, মুসুরির ডালের বড়ি, হাতে কাটা সেমিয়া। তবে মেলার মূল আকর্ষণ হল গরম গরম পিঠে পুলি। সাতদিন হয়ে গেছে পিঠেপুলির দোকানের ভিড় কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না বরং রোজ রোজ বাড়ছে। আগামী সাতটাদিন এমনই ব্যস্ততায় কাটবে আশা করছে গ্রামের মানুষ। এজন্য তারা পিউকে ধন্যবাদ জানায়। পিঠে পুলি মেলার কথাটা প্রথম পিউ বলেছিল ওর বাবাকে। ওর বাবা পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য বলে সরকারি অনুমতি আদায় করতে পেরেছে। আর তাই গ্রামের সবার ঘরে ঘরে আজ খুশির হাওয়া বইছে।সুদামকাকা মনে মনে বলে মেয়েটা যে এইগ্রামের রত্ন এটা আমি সেই দিনই বলেছি যেদিন ওর রেজাল্ট বেরহয়ে ছিল।
সেদিন সকালবেলা গাঁয়ের মুখে চায়ের দোকানে একেবারে হৈ হৈ কান্ড। সুদামকাকা হাতে একটা খবরের কাগজ নিয়ে সবাইকে ডেকে ডেকে বলছে, “বলি খবরটাকি তোমরা কেউ এখনো শোনোনিহে! তারকের ছেলেমেয়েদুটো মানে পিউ আর পলু, দু’ভাই বোন একসাথে এবার গ্রামের ইস্কুলের নাম খবরের কাগজে ছাপিয়ে দিলে যে। দেখকান্ড, তোমরা কি কিছুই খবর রাখনা নাকি! ওরে হরি, তারকের বাড়িতে খবরটা দিয়ে আয় বাবা। নাজানি ওরা কতই চিন্তা করছে!”বেলা বাড়ার সাথে সাথে গ্রামের ঘরে ঘরে খবর ছড়িয়ে পরে। সবাই খুব আনন্দ করছে। একে একে পাড়ার জেঠিমা, কাকিমারা এসে আদর করে যাচ্ছে। বাবাকে পাড়ার কাকু-জেঠুরা একরকম জোর করে ধরে নিয়ে গেছে গ্রামের মোরের মাথায় চায়ের দোকানে।এত আনন্দ যাদের নিয়ে সেই দু’ভাই বোন ইস্কুলের পথে রওনা হয়েছে হেডস্যারকে প্রনাম করতে। পিউ উচ্চমাধ্যমিক গ্রামের সেরা হয়েছে। আর পলু মাধ্যমিকে ছটা বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে তৃতীয়স্থান অধিকার করেছে।
তারকনাথ দলুই ছোটথেকে পড়াশোনার অনেকচেষ্টা করেছে। কিন্তু ভাগচাষীর ছেলের ভাগ্যে ঠিকমত লেখাপড়ার ভাগটা বোধহয় থাকেনা। অনেক কষ্টকরে সে এইট পর্যন্ত পড়তে পেরেছে। লেখাপড়ার গুরুত্ব সে জানে। তাই ছেলেমেয়েদের পড়াটা খুব কষ্টকরে সে চালিয়ে যায়।এবারে ছেলেটার পড়ার খরচ স্কুলের মাস্টারমশাইরা দিতে চেয়েছেন। মেয়ের পড়ার খরচের জন্য কিছু একটা করতে হবে। দিনের বেলা কাজের সময়ে ভাগে চাষ করে আর ভোরের আলো ফোটার আগে নিজের ক্ষেতে কাজ করে। ছোটবেলা থেকে চাষ করতে শিখেছে বলে মাটির গন্ধ খুব চেনে। কোন মাটিতে কোন ফসল ভালো হবে সেটা মাটির রং দেখে ঠিক করে নেয়। তাই ভাগের চাষের আয় আর নিজের জমির ফসল বিক্রিকরে মেয়ের খরচের সাথে সংসার খরচও চালিয়ে নেয়। তাছাড়া বাড়ির সামনের জায়গাটুকুতে তারকের বুড়োবাপ যেটুকু আনাজপাতি ফলায় তাতে সংসারের প্রতিদিনের খাবারের জোগাড় করতে কোনো কষ্ট হয়না। মেয়ে বড় হলে বিয়ের চিন্তা করতেই হয়। তবে পিউ বলেছে আগে কিছুদিন কোনো একটা চাকরি করবে তারপর বিয়ে করবে। পিউ এখন একটা কোম্পানির রিসেপশনিস্টের চাকরি করে। পলুও বাপের সাথে চাষের কাজ করে অনেক কিছু শিখে নিয়েছে। পলু লেখাপড়ার সাথে চাষের ফলন বাড়ানোর উপায় জানতে চেয়েছিল বলে কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছে। আজকাল গ্রামের বড়োবুড়োরাও পলুর কথামতো জমিতে চাষ করে। তারকনাথ দলুই এখন গ্রামের একজন গণ্যমান্য লোক। তার ছেলেমেয়ের সাফল্য দেখে গ্রামের প্রতিটা পরিবার ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে শুরু করেছে। সংসারের পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়ে সন্তানরা পরিবারের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতে শিখছে। গ্রামের মানুষ এখন নতুন করে বাঁচতে শিখছে। এজন্য তারা তারকের ছেলেমেয়েকে স্কুলে পড়ানোর ব্যাপারটার নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এবং তারকের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে। তাই তারা তারকনাথ দলুইকে গ্রামপঞ্চায়েতের অন্যতম সদস্য হিসেবে মনোনীত করেছে। গ্রামের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার পূরন করতে তিনি এই দায়িত্ব হাসিমুখে নিজেরকাঁধে তুলে নিয়েছেন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।