সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে নীলম সামন্ত (পর্ব – ২৩)

মহাভারতের মহা-নির্মাণ – ধৃষ্টদ্যুম্ন

দেখতে গেলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ছিল পুরো মহাকাব্যের মূল উদ্দেশ্য। নানান ছল চাতুরি ও বিস্তর ঘটনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে প্রতিটা চরিত্র গিয়ে দাঁড়িয়েছে কুরুক্ষেত্রের ময়দানে। একটু ভেবে দেখলেই দেখা যায় যারাই কুরুক্ষেত্রের রথি মহারথী রয়েছেন তাদের কারো প্রাণ বাঁচানোর জন্য অথবা কারোকে মারার জন্য কোন না কোন চরিত্র ছোট বড় সব রকম হিসেবে নিজেদের কর্ম টুকু করে গেছে। ধৃষ্টদ্যুম্ন তো দ্রোণাচার্যের মতো মহারথিকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে জীবনের বাকিটা পথ হেঁটেছেন। বাকি পথ কেন তার জন্মটাই তো এই কারণে। তবে কি তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল?

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সেদিন ছিল পনের নম্বর দিন। শ্রীকৃষ্ণ যেহেতু সবই জানতেন, সবার ক্ষমতা এবং অক্ষমতা এবং রণনীতি তাঁরই তৈরি করা পাশার আসর। তাই বলাবাহুল্য শ্রীকৃষ্ণ বেশ জানতেন দ্রোণাচার্য কি এমনি এমনি মেরে ফেলা সম্ভব নয়। আর সে কারণেই যুধিষ্ঠির কে তিনি ওই কথাটা বলতে উসকে দেন। “অশ্বথামা রণে হত-ইতি গজ(আস্তে করে)। শ্রীকৃষ্ণ জানতেন দ্রোণাচার্য এই যুদ্ধক্ষেত্রে তার সন্তানের মৃত্যু খবর সহ্য করতে পারবেন না। এবং তাই ঘটলো। যেহেতু যুধিষ্ঠির বলেছেন এবং যুধিষ্ঠির কখনোই মিথ্যে কথা বলেন না, চোখ বন্ধ করে তাকে বিশ্বাস করা যায়। দ্রোণাচার্য সেই বিশ্বাস করেও ছিলেন, তিনি যে ঠকতে পারেন সে কথা দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেননি। অস্ত্র ত্যাগ করে তার রথের উপরেই হতাশা ও পুত্রশোক বুকের মধ্যে জমিয়ে ধ্যানরত হয়েছিলেন। আসলে তিনি যোগ বিদায় অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। সেই যোগ বিদ্যা প্রয়োগ করে তিনি দেহ ছাড়তে চেয়েছিলেন। যেহেতু ধ্যানে বসে তিনি দেহ ছাড়ছেন তাই সাধারণ মানুষ যেমন ধৃষ্টদ্যুম্ন-র পক্ষে এটা জানা সম্ভবই ছিল না যে দ্রোণাচার্য মারা যাচ্ছেন। অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছেন দেখে তিনি ভাবলেন এই সুযোগ, এর সদ-ব্যবহার না করলে তিনি এ জন্মে আর সুযোগ নাও পেতে পারেন। তাই ক্রোধ প্রতিহিংসা সমস্ত কিছু মাথায় নিয়ে ছুটে গেলেন দ্রোণাচার্যকে মেরে ফেলতে। সে মৃতদেহ কে মুন্ডচ্ছেদ করলেন। আহা কি মূর্খ! ক্রোধ যে মানুষকে বসে রাখে না এটাই তার প্রমাণ। নইলে একটা মৃতদেহের মুন্ডচ্ছেদ কে করে? এই নিয়ে তার সাথে পরবর্তীকালে অর্জুনের সাথে বিস্তর বচসা হয়েছিল। পঞ্চপান্ডবদের মধ্যে অর্জুনই ছিল একটু দুর্বল প্রকৃতির। তাই তার বুকের মধ্যে আঘাত হয়েছিল এটা দেখে যে তার গুরুরই এক ছাত্র তাঁকে এইভাবে হত্যা করতে পারলো! তিনি বারবার গর্জে উঠছিলেন এই কথা বলেন যে দ্রোণাচার্য গুরু তাকে কিভাবে মুন্ডচ্ছেদ করা যায়? তবে ধৃষ্টদ্যুম্নও থেমে থাকার মানুষ নয়। চুপ করে যে সবকিছু শুনবে এমন চিন্তাভাবনা তার মাথায় বোধহয় কখনোই আসেনি। তাই ওই রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে অর্জুনের সামনাসামনি বাক্যবানে নিজেকে যুক্ত করে ফেলেছিলেন। তিনি বারবারই বলেছিলেন দ্রোণাচার্যের কর্মকাণ্ডের কথা। কিন্তু অর্জুন শোনার পাত্র নয়। শ্রীকৃষ্ণ যখন দেখলেন যে বিষয়টা বেগতিক, এরা নিজেদের সাথে নিজেরা ঝগড়া তন্ত্র করছে তখন তিনি সামনে এগিয়ে এসে দুজনকেই সামলে দিলেন।

কিন্তু এই কাণ্ডের ফলাফল হিসেবে ধৃষ্টদ্যুম্নও কিন্তু ছাড় পায়নি। অশ্বথামার ক্রোধ চাপা পড়ে যায়নি। যুদ্ধের শেষে তিনি পান্ডবদের শিবিরে যখন যান তখন সেখানে ঘুমিয়ে ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখন্ডিসহ আরো অনেকে, সাথী ছিলেন শিশু পাণ্ডবরাও। অশ্বথামা কাউকে কিন্তু ছেড়ে দেয়নি, সেইদিন সেই ঘন রাতে সবার মৃত্যু রাতকে আরো ঘন করে তুলেছিল। তারপর পরবর্তী ঘটনা নিয়ে এখানে আর আলোচনা করছি না। এভাবেই শেষ হয়ে যায় ধৃষ্টদ্যুম্নের জীবন। প্রতিহিংসা কখনোই মানুষকে সঠিক পথে চালনা করেনা তার প্রকৃত উদাহরণ হিসেবে কুরুক্ষেত্রের এই ঘটনাটিকে আমরা তুলে ধরতে পারি।

ধৃষ্টদ্যুম্ন বিবাহিত ছিলেন। একবার কাশীর রাজকুমার সুধন্ব একটি রাজকুমারীকে আক্রমণ করেছিলেন যিনি তীর্থ করতে যাচ্ছিলেন। রাজকুমারী কোনরকম ভাবে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই তীর্থক্ষেত্রে যেখানে ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রার্থনা করছিলেন। সবকিছু খুলে বলার পর তিনি তার আগ্নেয় ধনুক দিয়ে কাশির রাজকুমার সুধন্বকে পরাজিত করেন একক যুদ্ধে। পরবর্তীকালে ওই রাজকুমারীকে তিনি বিয়ে করেন। তাদের সন্তান-সন্ততিও ছিল কিন্তু সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তবে ক্ষত্রধর্মন, ক্ষত্রঞ্জয়, মানদ এবং সত্যধৃতি নামে অনেক পুত্র প্রচলিত ছিল।

ধৃষ্টদ্যুম্নের ক্ষমতা কিন্তু কম ছিল না। দ্রোণাচার্যের কাছে শিক্ষা লাভের কারণে তিনি একাধারে যেমন ধনুর্বিদ্যায় অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন তেমনি তিনি ছিলেন তরবারী বিদ্যায় আশ্চর্য রকমের নিপুন। মহাভারতের সময় অন্য যেকোনো তলোয়ারধারীকে কে তিনি অনায়াসে পরাস্ত করতে পারতেন।

তবে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরিণতি থেকে তিনি এটাই শিক্ষা লাভ করেছিলেন যে যুদ্ধ কিন্তু আসলেই ভালো জিনিস নয়। যে যুদ্ধের জন্য তার উৎসাহের কোনো কমতি ছিল না বরং সে পান্ডবদের বারবার যুদ্ধ করার জন্য উৎসাহ দিয়ে গেছেন। যুদ্ধের শেষে তিনি কিন্তু মুষড়ে পড়েছিলেন। জীবনে সঠিক কথা উপলব্ধির মত বোধহয় প্রাপ্তি আর অন্য কিছুতে নেই। তাই ক্রোধ হোক যাই হোক ধৃষ্টদ্যুম্নেরর জন্মের উদ্দেশ্য যেমন তেমন হোক না কেন তিনি এই জন্মে তার জীবনের সেরা উপলব্ধিটুকু করে যেতে পেরেছেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কারনে আমরা যে শুধু চরিত্রের প্রাধান্য পাওয়ার দিক বা অবহেলার দিক দেখি তা কিন্তু না। এখানে মনস্তাত্ত্বিক উপলব্ধির শিক্ষাগত দিকগুলোও যথেষ্ট আলোচিত। ধৃষ্টদ্যুম্ন চরিত্রটি থেকেও আমরা কিন্তু অনেক শিক্ষা লাভই করি৷

খুব ছোট্ট করে যদি বলি, পান্ডবদের পক্ষ থেকে তিনি যখন সেনাপতি হিসেবে নির্বাচিত হলেন, তখন যুদ্ধক্ষেত্রে তার সেনাবাহিনীদের নিয়ে নানান রকম পরিকল্পনা করতে থাকেন। ঠিক সেই মুহূর্তগুলো যদি আমরা বিবেচনা করি তাহলে দেখা যায় তাঁর ভেতরে কিন্তু একটা উচ্ছৃঙ্খল মানসিকতা তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যে তাঁর ভেতরের আলোকিত অংশগুলোকে চিন্তাভাবনা আবেগ এবং সংবেদনশীলতাকে চাপা দিয়ে রেখেছিল। সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কিন্তু সেই ক্রোধেরই। যা পরবর্তীকালে প্রাণ চলে যাওয়ার সময় বা প্রাণ সংকটের সময় মনে হয়েছে। ঠিক এই ভাবেই বলা যায় আমরাও কিন্তু আমাদের আভ্যন্তরীণ আলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নই। আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের রাগ, আবেগ ও মনের নানান রিপুগত দিকগুলো।

এই সমস্ত আলোচনা থেকে আমার বারবারই মনে হয়েছে, ধৃষ্টদ্যুম্ন চরিত্রটি আমাদেরই জীবনের বা গঠনের একটি বাস্তবিক দর্শনমূলক আয়না। খুব ভালো করে তলিয়ে দেখলে তা বার বার স্পষ্ট হয়।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *