কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত – স্বাদকাহন

স্বাদকাহন – ডাল বাটি চুরমা।
ডাল বাটি চুরমা— ভোজনরসিক মানুষদের কাছে অতি পরিচিত নাম। বিশেষ করে যারা নানান ধরণের খাবার খেতে ভালোবাসেন। তবুও একটু গল্প করি এই ডাল বাটি চুরমা নিয়ে।
কিছু কিছু খাবার দলবদ্ধ হয়, এই যেমন আলু পোস্ত ডাল ভাত বা রুটি তড়কা বা ফ্রায়েড রাইস চিলি চিকেন… মানে একে অপরের পরিপূরক খাবার। সেরকমই ডাল বাটি চুরমা হল ত্রয়ী। একে অপরের সাথে জোটবদ্ধ ভাবে খাদকের মন জয় করে। এতো বার খাবারের নাম উচ্চারণ করছি যে থালায় সাজানো ডাল বাটি চুরমা চোখের সামনে ভাসছে৷ মনে আছে, যোধা আকবর সিনেমায় যোধা বাই কেমন রান্না করে একদিন আকবর ও অন্যান্য সভাসদদের রাজস্থানী খাবার খাইয়েছিল, যাতে প্রধান খাবার ছিল, ডাল বাটি চুরমা, গাট্টে কি সবজি, ঘেবর, সোহন হালওয়া ইত্যাদি৷ এই সব খাবারই রাজস্থানের বিখ্যাত খাবার। কিন্তু কেন আর কিভাবে এই প্রশ্ন তো স্বাভাবিক ভাবেই এসে যায়৷
যোধা বাইয়ের অনেক আগে থেকেই রাজস্থানে এই ডাল বাটি চুরমা পদটির প্রচলন। তিনটে খাবারের যুগলবন্দী যদিও পরের দিকে হয়েছে। শুরুতে বেশি চালু ছিল বাটি। এই বাটি কিন্তু খাবারের বাটি নয়। সেঁকে নেওয়া আটার গোলা। রাজস্থানে এই ধরণের খাবারের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রথমত ভৌগোলিক পরিমণ্ডল। রাজস্থানের জলবায়ুতে যে কোন শস্য চাষ হয় না। এমন ধরণের শস্য চাষ হয় যা ফলনে খুবই কম জল লাগে সাথে বেশি তাপও সহ্য করতে পারে। বহু বছর আগে চাষ আবাদ একেবারেই ছিল না। পরবর্তীতে খুব কষ্ট করে করলেও আরও পরের দিকে সম্ভবত ১৯৫৮ সালের দিকে একটি ক্যানেল তৈরি হয় যা হরিয়ানার হরিকে ব্যারেজের সাথে যুক্ত৷ এই ব্যারেজটি বিয়াস ও শতদ্রু নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত হওয়ার কারণে জলের কোন অভাব থাকে না বললেই চলে। ক্যানেলটির নাম হল, ইন্দিরা গান্ধী ক্যানেল। এর ফলে রাজস্থানের বেশ কিছু জেলায় বর্তমানে চাষ আবাদ মোটামুটি পরিমানে হয়। তবে রৌদ্রের তাপ অতিরিক্ত হওয়ার কারণে আগে যে সব শস্য চাষ হত সেগুলোই এখনও হয় তবে বেশি পরিমানে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, জোয়ার বাজরা রাগী, গম, তিল, বিউলি ডাল ইত্যাদি। গম জোয়ার বাজরা ই রাজস্থানের মূল খাবারের যোগান দেয়। বাটি তৈরি হয় গমের আটা থেকে।
অনেক কাল আগে যখন বাপ্পা রাওয়াল রাজস্থানের মেওয়ার রাজ্যে রাজত্ব করতেন, বাটি ছিল যুদ্ধকালীন খাবার। কারণ বাটি যেহেতু আটা দিয়ে তৈরি তাই কার্বোহাইড্রেটের যোগান খুব সহজেই পাওয়া যেত ফলে পেট ভরা ও যুদ্ধে শক্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে সুবিধেই হত। যুদ্ধে যাওয়ার আগে, রাজপুত সৈন্যরা আটার গোলা বা লেচিকে গোল গোল বলের আকারে গড়ে বালির উপরের স্তরের নিচে পুঁতে ফেলত। মরু এলাকায় বালির তাপ আজ নয় চিরকালই যথেষ্ট ছিল, ফলে ওই বালির তাপেই বাটিগুলো পুড়ে যেত, বলা ভালো রান্না হয়ে যেত৷ ফলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসার সময় এই বেকড সংস্করণ তারা অনায়াসেই হাতে পেত। এর পর ধুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করে তারা দেশি ঘি ওপর থেকে ঢেলে পরিবেশন করত।আর সাথে কোন ধরণের বাটারমিল্ক (যাকে সহজ ভাষায় ঘোল বলে চিনি) বা দই মিশিয়ে খেত। অতিরিক্ত গরমে দই বা ঘোল দুটোই যেমন শরীর ঠান্ডা রাখে তেমনি খাবার হজমও করায় সহজেই। এই ভাবেই উনুন ছাড়া বা আগুন ছাড়া সহজ রান্না বাটি ধীরে ধীরে ঘর পরিবারের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর একটা বিশেষ দিক হল, বাটি বালিতে পোড়ানোর পর কয়েকদিন রেখে খাওয়া যায়। ফলে শুধু যুদ্ধবাজদের নয় ভ্রমণকারীদের জন্যও বেশ ভালো খাবার।
শুরুতেই বাটির সাথে ডালের প্রচলন ছিল না৷ পরে যখন গুপ্ত সাম্রাজ্য যখন মেওয়ারে প্রবেশ করে, তখন তারা সাথে করে নিয়ে আসে পাঁচ রকম ডালের জোটবদ্ধ ভালোবাসা। পাঁচটি ডাল (যার ফলেই এর নাম পাঁচমেল) – মুগ ডাল, ছোলার ডাল, অড়হড় ডাল, মসুর ডাল এবং বিউলির ডালের মিশ্রণ – জিরা, লবঙ্গ, মরিচ এবং আরও অনেক কিছুর মতো সুগন্ধি এবং মশলা দিয়ে তৈরি করা হয় এই স্পেশাল ডাল। বাটি – দই বা ঘোলের সাথে খাওয়ার প্রথাকে ডাল বাটিতে উন্নীত করে, গুপ্তরা ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় খাবারের দুটি প্রধান উপাদানের মিলন স্থাপন করে। দুগ্ধজাত খাবারের স্বাদ মশলা এবং পুষ্টি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। কিভাবে হাত ফেরে বা নতুন কারও হাতে নতুন কিছু জুড়ে আলাদা রকমারি তৈরি হয় তা সত্যিই আমাদের ধারণার বাইরে।
এ তো গেল ডাল আর বাটির গল্প। চুরমা কিন্তু আসলেই মিষ্টিমুখ। কোন খাবার যে ভুল পদক্ষেপের ফলেও আবিষ্কার হতে পারে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হল চুরমা। হ্যাঁ এই চুরমা আকস্মিকভাবেই উদ্ভাবিত হয়েছিল। মেওয়ারদের গুহিলোট বংশের একজন রাঁধুনি একবার ভুল করে কিছু বাটির উপর ঘি এর জায়গায় আখের রস ঢেলে দিয়েছিলেন। এর ফলে বাতিগুলো নরম এবং ভেজা হয়ে ওঠে। যা আসলেই খেতে বেশ লেগে ছিল। কারণ পোড়ানোর পর বাটিগুলি বেশ শক্ত হয়। এরপর গুহিলোট মহিলারা পুরুষরা বাড়ি ফিরে না আসা পর্যন্ত বাটিগুলোকে নরম রাখতে চেয়েছিলেন, এবং তাই, তারা বেশ শক্ত আটার বলগুলোকে জল এবং গুড় বা আখের মিশ্রণে ডুবিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন। অবশেষে, বাটি ভেজা থাকায়, এটি ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যেতে শুরু করে যা আমরা এখন চুরমা নামে পরিচিত। সময়ের সাথে সাথে, স্থানীয়রা এলাচ বা অন্য কোনও মশলা বা মিষ্টি যোগ করে। শুধু এটা নয়, আরও একটা গল্প শোনা যায়, এই গুহিলোট বংশেরই এক মহিলা বাটি রান্না করতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। আর তাকেই ভেঙে গুঁড়িয়ে ঘি ও গুড় মিশিয়ে পরিবেশন করেছি। যাতে করে তার ভুলটি ঢাকা পড়ার পাশাপাশি ভিন্ন স্বাদের খাবারের আকর্ষণও তৈরি করেছিল। যা পরবর্তীতে চুরমা নামেই বিখ্যাত৷ দু’টো গল্প আলাদা হলেও একটা জায়গা পরিষ্কার তা হল চুরমার উৎপত্তি গুহিলোট বংশের হেঁশেল থেকেই।
রাজস্থানের মানুষদের প্রকৃতি পরিবেশের সাথে টিকে থাকার কৌশলের দীর্ঘ অংশ জুড়ে রয়েছে ডাল বাটি চুরমা। আগুন ছাড়া এই সহজ রান্না রাজস্থান শুধু নয়, ভারতের সমস্ত রাজ্যেই বেশ জনপ্রিয় খাবার হয়ে উঠেছে৷ তেল মশলা ছাড়া এমন স্বাস্থ্যকর খাবার কেই বা অপছন্দ করবে?