কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) – নীলম সামন্ত

স্বাদ কাহন (লুচি)

ভারতবর্ষ সম্পদে ঠাসা একটি দেশ। যার মাটিতে কি হয় আর কি পাওয়া গেছে তার অতীত বর্তমান ভবিষ্যত সম্পর্কে ধারণা খুব কম ভারতীয়দেরই আছে—

এই বিষয়ে একবার আমার এক অবাঙালি বন্ধু প্রিয়াঙ্কার সাথে তর্ক করছিলাম। প্রিয়াঙ্কা উত্তর প্রদেশের মেয়ে৷ মৌলবাদী৷ তর্কে সেরা। আমি তর্ক করতে ভালোবাসি কারণ তর্কে অনেক কিছু জানা যায়। যেমন সেদিন তর্কের মাধ্যমে আমি জানলাম বিদেশে গমের প্রচলন ভারতের হাত দিয়েই ঘটেছে৷ এশিয়া মহাদেশে আজও সব থেকে বেশি গম উৎপাদন হয়। এদিকে ইটালিয়ান ব্রেডের স্বাদ ও রকমারি দেখেছি সাথে এও দেখেছি ইউরোপ বা আমেরিকার মানুষরা কতটা ব্রেড নির্ভরশীল৷ সেই তথ্যের ভিত্তিতে আমি মানতে নারাজ যে গম ভারত সহ চীন ও অন্যান্য এশিয়া মহাদেশের দেশগুলোতে অনেক বেশি উৎপাদন হয় আর তারা ব্যবহারও জানে৷

কিন্তু পরে দেখেছিলাম আমার বান্ধবীই ঠিক বলেছিল৷ ভারতবর্ষের উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, বিহার, ছত্তিসগড়, পাঞ্জাব ইত্যাদি রাজ্যগুলোতে গমের আটা সহ অন্যান্য আটার চল বেশি৷ ভাত পাতে বাঙালির মতো ভাত ডাল ভাজা, তরকারি মাছ মাংসের সপ্ত-ব্যাঞ্জনের জায়গায় ওরা খায় রুটি সবজি আর দাল চাওল। অর্থাৎ যে কোন এক রকমের সবজি ও প্রয়োজন মাফিক রুটি, আর শেষ পাতে অল্প ভাত ও ডাল। আমি অবশ্য দেখেছি রুটিটা ওরা অনেকটা তেল লাগিয়ে আটা মাখে এবং পাতে দেওয়ার সময় ঘি মাখিয়ে দেয়৷ এটাকে রুটির থেকে বেশি চাপাটি বলা হয়। আর আত্মীয়স্বজন বা বিশেষ দিনে এই রুটির জায়গায় থাকে পুরি৷ আটার লুচি। এই জায়গাগুলোতে ময়দার ব্যবহার অনেক কম। ময়দার সাথে ইস্ট মাখিয়ে ফারমেন্ট করে লুচি কে আবার ভাটোরা বলে যা পাঞ্জাবে বিখ্যাত৷

আমরা বাঙালিরা আবার লুচি বলতে ময়দায় ময়ান দেওয়া ফোলা ফোলা সাদা বলের মতো ঘি বা তেলে ছাঁকা খাবারই বুঝি৷ ছোট থেকেই দেখে এসেছি রবিবারগুলোতে মায়ের ছুটি থাকত, তাই সকাল সকাল ঠাকুমা ময়দায় সাদা তেল কালো জিরে আর নুন চিনির ময়ান দিয়ে মেখে দিত। উনুনে ঝটপট আগুন ধরিয়ে একদিকে লুচি ভাজা হচ্ছে আর আরেকদিকে সাদা মাটা সাদা আলুর তরকারি। আত্মীয়রা এলে ওই সাদা আলুর তরকারির জায়গায় হত আলুরদম, বেগুন ভাজা আর বরফি কাটের সুজি। জলখাবারে এই মেনু অনেকের বাড়িতেই হয়৷ বাংলায় ময়দার প্রচলন কেন হল জানেন?

ময়দা আসলে রিফাইন আটা। বাংলায় ব্রিটিশদের আগেও অনেক বিদেশীরা বাণিজ্য করতে আসত৷ আর তাদের প্রধান খাবার ছিল পাউরুটি। এই পাউরুটি বানানো হত ময়দা দিয়েই। ওদের দেখে দেখে আস্তে আস্তে বাংলার ঘরেও চালু হল লুচি খাওয়া। নইলে বাংলার প্রধান ফসল ধান হওয়ার কারণে ভাতের প্রচলনই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। বাঙালি কখনও ভাত রুটি এক সাথে খায় না৷ আর খাবারের মূল উপাদান সব সময়ই চাল, যেমন চিড়ে, খই, মুড়ি ইত্যাদি৷

জেনেটিক্যালিই আমরা ডুবো তেলে বা ঘিতে রান্না খেতে ভালোবাসি। যেমন ঘি ভাত বা পোলাও এই সবে ঘিয়ের মাত্রা কোন ভাবেই কম দেখা যায় না৷ আবার আমরা ফুলকা রুটি মানে তেল ছাড়া সেঁকা রুটি খাই৷ কিন্তু পরোটা খেলে ঘি বা তেলে ভেজে৷ আমরা বর্তমানে স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার কারণে জোয়ার রাগী এই সব আটার রুটি খাই ঠিকই, রসনা চায় দেশী ঘিয়ের পরোটা নয় খাস্তা লুচি। ভুল বললাম কি?

জানেন হিন্দিতে একটা শব্দ আছে ‘লুচ’ কিংবা ‘লুচলুচিয়া’ যার অর্থ হল পিচ্ছিল। ঘিয়ে ভাজা লুচি হাত থেকে পিছলে যায় বলে একে লুচি বলে সম্বোধন করা হয়েছিল। ঠিক যেমন সুন্দর চোখের ছেলেদের বলি পদ্মলোচন আর খুঁড়িয়ে চললে বলি মানুষটা খোঁড়া। তবে অনেকের মতে আবার সংস্কৃত শব্দ ‘রুচি’ থেকে এসেছে লুচি। রুচি অর্থ আগ্রহ। কিভাবে যে আসলেই নামকরণ হয়েছিল তা কতখানি অপভ্রংশ বা স্বাদের কারণে তা একমাত্র কাল জানে৷ তাই না?

ইতিহাস বলতে খেয়াল হল, একাদশ শতকে পাল যুগের বিখ্যাত চিকিৎসক চক্রপাণি দত্তের লেখা ‘দ্রব্যগুণ’ গ্রন্থে লুচির বর্ণনা পাওয়া যায়৷ তিনি লিখেছেন—

‘সুমিতায়া ঘৃতাক্তায়া লোপ্‌ত্রীং কৃত্বা চ বেল্লয়েৎ। আজ্যে তাং ভর্জয়েৎ সিদ্ধাং শষ্কুলী ফেনিকা গুণাঃ॥’

অর্থাৎ ‘গম চূর্ণকে ঘি দিয়ে মেখে, লেচি করে বেলে, গরম ঘিয়ে ভেজে তৈরী হয় শষ্কুলী, যার গুণ ফেনিকার মত।

ধরে নিতে পারি লুচির আদি বা শুদ্ধ নাম হল শষ্কুলী। সে যুগে তিন প্রকার শষ্কুলী বা লুচি প্রচলিত ছিল – খাস্তা, সাপ্তা ও পুরি। ময়ান অর্থাৎ অনেকটা ঘি দিয়ে ময়দা মেখে যে লুচি ভাজা হত আর যা শক্ত মুচমুচে হত তাই হল খাস্তা লুচি। এখনও বাঙালির মধ্যে এই খাস্তা লুচির চল আছে। যা ঘি-এর পরিবর্তে বনস্পতি ভোজ্যতেলে ভাজা হয়৷ সাপ্তা লুচি হল ময়ান ছাড়াই ময়দা মেখে লেচি কেটে লুচি৷ আর পুরি আগাগোড়াই আটার লুচিকে বলা হয়৷ বর্তমানে নুচির প্রচলনও আছে। আমার এক ঠাকুমা ছিলেন যার বাপের বাড়ি হাওড়া জেলায়৷ তিনি বলতেন “আজ বাড়িতে ‘নুচি’ হয়েছে”, ভাবতাম অন্য কোন বিশেষ খাবার। ব্যকরণ শেখার পর ভেবেছি লুচির অপভ্রংশ নুচি। কিন্তু পরে অনেকের সাথে কথা বলে জেনেছি নেতিয়ে যাওয়া লুচিকে নুচি বলে। আসলে ময়ানের ভাগ কম হয়ে গেলেই লুচি ফোলা থাকে না৷ নেতিয়ে পড়ে৷ এখন ভাবি আমার পিসেমশাইরা যখন আসতেন সমস্ত আয়োজন শেষে মা লুচি ভাজতেন, ঠাকুমার বাপেরবাড়ির একজন বোবা মেয়ে ছিল, সে মেশিনের গতিতে বেলে দিত। রাজবাড়িতে তার কাজ শেখা বলেই হয়তো লুচিগুলো কম্পাসে কাটা বৃত্তের মত হত৷ পিসেমশাইদের থালায় দেওয়া হত ফোলা ফোলা লুচি। লুচি নেতিয়ে পড়াকে বলত রাঁধুনির কাঁচা হাত৷

বিদেশীদের হাত ধরে বাঙালির স্বাদমতো তৈরি এই খাবার আজ এতো জনপ্রিয় হলেও শুরুর দিকে রাজবাড়িরই ঐতিহ্য ছিল। মানুষের জলখাবারের বিশেষত্ব হলেও লুচি অনেক ক্ষেত্রেই ঈশ্বরের ভোগ নিবেদনেরও প্রধান খাবার ছিল। একবার একটি প্রতিবেদনে পড়েছিলাম, দিনাজপুরের কান্তনগরের কান্তজিউ মন্দিরের ঠাকুরবাড়িতে লুচি সব থেকে বড় আকারের তৈরি হত। একেকটার সাইজ থালার মতো বড় বড়। বর্তমানে মালদহ জেলার ইংরেজবাজারের সাদল্লাপুর শ্মশানের কাছে হাতির পায়ের মতো বড় লুচি পাওয়া যায়,যার ব্যাস প্রায় ১০ ইঞ্চির কাছাকাছি। আবার একটি গুজব আছে পশ্চিম মেদিনীপুরের রাধামোহনপুরের পলাশী গ্রামের নন্দী পরিবারের ঠাকুরবাড়িতে ভোগ হিসেবে যে লুচি দেওয়া হয় তা নাকি বাংলার সবচেয়ে ছোট লুচি। সেই পরিবারের লোক এটা মাতে নারাজ। তাদের দাবী কোন একদিন লুচির আকার সামান্য ছোট হয়েছিল বলে গ্রামের লোকেরা পোস্টার ফেলেছিল। আর ছড়িয়ে যায় গুজবের মতো।

গুজব হলেও আমার দুই বাড়িতেই শুনে এসেছি লুচি এমন সাইজের হবে অতিথিকে যেন ছিঁড়ে টুকরো করে খেতে না হয়। তবেই ভাবুন, মেদিনীপুরে বড় লুচির চল হয়তো সত্যিই ছিল না৷ নইলে বাড়ি বাড়ি এমন কথা তো আর এমনি এমনি তৈরি হয় না৷

বাঙালির জনপ্রিয় খাবারেরও কত গল্প তাই না? আসলে কি জানেন যে কোন খাবার একেবারে নিজের বলে খুবই কম। বেশিরভাগ খাবারই কোথাও না কোথাও থেকে সামান্য নিয়ে নিজের হিসেবে তৈরি করা৷ তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে লুচি-ই কি যথেষ্ট নয়? পর্তুগীজদের থেকে ময়দা বা মিহি আটা নিয়ে বাঙালির লুচি যেমন তৈরি হয়েছে তেমনি আলুর দমেও কিন্তু রয়েছে মুঘল সাম্রাজ্যের ছাপ৷ আমরা শুধু বাঙালী নয়, ভারতবাসী হিসেবে সব দিক থেকেই বৈচিত্র্যপূর্ণ আর ঐক্যবদ্ধ৷ মহাবার দাবারেও তার বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায়৷

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *