কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত – স্বাদকাহন

স্বাদকাহন – সিঙাড়া

লুচির গল্প লিখতে গিয়ে বলেছিলাম লুচি নেতিয়ে গেলে তাকে নুচি বলা হয়। কিন্তু ঠান্ডা লুচি কি সত্যিই ভালো লাগে খেতে? কিংবা ন্যাতানো লুচি? আজকাল বাসি লুচি চা দিয়ে খাওয়ার চল থাকলেও পুরনো দিনে ঠান্ডা লুচির চল একেবারেই ছিল না৷

সিঙাড়ার উৎপত্তি লিখতে গিয়ে আমার একটা গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। যেখানে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র অত্যন্ত বিরক্ত কারণ তিনি রাজবাড়ির হালুইকরের বানানো লুচি বার বার ফেরত পাঠাতে বাধ্য হচ্ছিলেন। কারণ লুচিগুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। ঠান্ডা লুচি রাজা খাবেন! এ আবার কেমন কথা? এদিকে ফেরত লুচি দেখে চিন্তিত হালুইকর রাজসভায় কোন মিষ্টি জাতীয় খাবার পাঠাতে চেয়েছিলেন। ঠান্ডা হলেও খেতে ভালোই লাগবে। এদিকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রক্তে তখন শর্করার পরিমান বেশি। মানে তিনি তখন ডায়াবেটিক। রাজা তো রেগে আগুন তেলে বেগুন হয়ে পুরো অগ্নিশর্মা! হালুইকরকে তো শূলেই চড়াতে বলে দিলেন। বেচারা হালুইকর কি করবে ভেবে ভেবে রাজার কাছেই অনুনয়-বিনয় করতে শুরু করলেন। যাতে এই মৃত্যুদন্ড থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

রাজার মন নরম হয়েছিল। তাকে শূলে চড়ায়নি ঠিকই তবে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিন রাতের মধ্যে যেন রাজ্য ছেড়ে চলে যান। বড় চিন্তায় পড়ে যান হালুইকরের স্ত্রী। ভেবে চিনতে তৃতীয় দিন সকালে রাজার সামনেই গেলেন। আর রাজাকে বললেন তিনি এমন লুচি তরকারি খাওয়াবেন রাজাকে যা পরিবেশনের বেশ কিছু সময় পরে খেলেও গরম থাকবে। রাজা এমন কথা শুনে বেশ উৎসুক। পাঠালেন হালুইকরের স্ত্রীকে রাজবাড়ির হেঁসেলে। যাবার আগে রাজাকে বলে গেলেন, খাবার যখন পাঠাবেন তৎক্ষণাৎ যেন সাবধানে খান নইলে মুখ পুড়ে যেতে পারে।

হেঁশেলে রাজপাচক আলুর তরকারি তৈরি করে অপেক্ষা করছেন। এদিকে ময়দাও মাখা রয়েছে৷ হালুইকরের স্ত্রী পাচককে কটাক্ষ করে ময়দার তাল নিয়ে বসলেন। আর ছোট ছোট লেচি কেটে লুচির মতো বেলে তাতে আলুর পুর ভরে ভালো করে মুড়ে সমভুজাকৃতি ত্রিভুজের আকারে গড়লেন৷ রাজা আসতেই দশটা এরকম ত্রিভুজ গরম তেলে ছেড়ে লাল করে ভেজে স্বর্ণথালায় সাজিয়ে নিজেই নিয়ে গেলেন রাজসভায়৷ রাজা দেখে তো স্তম্ভিত৷ হালুইকরের স্ত্রী অত্যন্ত বিনীতভাবে রাজাকে বললেন পুরোটা একেবারে মুখে না ভরে সামান্য কেটে খেতে, ভেতরে গরম হতে পারে এবং মুখও পুড়ে যেতে পারে। এই পদটির নাম হল সমভুজা। খেতে কেমন হয়েছে সে কথা মহারাজা মুখে উত্তর না দিয়ে গলা থেকে তিন ছড়া মুক্তোর মালা গলা থেকে খুলে দিলেন।

তৎকালীন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হালুইকর ছিলেন কলিঙ্গ তথা বর্তমান ওড়িষ্যা থেকে আগত গুণীনাথ হালুইকরের ষষ্ঠপুত্র গিরীধারী হালুইকর। আর তার স্ত্রী ধরিত্রী দেবীই এই মহিলা যিনি বানিয়েছিলেন এই সিঙ্গাড়া।

সিঙাড়া বানানোর গল্প বা উৎপত্তির গল্প এভাবে প্রচলিত থাকলেও কখনই সিঙাড়া ভারতের খাবার নয়। সিঙাড়ার জন্মভূমি হল ইরান৷

বহু বছর আগে ইরানে এই খাবারের জন্ম হয়। ফার্সি ভাষায় একে বলা হত সংবোসাগ। সালটা সম্ভবত ন’শ খ্রিষ্টাব্দ। সেই সময়টাতে ইরান তথা পারস্যের লোকজন যব ও ময়দার মিশ্রণে একটি মন্ড তৈরি করতেন এবং তার ভেতর কখনো সবজি কখনো মাংস ইত্যাদির পুর ভরে আগুনের সেঁকে নিতেন। অনেকটা বর্তমান লিপি বা বাটির রেসিপিরর মতো। পারসিকরা তাদের তৈরি এই পদটিকে নাম দিয়েছিলেন সাংবোসাগ। পরবর্তীকালে কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই সাংবোসাগ সিঙাড়ায় রূপান্তরিত হয়। আবার বেশ কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, ইরানের সাথে ভারতের সম্পর্ক তারও আগে তৈরি হয়েছিল। বেশিরভাগটাই ব্যবসায়িক সম্পর্ক। ইরানের বণিকরা ভারতে আসতেন বাণিজ্য করতে। রাস্তাঘাটে ঘোরার সময় মুখে দিতেন সাম্বুসা নামক একটি খাবার। যা তৈরি হতো ময়দা ও মাংসের সহযোগে। আমাদের সংস্কৃতিতে উল্লেখিত শৃঙ্গাটক শব্দটির অর্থ হলো সিঙাড়া। এই মত কি যদি গুরুত্ব দেই তাহলে বলা চলে সিঙাড়ার উৎপত্তি ভারতেই।

আবুল ফজল বাইহাকীর মতে একাদশ শতকে গজনী সুলতানদের দরবারে এই পদটি রাজকীয় খাদ্যসম্ভারের অংশ ছিল। পুর হিসেবে ব্যবহার করা হতো বিভিন্ন রকমের ড্রাই ফ্রুটস সাথে মাংসের কিমা। তারপর সেই রাজদবারের মুখরোচক খাবারটি একসময় তাকিকিস্তানের মেষ-পালকদের কাছে পৌঁছে গেল আর কাজু কিসমিসের মেওয়া হারিয়ে মাংসের কিমা ভরা সাধারণের খাবারে পরিণত হল। ঠিক যেমনটা সাধারণ মানুষ যেকোনো নামিদামি খাবার কে নিজের মতো করে তৈরি করে নেন। এরপর সময়ের সাথে সাথে হিন্দুকুশ পেরিয়ে বিভিন্ন ভাগ্যন্নেষী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে উত্তর ভারতের এসে পৌঁছয় সাবেক সামোসা। গঙ্গার অববাহিকা অঞ্চলে পৌঁছে মাংসের পরিবর্তে সবজি, পনির দিয়ে তৈরী হতে শুরু করলো সামোসা। ধনে, জিরে, গোলমরিচ, আদা-র মতো মশলা যোগ হয়ে খাঁটি ভারতীয় হয়ে উঠলো। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অঙ্গীভূত করে ভারতের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়লো। প্রত্যেক রাজ্যে – তার আলাদা স্বাদ। কোথাও সিঙাড়ার মধ্যে পনিরের পুর আবার কোথাও পুর মানে চাউমিন। কোথাও আবার শুধু পেঁয়াজ। একজনের কাছে শুনলাম যে দিল্লিতে নাকি চকলেট সামোসাও পাওয়া যায়। অবশ্য মিষ্টি ক্ষীরের সিঙাড়া তো আমরা সেই ছোটবেলা থেকেই খেয়ে এসেছি !

সিঙাড়া দেখলে মনে হয় এই খাবারটি হল গরীবের পিরামিড দর্শন। বাইরে মুচমুচে আবরণের ভেতর গুপ্তধনের মতো আলুর পুর। এই যে এতগুলো পুরের কথা বললাম এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, সিঙাড়া যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যের খাবার এবং মাংসের কিমা ও ড্রাই ফ্রুটসের পুরে ঠাসা, তাই বর্তমানে আলুর পুর দেখলে মনে হয়, খাবারটি তার রাজকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। এমনটা ভাবার সত্যিই কোন কারণ নেই। আলুর পর দেওয়ার অর্থ হল খাবারটিকে জনসাধারণের জন্য সহজলভ্য করে তোলা। ভারতবর্ষে যেহেতু আমি নিরামিষ এই দুটো বিভাগ রয়েছে তাই খাবার শুধুমাত্র মাংস দিয়ে হবে এবং তার স্বাদ কোনভাবেই নিরামিষাসিরা পাবে না এমন তো হয় না। আবার ইতিহাস বলে যে বাংলায় আলুর চাষ জনপ্রিয় করার প্রথম চেষ্টা শুরু হয় কলকাতায় এগ্রি-হর্টিকালচারেল সোসাইটি স্থাপনের পর, কেরি সাহেবের উদ্যোগে। তার আগে বাঙালি কি সিঙাড়া খেত ? কেন খাবে না? বাঙালি যে মটন প্রিয় জাতি এ কথা কি আলাদা করে উল্লেখ করার প্রয়োজন পড়ে? সেই কবে ঈশ্বর গুপ্ত লিখে গেছেন – “রস ভরা রসময় রসের ছাগল / তোমার কারণে আমি হয়েছি পাগল।” এই কলকাতা শহরেই কয়েকটি দোকানে আজও পাওয়া যায় মাংসের সিঙাড়া।

মাংসের সিঙাড়া প্রসঙ্গে বলে রাখি ইবন বতুতা আমিষ সিঙাড়ার একটি রূপ দেখেছিলেন মুহম্মদ বিন তুঘলকের শাহী ভোজসভায়। তার একটি বিবর্তিত চেহারা আজও “লুখমি” নামে প্রসিদ্ধ হায়দ্রাবাদ অঞ্চলে, যার মধ্যে মাটন কিমা ব্যবহার করা হয়। তবে সেটি দেখতে আয়াতকার; তিনকোনা নয়।

হরেক রকম সাইজে আর স্বাদে আজ সিঙাড়া শুধু উপমহাদেশেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে — যুক্তরাজ্য, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও “Samosa” নামে পরিচিত।
সিঙাড়া শুধু এক খাবার নয় — এটি একটি ইতিহাস, একটি সংস্কৃতি, একটি অভিযাত্রা। পারস্য থেকে বাংলার কলেজ ক্যান্টিন, মুঘল দরবার থেকে অফিসের টিফিনবক্স — সিঙাড়া সময় ও স্থান পেরিয়ে আজও আমাদের প্রিয় একটি সুস্বাদু চায়ের সাথে টা।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *