সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে নীলম সামন্ত (পর্ব – ৩)

মহাভারতের মহা-নির্মাণ, (পরাশর মুনি)
গত পর্বে সত্যবতী নিয়ে লিখতে গিয়ে পরাশর মুনির কথা লিখেছিলাম। বেশ কিছু প্রশ্ন মনের মধ্যে আসতে শুরু করে৷ প্রথম প্রশ্ন, পরাশরমুনির চরিত্রটির কি প্রয়োজন ছিল? সত্যবতীর গায়ের গন্ধ দূর করার জন্য? বেদব্যাসকে গল্পে আনার পথ? নাকি সত্যবতীর সৌন্দর্যের ধ্বজা ওড়ানোর পন্থা? এত প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? দাদাদের সাথে বিস্তর আলোচনা চলে৷ যতটুকু তথ্য পাওয়া যায়। গুগুলের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা করব এমন টা সম্ভব না৷ কিন্তু আলোচনা যে একটা শক্তপোক্ত পথ এ কথা প্রতিটি অনুসন্ধানীই জানেন৷ এক একটা কথায় নানান কথা উঠে আসে৷ এভাবেই যা এসছে যতটুকু বুঝেছি সেটাই তুলে ধরছি আপনাদের সামনে৷
পরাশরমুনি সম্পর্কে লিখতে শুরু করার আগে আমাদের জেনে নেওয়া ভালো মুনি কারা। সাধু, ঋষি, মুনি প্রতিটিই ভিন্ন ভিন্ন পদ৷ যিনি সাধু তিনিই মুনি বিষয়টা এমন নয়। অথচ দেখুন মুনি, ঋষি কিংবা সাধু নামগুলো ভাবলেই মাথায় একটাই ছবি ভাসে, গেরুয়া বসন, মাথায় জটা, রুদ্রাক্ষের মালা কপালে তিলক আঁকা ব্যক্তি, যাঁরা সাধক, যজ্ঞ করেন৷ এ আমাদের সাধারণ চিন্তা৷ সাধারণত টিভিতে দেখি। পরাশরমুনি সম্পর্কে জানার এইগুলো জেনে নেওয়া আবশ্যক বলে আমার মনে হয়।
প্রথমেই বলি সাধু৷ যাঁরা সাধু হন তাঁরা ঈশ্বর আরাধনা করেন৷ ধর্মীয় অনুশীলনের মাধ্যমে সাধনা করে মোক্ষলাভের পথে এগিয়ে যান৷ এদের ষড়রিপুর নিয়ন্ত্রণ থাকে। বলা যায় ষড়রিপুর জাল থেকে মুক্তিলাভ করেন। পুঁথি বিদ্যা নয় ধর্মাচরণ করেই এঁরা জ্ঞান লাভ করে থাকেন৷
মুনি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত মনন্ ধাতু থেকে, এর অর্থ চিন্তা করা। তাহলে মুনি সেই যে চিন্তা করে। আরেকটু স্পষ্টভাবে বললে হয় : যে অন্তর্দর্শন করে ও চিন্তাশীল, দার্শনিক । শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (২.৫৬) একটা কথা আছে : মৌনম্ আচরতি ইতি মুনিঃ । অর্থাৎ, যে মৌন থেকে অন্তর্দর্শন করে, চিন্তা করে, পর্যবেক্ষণ করে সেই মুনি। এনাদের বিস্তর জ্ঞান৷ বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্র পাঠ করে তা আত্মস্থ্য করেন ধ্যানের মাধ্যমে। এঁদের তপস্যা কঠোর৷
এরপর বলি ঋষি কারা। ঋষি হচ্ছেন সবথেকে উপরের স্তরের মানুষ যিনি সাধনার দ্বারা সত্যকে দর্শন করেছেন তাই নয়, মানুষের কল্যাণে তা প্রকাশ ও করেছেন। পথপ্রদর্শক। যেমন ঋষি বিশ্বামিত্র, (ইনি জাতিতে ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন। ঋকবেদের দশম মন্ডলের বিখ্যাত গায়ত্রী [আসলে একটি ছন্দ] মন্ত্রের দ্রষ্টা। কে কোথা থেকে আসছেন সেই অনুযায়ী দেবর্ষি, ব্রহ্মোর্ষি,মহর্ষি রাজর্ষি ইত্যাদি হয়। এই ঋষিরাই বেদের শ্লোক রচনা করেছন। তবে এনারাও কঠোর তপস্যা করেন। সমাজকে মুক্তির পথ দেখান৷
মহাভারতের মহা-নির্মাণে পরাশরমুনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বলে আমি মনে করি৷ কেন সেই আলোচনায় যাব। পরাশরমুনি আসলে কে ছিলেন জানেন? সপ্তর্ষিমণ্ডলের বশিষ্ঠমুনি ও অরুন্ধতীর পৌত্র অর্থাৎ নাতি। কী আশ্চর্য না? বাবা মায়ের পরিচয়ে পরিচিতি না দিয়ে দাদু ঠাকুমার পরিচয়ে পরিচিতি দিলাম! আসলে পরাশরমুনি তাঁর জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়েছেন৷ জন্ম মুহুর্ত থেকেই দাদুর কাছে বড় হয়েছেন৷ একেবারে ছোট বয়সে তিনি বশিষ্ঠমুনিকে বাবা জানতেন এবং পিতা বলে ডাকতেনও৷ পরে তা শুধরে নেন৷
বশিষ্ঠমুনির একশ’ পুত্র ছিল। পরাশরমুনির বাবা তাঁদেরই একজন, নাম শক্ত্রি। কল্মাষপাদ নামে এক রাক্ষস যিনি রাজা ছিলেন, তিনি বশিষ্ঠমুনির একশ’ পুত্রকেই খেয়ে ফেলেন৷ বশিষ্ঠমুনির পুত্রশোকে তখন ভরা শোক। আত্মহত্যা করতে গেছিলেন৷ কিন্তু তাতে সফল হননি৷ কি করেই বা হতেন? যে কাজের জন্য তিনি পৃথিবীতে এসছেন সেই কাজ সম্পূর্ণ না হলে কিভাবে দেহত্যাগ করবেন? ফিরে এলেন আশ্রমে। মুনি হেতু তাঁর রাগ, ক্ষোভ, লোভ ইত্যাদি না থাকলেও পুত্রশোকে মুষড়ে পড়েছিলেন৷ আশ্রমে ফিরে তিনি বেদ পাঠ শুনতে পান। পিছন ঘুরে দেখেন তাঁর পুত্রবধূ অদৃশ্যন্তী। অদৃশ্যন্তীর গর্ভ থেকেই ওই আওয়াজ আসছে। বশিষ্ঠমুনি তাকে আশ্রয় দেন এবং জন্ম হল পরাশর মুনির।
বড় হওয়ার পর পরাশরমুনি যখন জানতে পেরেছিলেন তাঁর বাবাকে হত্যা করেছিল রাক্ষস তখন তিনি রেগে গিয়ে
রাক্ষসদের উপর বিরূপ হলেন এবং সংকল্প করলেন রাক্ষস-সত্র করবেন। সে যজ্ঞ হল রাক্ষসদের নিধনযজ্ঞ। আগুন জ্বলল। তাতে একের পর রাক্ষস দগ্ধ হতে লাগল। তখন অত্রি, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু প্রমুখ উপস্থিত হলেন রাক্ষসদের বাঁচানোর জন্য। পুলস্ত্য বললেন, তুমি যাদের হত্যা করছো, এরা তোমার বাবার নিধন বিষয়ে কিছু জানে না, তোমার বাবার হত্যায় কোনও ভাবেই এরা দায়ি নয়। যে রাক্ষস তোমার বাবাকে ভক্ষণ করেছে সে ক্ষত্রিয় রাজা কল্মাষপাদ। একদিন চলার রাস্তা নিয়ে গোলমাল হয়। তোমার বাবা শক্ত্রি বলেন, ব্রাহ্মণকে পথ ছেড়ে দেওয়া রাজার সনাতন ধর্ম। তৃষ্ণার্ত রাজা তোমার বাবাকে কশাঘাত করে। তখন শক্ত্রি অভিশাপ দেন, তুমি নরমাংসভোজী রাক্ষস হও। কল্মাষপাদ রাক্ষসে পরিণত হয়ে তোমার বাবাকেই খেয়ে ফেলে।
রাগ হল মূর্খের ধর্ম। কথাটা বোঝার পর পরাশরমুনি রাক্ষসযজ্ঞ বন্ধ করলেন। নিরীহ রাক্ষসদের হত্যা করার জন্য অনুতপ্ত হলেন বটে কিন্তু সেই সত্রের আগুন নিভল না। পিতৃহত্যার বিষয়টি মাথা থেকে গেল না তাঁর। যুবক পরাশর ঘুরে বেড়াতে লাগলেন দেশ থেকে দেশান্তরে। হস্তিনার রাজপ্রাসাদেও তাঁর যাতায়াত ছিল। তখন যে বিধিগ্রন্থ হস্তিনায় চালু ছিল তাকে সরিয়ে নতুন বিধিগ্রন্থ বা সংহিতা চালু করার কথা ভাবলেন। তিনি রচনা করতে আরম্ভ করলেন পরাশর-সংহিতা—সেখানে নতুন নতুন সব বিধি রাখলেন, কেননা সমাজ পালটাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে বার্তা বা অর্থনীতি, দণ্ডনীতি বা রাজনীতিও বাঁক নিচ্ছে অন্য খাতে। পরিবার জীবনেও আসছে পরবর্তন। বিধবা, লম্পট পুরুষের স্ত্রী, ক্লীবের পত্নী, স্বামী পরিত্যক্তা নারীর পুনর্বিবাহের বিধিও রচনা করলেন।
ঠিক তাই৷ বিধবাবিবাহ আইন বহু বহু যুগ আগে শাস্ত্রেই ছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় যখন বিধবাবিবাহ আইন নিয়ে লড়াই করেন তখন পরাশর সংহিতা থেকেই এই শ্লোকটি পড়েন, যাকে সামনে রাখার কারণে তাঁর লড়াইটা সাফল্য পেয়েছিল৷ সেই শ্লোকটি বহুল প্রচলিত শ্লোক-
নষ্টে মৃতে প্রবৃজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ
পঞ্চসাপৎসু নারীনাং পতিরণ্যে…
অর্থাৎ, স্বামী যদি নিরুদ্দেশ হয়, মারা যায়, প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে (অর্থাৎ সন্ন্যাসী হয়ে যায়) ক্লীব (পুরুষত্বহীন) হয় অথবা পতিত (ধর্ম বা সমাজ থেকে বিচ্যুত) হয় তবে নারীর জন্য অন্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া বিধেয়।
আবার এই পরাশর সংহিতাই সহমরণের কথা বলে গেছে।
তিস্রঃ কোট্যোহর্দ্ধকোটি চ যানি রোমাণি মানবে।
তাবৎ কালং বসেৎ স্বর্গং ভর্ত্তারং যানুগচ্ছতি।
অর্থাৎ, স্বামীর মরণে যিনি সহমৃতা হন, সেই স্ত্রী মানবদেহে যে সার্দ্ধ ত্রিকোটি সংখ্যক রোম আছে তাবৎপরিমিত কাল স্বর্গ বাস করেন।
এতো গেল নারীদের অবস্থান সংক্রান্ত আইন। পরাশরমুনি কৃষকদের জন্য প্রায় পঞ্চাশটি শ্লোক লিখেছিলেন। যাকে কেন্দ্র করে কৃষকরা আকাশ চিনতে পারতেন। কৃষি পরাশরের শুরুতেই বলা আছে
কণ্ঠে কর্ণে চ হস্তে চ সুবর্ণ বিদ্যতে যদি।
উপবাসস্তথাপি স্যাদন্নাভাবেন দেহিনাম।।
অর্থাৎ, গলায় কানে হাতে যদি সুবর্ণের গয়নাও থাকে, তবু অন্ন অভাবে তার উপবাসের কষ্ট করতে হয়।
জানেন ভারতীয় কৃষির বয়স অন্তত দশ হাজার বছর৷ আর কৃষি পরাশর সেযুগে মানুষকে আকাশ দেখে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান দেখে আবহাওয়ার একটা কংক্রিট ভবিষ্যৎবানী করার ক্ষমতা দিয়েছিল।
এতো কিছু উনি রচনা করলেও তৎকালীন হস্তিনাপুরে তথা সমাজে তা কিভাবে চালু করবেন? আমার মনে হয় উনি ভবিষ্যত দ্রষ্টা ছিলেন। সেই কারণেই মৎসগন্ধাকে সঙ্গমের প্রস্তাব দিয়ে বলেছিলেন একটি পুত্র সন্তান উনি দিতে চান তার জন্ম দিক। আর শুধু সেই পুত্র সন্তানের জন্যই সত্যবতীর যাবতীয় শর্ত মেনে নিয়েছিলেন। এই বিষয়ে ডিটেলে যাবো না কারণ গত পর্বে সত্যবতী সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বিস্তারিত বলেছি।
কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের জন্মের পর পরাশরমুনিই তাকে তাঁর আশ্রমে নিয়ে গিয়ে বড় করেন এবং নানান শিক্ষায় পারদর্শী করে তোলেন। তাঁকে দিলেন ত্রয়ী, বার্তা, দণ্ডনীতি ও আন্বীক্ষিকীর পাঠ। আর নিজে পড়ে রইলেন জ্যোতিষ, বৃক্ষবিদ্যা ও কৃষিসংক্রান্ত নানাবিধ বিদ্যার চর্চায়। লক্ষ্য যখন স্থির পথ যত কঠিনই হোক তাকে অতিক্রম করতেই হয়৷ পরাশরমুনির ওই নতুন নিয়মবিধি সমাজে চালু করার উদ্দেশ্যে তাঁকে কত কি ভাবে পা ফেলতে হয়েছে৷
ভাগ্যের খেলাই বলি আর জীবনের ধারা। হস্তিনাপুরের সিংহাসন শান্তনুর হলেও সত্যবতীর বাবার দেওয়া নানাবিধ শর্ত থাকার পরেও শান্তনু ও সত্যবতীর বংশধর হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসেনি৷ বসলেন বেদব্যাসের বংশধর। ধীরে ধীরে দেখা গেল বেদব্যাসই হস্তিনাপুরের প্রধান পরামর্শ দাতা৷ অতয়েব পরাশরমুনির অসমাপ্ত কাজ তাঁর ছেলেই সমাপ্ত করল ধীরে ধীরে৷
পরাশরমুনি সারা জীবন পরিব্রাজকের মতো জীবন কাটিয়েছেন। বৃদ্ধ অবস্থায় শিষ্যসমেত তাঁকে একবার নেকড়ে আক্রমণ করে। খঞ্জ অবস্থায় বেশ কিছু দিন কাটানোর পর তিনি নেকড়েদের জন্য এই পৃথিবীকে রেখে পরলোকগমন করেন৷
তিনি হলেন ঋষি-পরম্পরার তৃতীয় পুরুষ। বশিষ্ঠপুত্র শক্ত্রি বা শক্তি তাঁর পিতা। তিনি যেমন পিতার ক্ষমতা বা শক্তি পেয়েছিলেন, তেমনি পেয়েছিলেন মাতা বৈশ্যকন্যা অদৃশ্যন্তীর যাবতীয় গুণ। তাঁর অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে চলত ক্ষমতাতন্ত্র। পরাশরের প্রপিতামহ স্বয়ং ব্রহ্মা। আবার তিনি (পরাশর) দুর্যোধনাদি কৌরবদের প্রপিতামহ। ঋগ্বেদের ১.৬৫—১.৭৩ মন্ত্রের রচয়িতা পরাশর। পরাশরের হাত ধরে কৃষি ও বাণিজ্য নতুন ধারা পেয়েছিল বলে মনে করা হয়। সেই নিয়ে সমস্যাও শুরু হয় অচিরেই। আসলে সব ভালোর আড়ালেও যে অন্ধকার থাকে তা অনস্বীকার্য। ক্ষমতার লোভ বড় লোভ৷ পরাশরমুনি ক্ষমতালোভী না হলেও তাঁর পরবর্তীরা সেই লোভের তাড়নাতেই ধ্বংসের খেলা শুরু হয়েছিল হস্তিনাপুর রাজবংশে৷
কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ আসলে পরাশরের প্রপৌত্রদের যুদ্ধ।