মেহফিল -এ- কিসসা নুসরাত রীপা

অচেনা আপন সুর

কবি কামাল কাহহার আর নেই!
নিউজফিডে খবরটা দেখে থমকে যায় লতা। চোখের সামনে কালো কালো বর্ণগুলো হিজিবিজি  হিজিবিজি মনে হয়।

কামাল কাহহার!
কালো মোটা ফ্রেমের চশমা।সব সময় পাঞ্জাবী পরণে। কী মিষ্টি মিষ্টি কবিতা! ধীরে ধীরে সুন্দর সুন্দর কথা, কী যে সুন্দর করে বলতেন! বয়সই বা কতো! পঞ্চাশের কাছাকাছি! লোকটা আর নেই। কবি আর নেই! ঠিক বিশ্বাস্য নয় অথচ মিথ্যেও নয়। নিউজফিড জুড়ে শোক প্রকাশের ঝড় উঠেছে বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তির পোস্টে।

লতা বার বার নিউজগুলো পড়তে থাকে।
কী হয়েছিলো? কীভাবে কী হলো? পড়তে গিয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে!

অথচ আজকের দিনটা কেটেছে দারুণ! আনন্দে ঝলমল । ওরা বান্ধবীরা মিলে সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখে একটা ফাস্ট ফুড কোর্ট থেকে খাওয়া দাওয়া, আড্ডাবাজি শেষ করে একটু আগে হলে ফিরেছে।

মাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। আজ শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটি। হলের অনেক মেয়েই বন্ধের দিন নিজের বাসায় বা লোকাল গার্ডিয়ানের বাসায় যায়, অনেকে ঘুরতে যায়। মোট কথা বন্ধের দিনগুলোতে হোস্টেলে কম মেয়ে থাকে আর যারা থাকে তারাও ঘুরতে বেড়াতে যায়। অবশ্য দশটার আগে ফিরে আসে।

এখন হোস্টেলটা তাই বেশ সুনসান। কোথাও কোনো কোলাহল হৈ হল্লা নেই।
টিভি রুম টা লতার রুমের কাছেই। আজকাল ক্রিকেট খেলা ছাড়া আর কিছু দেখতে মেয়েরা টিভি রুমে যায় না। হলের মালি বা রাঁধুনিরা সিরিয়াল দেখে। কিন্তু শুক্রবারে সম্ভবতঃ সিরিয়াল থাকে না। তাই টিভি রুম থেকেও কোনো শব্দ ভেসে আসছে না।

সারাদিন ঘোরাঘুরি করায় বেশ ক্লান্ত লাগছিলো,অথচ কবি কামাল কাহহার এর মৃত্যুর খবরটা জেনে ভীষণ অস্থির লাগছে।  ঘুম চোখেও ঘুম আসছে না।

চারিদিকের গভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে লতার মাথার ভেতর কেবল কামাল কাহহার নামটা উচ্চারিত হতে থাকে।

২)

বছর খানেক আগের কথা। সৌরভের কাছে প্রতারিত হয়ে লতা তখন হিতাহিত জ্ঞানহীন। কেবল বুক ভরা কষ্ট আর কষ্ট।  কোনো কিছু ভালো লাগে না।  কোনো কিছুতে উৎসাহ নেই। পৃথিবী, বেঁচে থাকা সব কিছুকে অর্থহীন মনে হয়। যখন তখন অকারণে কান্না পায়। প্রতিদিনই ক্লাশ কামাই দেয়। বিছানায় শুয়ে বালিশ ভেজায়। খেতে ভালো লাগে না। হলের ফেস্ট এ যায় না৷ বান্ধবীরা ডাকাডাকি করলে রেগে যায়। দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকে।
এরই মধ্যে সেমিস্টার পরীক্ষার ডেট পড়ে গেলো। লতা দিব্যি বুঝতে পারছে পরীক্ষায় বসলেই ও ফেল করবে। আর ওর মতো একজন ছাত্রী ফেল করলে সেটা লোকের মুখে মুখে ফিরবে। আর সেটাই শুধু নয়। মা বাবা শুনলে কষ্ট পাবে অগত্যা চারিদিক থেকে প্রচন্ড হতাশা ঘিরে ধরলো ওকে। মনে হলো এ জীবন রাখার কোনো মানে নেই।  সিদ্ধান্ত নিলো আত্মহত্যার!

যে রাতটাকে ও আত্মহত্যার জন্য বেছে নিলো সেটা ছিলো অমাবস্যা। রাতে ক্রমশ চারিধার নিরব হয়ে এলে, হলের মেয়েরা রুমের দরজা বন্ধ করে দিলে, টিভি রুম থেকে শব্দ আসা থেমে গেলে হাতে মোবাইলটা নিয়ে ছয়তলার ছাদে চলে এলো লতা।

অমাবস্যা, তাই ঘুটঘুটে অন্ধকার।  যদিও ল্যাম্প পোস্ট বা লোকেদের বাড়ি-ঘরের আলোর কারণে এ শহরে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা স্পষ্ট হয় না। তা সত্ত্বেও এই হোস্টেলটা অনেকটুকু জায়গার মাঝে তৈরি বলে এবং চারিদিকে বড় বড় গাছ-গাছালি থাকার কারণে এখানে অমাবস্যা, পূর্ণিমা অনুভব করা যায়। এখনও আশেপাশের কোনো আলো নেই।
কালি গোলা অন্ধকার।তবু বেশ একটু সময় আঁধারে থাকলে আঁধার চোখে সয়ে আসে আর তখন সব কিছু দেখা যায়।

যেমন এখন দেখা যাচ্ছে গাছের চূড়া, পানির ট্যাংক,আশেপাশের বিল্ডিং।

তবে এসবের দিকে মন নেই লতার। ও ছাদের একধারে একটা লোহার পাইপের ওপর বসলো। এখন এই সুন্দর পৃথিবীকে ভালোবেসে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিবে। কারণ ও চায় না, লোকজন বুঝতে পারুক ও আত্মহত্যা করেছে। তারা যদি জানে যে লতা আত্মহত্যা করেছে তাহলে নানা রকম মুখরোচক গল্প বানাবে৷ লতা চায় না কারো গল্পের খোরাক হতে।

লতার উদ্দেশ্য হলো ফেসবুকে সুন্দর একটা পোস্ট দিয়ে তারপর ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়বে। যাতে সবাই ভাবে ছাদের রেলিং না থাকায় হাঁটতে গিয়ে অসাবধানে পড়ে গিয়েছে!

৩)

লেখাটা মাত্র পোস্ট করেছে এবার ঝাঁপ দিতে যাবে ঠিক তখুনি ম্যাসেঞ্জারে একটা লাইন ভেসে উঠলো- এতো মিষ্টি কথা লিখতে পারা মেয়েটার সাথে কি কথা বলতে পারি?

বিরক্ত হয়ে লতা উত্তর লেখে- না

ঐপাশ থেকে আবার মেসেজ আসে- তুমি আমাকে চেনো। দেখো আমার নাম। আমার কবিতা ভালোবাসো তুমি।

এবার লতা খেয়াল করে ইনি কবি কামাল কাহহার।  যার লেখা কবিতাগুলো পড়তে গেলে লতার মনে হয় এই সব তারই কথা। ওর বুকের,ওর মনের গভীরের কথাই বলেছেন কবি তার কলমে।

প্রথম কয়েক মিনিট ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটের পর লতা কিছু বলার আগেই কামাল কাহহার কল করলেন।

আহা। কী সুন্দর সেই উচ্চারণ।  কী মোলায়েম ভঙ্গী, কী গাঢ় কন্ঠস্বর! এরকম কথা শুনতে হাজার বছর কানে ফোন ধরে রাখা যায়।

ফজরের পর ফোন রাখলেন কাহহার।  তার আগে অবশ্য নিজের ফোন নম্বর দিলেন,লতার ফোন নম্বর নিলেন আর লতার কাছ থেকে কথা নিলেন আগামী রাতে লতা ফোন করবে কাহহারকে!

কাহহার এর কারণে লতার সেদিন এবং পরে আর কোনোদিনই আত্মহত্যা করা হয়নি।

অবশ্য অনেকদিন পরে যখন দুজন অসমবয়সী মানুষ অনেক ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিল তখন কাহহার বলেছিলেন, লতার পোস্ট পড়েই পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন লতা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে। আর একজন মানুষকে ভুল পথ থেকে সরিয়ে আনতেই নিজের লেখালেখি সব বাদ দিয়ে তিনি প্রতিদিন কথা বলেছেন লতার সাথে।

লতাকে বুঝিয়েছেন আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। মরে গেলে কেউ মনেও রাখে না।

কবি কাহহার নিজেকে বন্ধু বললেও লতা তাকে দেখতো পথ নির্দেশকের মতো।

কাহহার বিবাহিত। তিন সন্তানের জনক। তার বড় সন্তান স্টেটস এ পড়ে। তার স্ত্রী সুপরিচিত গায়িকা সোনালু মায়াময়ী।

লতাকে তিনি সব বলতেন। শুনে শুনে লতারও সবাইকে কেমন যেন খুব চেনা, খুব পরিচিত মনে হতো।

এতো যে কথা, একদিনের জন্যেও দেখা হয়নি ওদের।

মোটা চশমা,ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়িসহ আধো আলো আধো অন্ধকার রহস্যময় একটা মুখ- কাহহার এর নামের সাথে এই ছবিটাই ভাসে লতার চোখে।

কয়েক মাসের মধ্যে বিষন্নতা কেটে গেলো
লতার। আগের মতো ঝরণা চঞ্চল জীবনে ফিরে এলো লতা।

৪)

গত কিছুদিন কম কথা হতো দুজনের। কাহহার অনেক ব্যস্ত থাকে। তাঁকে যখন তখন ফোন দেয়া যায় না। সময় সুযোগ পেয়ে তিনিই ফোন করেন।

কামাল কাহহার এর ফোন পেলে অদ্ভুত এক ভালো লাগায় ভরে যায় লতার মন।
এক নাগাড়ে কয়দিন ফোন না পেলে মনও খারাপ হয় ভীষণ। মাঝে মাঝে রাগও লাগে অনেক। লতা জানে এটা ঠিক নয়। লতা বোঝে এটা ঠিক নয়। কাহহার ওর প্রেমিক নয়। পথ নির্দেশক,পরামর্শক এবং শুভাকাঙ্ক্ষী।

তবু বয়সে দ্বিগুনেরও বেশি লোকটাকে মাঝে মাঝে ভীষণ মিস করে ও।

একদিন কথায় কথায় লতা বলেই ফেললো, আপনি আর আমাকে আগের মতো ফোন দেন না কেন?

লতার কথায় হেসে ফেলেন কাহহার। বলেন, আমি তোমাকে জীবন ভালোবাসতে শিখিয়ে দিয়েছি। এখন আমার কাজ শেষ!

কিন্তু আমি যে অপেক্ষায় থাকি আপনার কথা শুনবো বলে!

হা হা হা- লতার কথা শুনে হাসেন কাহহার।

একদম হাসবেন না। রোজ ফোন দেবেন আমাকে৷ আপনার কথা শুনলে পৃথিবীটা অনেক সুন্দর মনে হয়!

লতার কথা শুনে একটুক্ষণ চুপ করে থেকে কাহহার বলেন, তোমার পৃথিবীটা তো এমনিতেই সুন্দর!

না! আপনি বলেন, ফোন করবেন?

করবো। কিন্তু ধরো কোনো না কোনো কারণে আর কোনোদিন যদি ফোন করতে না পারি তবে বৃষ্টিতে কান পাতবে আর কান পাতবে গভীর অন্ধকারে বয়ে যাওয়া বাতাসের শীশে- তুমি শুনতে পাবে আমার কণ্ঠ!

৫)

লতা মোবাইলের ম্যাসেঞ্জারে কামাল কাহহার এর সাথে লিখিত কনভার্সেশন ডিলিট করে দেয়। তারপর কামাল কাহহার কে আনফ্রেন্ড করে দেয়।
তারপর আপন মনে ফিসফিস করে বলে,বৃষ্টি আর নিশিথ বাতাসের শব্দের মতোই আপনি আমার জীবনে ছিলেন,আর আজীবন তা ই থাকবেন কবি!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।