মেহেফিল -এ- কিসসা নুসরাত রীপা (গল্প)

খবরের আড়ালে

শরীরে তীব্র ব্যথা নিয়েই উঠে দাঁড়ায় লুবনা। সাড়ে বারটা বেজে গেছে। ঘরের সব কাজ বাকি। ঘর মোছা, কাপড় কাচা, রান্না করা।
হাঁটতে গেলেই বাঁ পা টা কন কন করে উঠছে। তবু সেই অবস্থাতেই পা টেনে টেনে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
লুবনার শাশুড়ি শরীফুন্নেসা বিছানায় শুয়ে পান চিবোচ্ছিলেন। মানুষের সাড়া পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, কে যায়? বউ না কি?
লুবনা খাওয়ার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে জগ থেকে গ্লাসে জল ঢালে। গলাটা শুকিয়ে আসছে। যেন হাজার বছর ধরে তৃষিত মরু বুকের ভেতর হাহাকার করছে । লুবনার শাশুড়ি পুত্রবূধূর উত্তর না পেয়ে বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন, বলি ও বউ, ক’বার করে ডাকছি। শুনতে পাও না। লুবনা ঢক ঢক করে পর পর দু গ্লাস জল খেয়ে তারপর ক্লান্ত স্বরে বলল, শুনেছি মা।
তো জবাব দাও না কেন?
শরীরটা খারাপ লাগছে।
রাজিব আজও রাগ করেছে। শুনেছি। শরীফুন্নেসা একটা চেয়ার টেনে বসেন,
আমি বলি কী, তুমি তোমার বাপের বাড়ি চলে যাও। এভাবে আর কত?
লুবনা কিছু না বলে রান্না ঘরে চলে আসে।
বিয়ের আজ এক বছর পূর্তি হল। চাল ধুতে ধুতে লুবনা ভাবলো। অথচ ওর মনে হচ্ছে কত কাল যেন পেরিয়ে গেছে। জীবনের দিনগুলো ক্লান্ত আর ক্রমশ বিষন্নতায় দীর্ঘ!
অথচ লুবনা একটা স্বপ্নচারিনী মেয়ে।একটা ঝলমলে হাসিখুশি স্বামী সংসারের জীবন কল্পনা করেছিল চিরদিন।
বাবা সরকারি অফিসের কর্মচারি।ছোটবেলা থেকে অভাব-অনটন টানাপোড়েনের মধ্যেই বড় হয়েছে। বড় দুই বোনেরও বিয়ে হয়েছে টানাটানির সংসারেই। লুবনার স্বপ্নেও তাই কখনো গাড়ি-বাড়ি হানা দেয়নি। কলেজের পুকুর পাড়ে বসে বান্ধবীদের সাথে নানারকম গল্পের ফাঁকে যখন বিয়ে সংসারের কথা উঠতো বান্ধবীরা বিয়ের পর সিঙ্গাপুর নেপালে হানিমুনে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতো লুবনা তখন আকাশে মেঘেদের ভেসে যাওয়া দেখতে দেখতে উদাস মনে ভাবতো স্বামীর সাথে মাঝে মাঝে সিনেমা দেখবে। মাঝে মাঝে কোন শরতের শুভ্র বিকেলে বন্ধের দিন স্বামীকে নিয়ে পার্কে যাবে। দুজনে বাদাম খেতে খেতে গল্প করবে। কখনো একটু খুঁনসুটি একটু দুষ্টুমি। টাকা বাড়ি গাড়ি নয়- সুখ মোড়ানো জীবনের স্বপ্নই ছিল লুবনার। রাজিবের চেহারা দেখে লুবনা মনে মনে বিস্মিতই হয়েছিল। কপালে এমন বর জুটবে এটাও আশাতীত। রাজিব রীতিমত স্মার্ট৷ চেহারাও ভালো।ঠিকাদারের সাথে মাল সাপ্লাই এর কাজ করে। কিন্তু তার ইচ্ছা নিজের এরা ব্যবসা দাঁড় করানো। হাতে টাকা আসার অপেক্ষা।
কে জানতো হাতে টাকা আসবে বলে বিয়ের অপেক্ষা করছিল রাজিব।বাবার এক কলিগ সম্বন্ধটা এনেছিল। দেওয়া থোওয়ার কথা কিছু ছিল না। কেবল তারা বলেছিলেন, আপনারা কিছু দিলে সে তো আপনার মেয়েরই থাকবে। এই কথার গভীরে প্রচ্ছন্ন চাওয়াটা বুঝতে পারেনি লুবনার পরিবারের কেউ।
চাল ধুয়ে ভাত বসায় লুবনা। পেঁয়াজ কাটে। মিষ্টি কুমড়ো কাটতে কাটতে আবার ওর চোখ জলে ভরে ওঠে। একটু ভারি কিছু এখনও আলগাতে পারে না। রাজিব মারের প্রথমটা শুরু করে হাত মুচড়ে দিতে দিতে।
প্রথম শুরু হয়েছিল বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায়। রাজিবের বড় বোনের জামাই লুবনার শ্যাম বর্ণের দিকে কটাক্ষ করে রাজিবকে বলেছিল, শ্যালক বাবু বুঝি কালো দিয়ে আলো আনলে জীবনে?
লুবনা কথাটা প্রথমে বুঝেনি। কিন্তু রাজিবের উত্তর শুনে হা হয়ে যায়। রাজিব বলে, না দুলাভাই। একদম ফকিন্নি। শুধু কানে একজোড়া দুল দিয়ে মেয়ে পার করেছে। আমি কালি দিয়ে কপালে আরো কালি মাখলাম—
সেদিনই বিকেলে চায়ে চিনি বেশি হওয়ায় সবার সামনে চড় দিল রাজিব। তারপর তো কথায় কথায় কারণে অকারণে হাত তোলা চলছেই। অত্যাচার বাড়ছে ক্রনশ।
রাজিবের একটাই কথা বাবার বাড়ি থেকে লাখ পাঁচেক টাকা আনতে হবে। ব্যস।
লুবনা জানে বাবা পাঁচ লাখ কেন পঞ্চাশ হাজার টাকাও দিতে পারবে না। বাবা তার সারা জীবনের কষ্ট পরিশ্রম সঞ্চয় সব বড় ছেলের পেছনে খরচ করেছিলেন।
বড় ছেলে ডাক্তারি পাসের পর উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ গিয়ে আর যোগাযোগ রাখেনি। বাবার স্বপ্ন ছিল বড়জন মানুষ হয়ে বাকিদের দেখবে। বাকিদের জন্য তিনি কিছুই রাখেন নি। ফলে মেয়ে গুলোকে কোনম তে পার করেছেন। পড়াশুনো তেমন না করিয়েই। একজনের বর কৃষিকাজ করে। আর একজন গ্রামে ঠিকাদার। শোনা যায় তার আরো একটা বউ আছে। কিন্তু বুকে পাথর বেঁধে বাবা সে খবর নিতে যান না। ছোট ভাইটা ডিগ্রি পড়ছে। সাথে টিউশনী করে।
লুবনার জন্য টাকা তিনি কোথায় পাবেন?
রাজিব দুই তিনবার লুবনাকে বাবার বাড়ি টাকা আনতে পাঠিয়েছিলো। লুবনা ঘুরে এসে বলেছে বাবার হাতে টাকা নাই। আসলে ও মুখ ফুটে বাবাকে বলতেই পারেনি রাজিব টাকা চেয়েছে। যৌতুক।
অত্যাচার এখন প্রতিদিন ক্রমশ বাড়ছে।
চুলায় মাছ ভাজতে লুবনা আনমনা হয়ে পড়েছিল। মাছ পোড়ার গন্ধে শাশুড়ি ছুটে এসেছে। তার কথায় লুবনা বাস্তবে ফিরে আসে। শাশুড়ি চেঁচায়। মাছ কিনতে পয়সা লাগে। বাপ তো ফকির। ও বাড়িতে এমন রোজ রোজ মাছ ভাত জুটেছে কখনো? রাজিব আসুক। ওকে বলবো,কোন নবাবের বেটিকে ঘরে এনেছে?
লুবনা মৃদু স্বরে বলে, মা ভুল হয়ে গেছে। ইচ্ছা করে পোড়াইনি।
আরে ফকিন্নি রাজিবরে বলিস। ছেলে আমার দৌড়াতে দৌড়াতে জীবন শেষ করে ফেলছে। একটা নিজের ব্যবসার স্বপ্ন দেখেছিল। সেটাও হল না। আর উনি মাছ ভাত খেয়ে আয়েশ করেন।
মা, দেখেন, আমার জন্য মাছ নেই নি। আপনাদের দুইজনের দুইবেলার জন্য চার টুকরো নিয়েছি। আমি মাংস মাছ এসব খাই না। ভর্তা বা ডাল দিয়ে খেয়ে নিই।
লুবনার এ কথা শরীফুন্নেসার পছন্দ হয় না। বউ কথার পিঠে কথা বলে এ অজুহাড তুলে সে মেয়েদের কে ফোন দেয়। রাজিব কেও জানায়।
রাজিবের মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিল। সে হিসহিস করে বলে আমি আইসা ওর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা দেখবো—।
লুবনা রান্না টেবিলে গুছিয়ে গোসল করে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে। রাজিব যে দিন বলে, আজ দেখাবো, সেদিন মারের পর শরীরে কোনও সার থাকে না লুবনার। ফিরে যাওয়ার জায়গা নেই। লুবনা এক টুকরো কাগজে সুইসাইড নোট লিখতে বসে। ওর চোখ জলে ভেসে যায়। ও তো বেঁচে থাকতে বড্ড ভালোবাসে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।