ডায়েরিটা নিয়ে বসল রোশনি। সকাল থেকে বুকের মাঝে খচখচ করছে কাঁটাটা। অভিমান ঝরে পড়ল কলমের ডগায়…
‘এ কি সেই তুমি?
এতটুকু বিচ্যুতি সারা ফেলত যার মনে!
আজ আলোকবর্ষ দূরত্ব দুজনের মাঝে।
কেন, ঠিক কেন এভাবে…?
শান্তদিঘীর মত এ নীড়ে,
আজ চাঞ্চল্য অসীম।
দূরত্বের সীমারেখা পার হওয়া বড়ই দুস্কর।
তুমি আমি মিলে যে আলোকবর্তিকা গড়ে তুলেছিলাম।
আজ ফানুস হয়ে উড়ে গেছে ওই দিগন্তে!’
টপটপ করে দুটো ফোঁটা ভিজিয়ে দিল ডায়েরির পাতাটা। হোস্টেল থেকে ছেলের ফোন, দুই চারটে কথা বলেই হবু ডাক্তার ছেলে বলল, ‘মেঘ জমেছে আবার! বাবা বুঝি ব্যালকনিতে…’
রোশনি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘পাকামী না?’ ছেলে হা হা হা হা করে হাসতে হাসতে বলল, ‘নাও! আবার কিছুদিন মান অভিমানের খেলাটা হয়ে যাক… আমি রাখি…’
ব্যালকনির চেয়ারটার আওয়াজে ডায়েরিটা বালিশের তলায় রেখে চোখ বুজল রোশনি।
ঋজু ব্যালকনিতে একটার পর একটা সিগারেটে ব্যস্ত। ফোনটা আওয়াজ করছে অবিরত। ১৯৯৭ এর গ্রাজুয়েশন করা ছেলে মেয়েগুলো হঠাৎ ফেসবুকের দৌলতে এক হয়ে একটা হোয়াটস আপ গ্রুপ খুলেছে। কত কথা, কত ম্যাসেজ ঢুকে যাচ্ছে অবিরত। ফোনটা পাশে পড়ে, দূরের নীহারিকার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঋজু। চোখটা বড্ড জ্বালা করছে তার। অবিশ্বাসের কালো মেঘটা সরাতে এতটুকুও তাগিদ অনুভব করেনি সে। বিশ্বাসই যেখানে ঠুনকো, সেখানে…
***
ঋজু আর রোশনি ইউনিভার্সিটির প্রসিদ্ধ নাম। প্রেম কেউ এদের কাছে করতে শেখে। ভালোবাসার নদীটা যখন স্রোতস্বিনী গঙ্গার মত অনুকূলে বয়ে চলেছিল কলেজ ক্যাম্পাসে সেদিন হঠাতই পিয়ালী। টুপটুপ করে ঝরে পড়া বকুল সুবাস মেখে তখন একে অন্যে বিভোর ছিল রোশনিরা।
‘আরে! ঋজু না!’ চিৎকারে আশপাশের সব্বার চোখ পিয়ালীর প্রতি। সবাইকে সরি জানিয়ে সে তখন এসে বসে ওদের দুজনের মাঝে। রোশনিকে বলল, ‘উফফফ ঋজু তোমার সাথে প্রেম করছে, ভাবতেই পারছি না। আমি তো ওকে এত্তটা ভালোবাসি। তো আমার ভাগ্যে জুটল না। তবে ও আমাকে…’
ঋজু বলল, ‘তোর বকবকানি আর কতক্ষণ চলবে?’
এরপর কত কথা, কত গল্প, কত কিছু… প্রেমে ঘাটতি পরেনি ঋজু রোশনির। বিয়ে সংসার। একমাত্র ছেলে এখন ডাক্তারি পড়ছে। দুজনে আবার পুরোনো রোমান্স… সবাই কত মজা করে। এরা একে অন্যে হারায় সব সময়।
কয়দিন আগে ঋজু বাথরুমে ছিল। ফোনটা এল। রোশনি ফোনটা ধরতেই ওপারে পিয়ালী কলকল করে বলে গেল, ‘তোকে বড্ড মিস করছি রে ঋজু। তুই তো রোশনিকে পেয়ে আমাকে ভুলে গেলি। একবার আমার কথা ভাবি। তোর প্রেমে কলঙ্ক ভাগী হয়েই রয়ে গেলাম।’
বাথরুম থেকে ফিরেই আর নাগাল পেল না রোশনির। কত জানতে চাইল কী হয়েছে, কিন্তু না, চুপ তো চুপ…
তার সাতানব্বই এর ব্যাচটা আগেরদিন রাতেই হয়েছিল। রোশনিকে বলার সময়ই হয়নি। এরই মাঝে কী যে হলো উত্তর নেই ঋজুর কাছেও।
বিছানায় ফিরতে ইচ্ছে করছিল না ঋজুরও। ম্যাসেজ ঢোকার আওয়াজে রোশনি নিশ্চিত পিয়ালীর সত্যে ঋজুর কথা চলছে। অভিমানের পাহাড় জমছে দুটি মনে… ভাঙবে কে প্রতীক্ষায় এ রাত আর আমরা…